আইন কমিশনকে শুরুতেই ধন্যবাদ দিই। কারণ, সরকার তাদের কাছে চায়নি, কিন্তু তারা ‘স্বতঃপ্রণোদিতভাবে’ একটি একক আইনের (ভূমি আইন, ২০২০) খসড়া তৈরি করেছে। প্রস্তাবিত আইনটি শুধু ভূমি বা সরকারি জমি নয়, নদী ও সাগরতীর, হাওর, খাল, বিল, জলাশয়, বনভূমি, গোচারণ ভূমি, রেলের জমি, সায়রাত মহাল (জলমহাল, চিংড়িমহাল, বালুমহাল, পাথরমহাল, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, ফেরিঘাট ইত্যাদি) সবটারই ব্যবস্থাপনা নতুন আইনটির আওতায় থাকবে।
গত সপ্তাহে সারা দেশে জেলা ও দায়রা জজ এবং ইউএনওর কাছে মতামত চাওয়া হয়। আমাদের জানামতে, বিচার প্রশাসন, বিশেষ করে অংশীজনদের মধ্যে ইতিমধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা ভূমি আইনের সমন্বয় নাকি দেওয়ানি আদালত উপেক্ষা করার মুসাবিদা। সরকারি জমি বা বিভিন্ন মহাল নিয়ে প্রচুর মিথ্যা ও পাল্টাপাল্টি মামলা হয়। বহু ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু তা কি শুধু আদালতের দোষে? আদালতের এখতিয়ার ছিল বলেই এরশাদের ‘জনতা টাওয়ার’ আবার সরকার ফিরে পেয়েছে। এখন নতুন আইনটি (১৬৮ থেকে ১৭৬ ধারা) বলছে, সরকারি জমি, পতিত জমি ও গণব্যবহারযোগ্য জমির বিষয়ে ডিসি ও ইউএনওর সিদ্ধান্তই শেষ কথা। সংক্ষুব্ধ মানুষ আদালতে যেতে পারবে না। বলা হয়েছে, এসব জমির বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার নিষিদ্ধ করা হলো। যেখানে যা বিচারাধীন আছে, তা আইনটি জারির তারিখে আপনা–আপনি বিলুপ্ত হবে। আইনটি একই সুরে সায়রাত মহালের বিষয়ে বলেছে, সরকারের অধিকার খর্বে কোনো আদালতে মামলা চলবে না।
যা পুলিশালয়ে ঘটে, যা ডিসির আলয়ে ঘটে, সেটা বিচারালয়েও ঘটে, ঘটতে পারে। কোথায় কি ঘটে না, কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন? সুতরাং দেশের অবস্থা যখন এই, তখন দেশে সাধারণভাবে দরকার ভারসাম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থা। অবশ্যই সেটা ক্ষমতার পৃথক্করণ বা বিচার বিভাগ পৃথক্করণকে ধ্বংস করে দিয়ে নয়। বরং বিশ্বসভ্যতার বিবর্তন এটাই নির্দেশ করে যে যখন কোনো একটি সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ধরনের নৈরাজ্যিক অবস্থার মধ্যে খাবি খাবে, তখন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও পৃথক্করণ নীতিকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
ভূমি সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক অনীহা খুবই পরিষ্কার। নতুন জরিপ করা, ডিজিটাল ম্যাপিং করার সঙ্গে মৌলিক ভূমি সংস্কারের কোনো যোগসূত্র নেই। এ রকম একটি পটভূমিতে চারদিক থেকে অনেকেই যেভাবে নির্বাহী বিভাগের আমলাদের হাত শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, তা বড় পীড়াদায়ক। করোনা–পরবর্তী ডিসি সম্মেলনে অপরাধ আমলে নেওয়ার দাবি এবার যে জোরেশোরে উঠবে, তাতে সন্দেহ সামান্য। এই ক্ষমতা নিতে পারলে তাঁদের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। এর ওপর যদি ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকর ক্ষমতাটা তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে তো দিনকে রাত, রাতকে দিন করার রাষ্ট্রীয় যন্ত্রটা আরও দানবীয় হতে পারে।
