বিচার চাই না—এটা কি শুধু অভিব্যক্তি, অনাস্থা নয়?

আইসোমরফিক মিমিক্রি বা সমরূপ অনুকরণ জীববিজ্ঞানের একটি পরিভাষা। এর সরল অর্থ হচ্ছে, বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনেক জীবই এমনভাবে বিবর্তিত হয়, যাতে এদের হিংস্র বলে মনে হতে পারে। আদতে সেসব জীব হিংস্র নয়। এটা আসলে টিকে থাকার এক ধরনের কৌশল । জীববিজ্ঞানের এই ধারণাকে সামাজিক বিজ্ঞানেও নিয়ে এসেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর প্রিটচেট। তিনি বলেন, নব্য উন্নত দেশগুলো প্রকৃত উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে কিন্তু কাঠামোগত সাদৃশ্য ছাড়া তাদের মধ্যে

কার্যকারিতায় কোনো মিল নেই। কিন্তু তারপরও যারা দেশ চালান তারা নানা ছলে বলার চেষ্টা করেন আমরাও উন্নত, আমাদের শাসন আইনের শাসন। কিন্তু চুপসে যেতে হয় তখনই, যখন কোনো জরিপ বা সূচক প্রকাশ পায়। একই তালিকায় একদম ওপরে আর একদম নিচের সারির দেশগুলোর মানের পার্থক্য হয় আকাশ-পাতাল। যেমন পার্থক্য আইন আর আইনহীনতার মাঝে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিওজেপি) ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইনের শাসনের এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। গত অক্টোবরে ২০২১ সালের আইনের শাসনের সূচক প্রকাশ করে, এতে ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। সংস্থাটি এর আগের বছরের প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশ ১২৮টি দেশের মধ্যে ১২২তম অবস্থানে ছিল।

ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের ওপর হামলা ও হত্যার এক কঠিন সময় পার করেছে বাংলাদেশ। প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কার্যালয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের পর দীপনের বাবা দেশের অন্যতম চিন্তক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না, সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’ এর আগেও হয়তো এমন চাওয়া হয়েছে কিন্তু এর পর থেকে বিচার না চাওয়াটা নানা সময়ে দেখা গেছে। শাহজাহানপুরে গুলিতে প্রাণ হারানো সামিয়া আফরীন প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিনও বলেছিলেন, ‘মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই। তিনিই বিচার করবেন।’ রাষ্ট্রকে আস্থায় নিতে না পেরে আল্লাহর কাছে বিচার চাইছেন।

‘বিচার নাই’ এই ধারণা ভুক্তভোগীদের আরও ভয়ের মধ্যে নিপতিত করে। আর সাধারণ মানুষের মনে ‘বিচার নাই’ এই ভয় ও বঞ্চনা যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি করে, সে থেকেই মানুষ বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। এ প্রবণতা কিন্তু ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

‘বিচার চাই না’ শুধু একটি অভিব্যক্তি নয়, এটি একটি অনাস্থা। প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি বিরাগ। এই প্রবণতায় অপরাধী ধরে নেয় অপরাধ যা-ই হোক না, বিচার বা শাস্তি তো অনিশ্চিত। আবার সম্ভাব্য অপরাধীরা আগাম ছাড়পত্র আছে ভেবে লাগামহীন হতে পারে। ‘বিচার নাই’ এই ধারণা ভুক্তভোগীদের আরও ভয়ের মধ্যে নিপতিত করে। আর সাধারণ মানুষের মনে ‘বিচার নাই’ এই ভয় ও বঞ্চনা যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি করে, সে থেকেই মানুষ বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। এ প্রবণতা কিন্তু ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

কমবেশি একই ঔপনিবেশিক অতীত ও আইনের লিগেসি বহন করছে বাংলাদেশ ও ভারত। যে কারণে সমস্যার ধরন যেমন একই রকম, তার সমাধানের কৌশলও কাছাকাছি। বেশ কিছু ক্ষেত্রে শুধু শিরোনামে দেশের নাম বদল হয়েছে, আদতে আইনের বয়ান ও ব্যাখ্যা এক ও অভিন্ন। আমাদের দেশে রয়েছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া আছে। ভারতেও চাঞ্চল্যকর মামলার নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার বা ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত রয়েছে। কিন্তু বিষয়টিকে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তিরস্কার করেছেন, এক রায়ে বলেছেন, বিশেষ ধরনের মামলা নয়, গোটা ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকেই দ্রুততর করতে কাঠামোগত সংস্কার দরকার। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ পর্যবেক্ষণ সংবিধানসম্মত। কারণ, একেক মামলার ক্ষেত্রে একেকরকম বিচার প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয়। ফাস্ট-ট্র্যাক বিষয়টি আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সংবিধানসম্মত নয়। দ্রুত বিচার প্রাপ্তি সর্বজনীন হতে হবে।

টমাস হবস মনে করেন, মানবজাতির এক স্থায়ী ও বিরামহীন (পারপেচুয়াল অ্যান্ড রেস্টলেস) ইচ্ছা থাকে ক্ষমতার প্রতি, যে কামনার শেষ হয় মৃত্যুতে। এর কারণ হচ্ছে, একজন মানুষ যে ক্ষমতার অধিকারী, এর চেয়ে অধিক ক্ষমতা ব্যতীত যে বেঁচে থাকা সম্ভব, এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হতে পারে না। ধনসম্পদ, মর্যাদা ও কর্তৃত্বের বা অন্যান্য ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা মানুষকে ঘৃণা ও যুদ্ধমুখী করে তোলে, একে অন্যকে দমন করে, বঞ্চিত করে, হত্যা করে। এ যুদ্ধে প্রতিটি মানুষই একে অপরের শত্রু। এ বাস্তবতা মানবজাতির প্রাকৃতিক অবস্থা। হবসের প্রেসক্রিপশন হচ্ছে, এ দুরবস্থা থেকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে সামাজিক চুক্তি (সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট)। আমাদের সমাজের কেউই আর সে চুক্তির শর্ত মানতে রাজি নয়। যে কারণে আইনের লঙ্ঘনের এমন বাড়বাড়ন্ত।

টমাস হবস তাঁর লেভিয়াথান বইয়ে এক যুগান্তকারী মন্তব্য করেছিলেন ‘সাধারণ লোকের জীবন (সামাজিক চুক্তির আগে) ছিল কদর্য, বর্বর ও সংক্ষিপ্ত’। এমন মাৎস্যন্যায় অবস্থাই হয়তো সামাজিক চুক্তি সূচনার জন্য উপযুক্ত সময় তৈরি করেছিল। আমরা কি আবার এমন একসময়ে উপনীত? সেই সামাজিক চুক্তির মেয়াদ কি আমরা পার করে ফেলেছি?

‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ এই প্রত্যয়ের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত কিংবা বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারের প্রচার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচিত দু’একটা মামলার নিষ্পত্তির পর সরকার পরিচালনায় যুক্ত লোকজন রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে জানান দেন যে, ‘দেখলেন তো কেমন আইনের শাসন’। প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে আমরা বাধ্য হই তাদের বক্তব্য শুনতে ও দেখতে। কিন্তু বালি ও ফেনা বইতে কাহলিল জিবরানের সেই আক্ষেপ মনে রাখি না, ‘তোমরা কান দিয়ে শোন তারা যা বলছে আরও বেশি কান দিয়ে শোন তারা যা বলছে না’।

  • এম এম খালেকুজ্জামান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
    adv.mmkzaman@gmail.com