খসড়া আইনটির ধারা ২৬৩ থেকে ২৬৮ পর্যন্ত ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, ট্রাইব্যুনাল গঠন, আপিল, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লিখিত আছে। এতে ডিসির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ডিসির ক্ষমতায়ন ঘটানো হচ্ছে। এমনভাবে ধারাগুলো লেখা হয়েছে, যাতে শেষ পর্যন্ত ডিসিরাজ কায়েম হয়, যা ঐতিহ্যগতভাবে দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার, সেসব ডিসির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্নটা সরল। এতকাল ধরে বিচারকেরা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা দিতে পারেননি। তার কারণ কী ছিল? সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে কি না।
আইন কমিশনের খসড়াটি আন্তর্জাতিক মানে দায়সারা, খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ণ। ব্রিটেন এমনকি ভারতের আইন কমিশন এমনভাবে খসড়া তৈরি ভাবতে পারে না। অবশ্য আইন কমিশন যদি লোকবল বা লজিস্টিকস সংকটের কথা বলে, তাহলে সেটা ভিন্ন। সেটা অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা। কিন্তু এমন খসড়ার ওপর ‘অংশীজনদের’ কাছ থেকে ভালো মতামত আশা করা অসম্ভব। অধিকাংশ অংশীজন জানেন না বিদ্যমান আইনে কী ছিল, গত ৫০ বা ১০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের আদালতগুলো রায় দিয়ে দিয়ে কী কী ব্যাখ্যা বা নজির সৃষ্টি করেছেন এবং কোথায় কোন প্রশ্নে আইনবিদ ও নির্বাহী বিভাগ আটকে গেছে, কোথায় তাঁরা সবাই একমত হতে পেরেছেন।
খসড়াটিতে তিন শ ধারা আছে। প্রতিটি ধারা আগে দেখতে কেমন ছিল, সেটা অংশীজনদের জানতে দিন। এরপর থাকবে সংশোধনীগুলো। সঙ্গে থাকবে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া আদালতের রায়, এরপর থাকবে আশপাশের দেশের আইনের সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনা। পরে প্রস্তাবিত সংশোধনীর পক্ষে ব্যাখ্যা।
আদালত বা ট্রাইব্যুনালকে খাটো করে ডিসির কর্তৃত্বে যদি মানুষ বেশি উপকার পায়, তাহলে পাক। সেটা অবশ্য বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু তাতে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। উপযুক্তরূপে প্রস্তাবিত সংশোধনীর কারণ স্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করতে হবে। কী ধারণা বা উপলব্ধির ভিত্তিতে খসড়াজুড়ে ডেপুটি কালেক্টরের ভূমিকাকে মহীয়ান করা হয়েছে, তার স্বচ্ছ ব্যাখ্যা থাকতে হবে।
যেমন ৩৬ ধারা তো ভয়ংকর। খতিয়ান জমির মালিকানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বলা হয়েছে, চূড়ান্ত প্রকাশিত খতিয়ান সম্পর্কে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ বা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ছাড়া অন্য কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তার মানে হলো ডিসি নিয়ন্ত্রিত ‘কর্তৃপক্ষ’ যা বলবে, সেটাই শেষ। আদালতের এখতিয়ার হরণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এভাবে আমরা খসড়াটিতে আদালতে অসাংবিধানিক হিসেবে বাতিল হওয়া মোবাইল কোর্টের ভূত দেখি। ডিসিদের হাতে শুধু ভূমি ব্যবস্থাপনা আছে বলে মানুষ কী সুফল পেয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। সুফল পেলে ভূমিবিরোধে আমজনতার পরান জেরবার হতো না। তাহলে ডিসিকে আরও ক্ষমতা কেন দেব। যদি বলা হয়, জনপ্রতিনিধিদের থেকে ডিসিরা বেশি যোগ্য, বেশি দক্ষ; তাহলে জনপ্রতিনিধিদের এই হাল কেন হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর আগে খুঁজতে হবে। বাস্তবতা দাঁড়াবে, ডিসির প্রতিকারে সন্তুষ্ট না হলে মানুষ দেওয়ানি বা রিট কোর্টে আসবেই।
ডিসিদের এভাবে মহাক্ষমতাবান করার চেষ্টা কেবল যে এই আইনেই দেখি, তা নয়। প্রস্তাবিত ভূমি ব্যবহার স্বত্ব গ্রহণ আইনের ৩০ ধারা তার একটি উন্মাদীয় নজির। এটি বলেছে, জেলা প্রশাসক ও বিচারক উভয়ে দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। ডিসি চাইলেই ‘সমন জারি করে যেকোনো ব্যক্তিকে হাজির হতে এবং শপথ গ্রহণপূর্বক সাক্ষ্য প্রদানে বাধ্য করতে’ পারবেন। এই উদ্ভট খসড়া কে তৈরি করেছে? আইন কমিশন সংশ্লিষ্ট একজনকে বললাম, আপনাদের হাত? বললেন, ‘না। এটা আমরা জানি না। তবে এমন বিধান হতেই পারে না।’ আইন কমিশনের খসড়ায় কার্যত প্রায় এক ডজন ধারায় দেওয়ানি আদালতের ব্যবচ্ছেদ ঘটেছে। মনে হয় যেন আদালতের ডানা ছাঁটা আর ডিসির ডানা লাগানোই খসড়াটির টার্গেট। কেবল প্রশাসন ক্যাডারের ডিসির অধস্তন সদস্যদের দিয়েই গঠিত হবে ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইব্যুনাল। ডিসির নির্দেশে আপনি উচ্ছেদ হবেন। আপিল করবেন তারই অধস্তনদের কাছে। ভূমিতে সরকারি স্বার্থ মূলত কর আদায়ের। অথচ প্রস্তাবিত আইনে ভূমির মালিকানাসহ সব ধরনের বিরোধের সুরাহা দেবেন ডিসি। তাহলে আদালত তুলে দিলেই হয়! বাক্স্বাধীনতারও নিয়ন্তা ডিসি। ডিসির নির্দেশে নাগরিকেরা ভূমি অধিগ্রহণ বা হুকুম দখলসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে বাধ্য থাকবেন। অমান্য করলে বা অমান্যে প্ররোচনা দিলেও ছয় মাস জেল।
একজন সতর্ক অংশীজনের মতে, ‘মানুষ হবে ফুটবলের মতো। একবার লাথি খেয়ে এই কোর্টে যাবে। একবার ট্রাইব্যুনালে, একবার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে, আরেকবার আপিল বোর্ডে। আদতে কোনো সমাধান হবে না। মাঝখানে টাকা ভরবে উকিলদের। পকেট কাটা যাবে বিচারপ্রার্থী জনগণের। এমন নির্লজ্জ আক্রোশের প্রতিফলন আর কোনো ড্রাফটে আপনি পাবেন না। টোটাল নেগেশন অব দেওয়ানি আদালত।’ আইন কমিশনের একটি সূত্র একটু ভরসা দিলেন। বললেন, খসড়াটি তাড়াহুড়া করে ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। বানানসহ অনেক ভুলভ্রান্তি আছে। যদি তা–ই হয়, তাহলে আমরা বলব, এটি অবিলম্বে সরিয়ে নিন।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান। আদালতে ভরসা নেই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভূমিবিরোধ বুঝবেন না, বুঝবেন সব ডিসি; রাষ্ট্রের চরিত্র বদলকারী এমন আইনের খসড়া তিনি থাকতে চূড়ান্ত হবে, তা বিশ্বাস করতে চাই না।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com