ঈদের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিছুটা গরম কথাবার্তা বলে রাজনীতি উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছিলেন। মির্জা সাহেব দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে নেতা-কর্মীদের শিরদাঁড়া খাঁড়া করার কথা বলেছেন। আর কাদের সাহেব শিরদাঁড়া থাকা না-থাকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধী দলের শিরদাঁড়া খাঁড়া না থাকলে সরকারি দলের শিরদাঁড়া যতই খাঁড়া থাকুক গণতন্ত্র মজবুত হয় না। সরকারি ও বিরোধী দল মিলেই গণতন্ত্র।
নেতা-নেত্রীদের সুবচন এখন আর দেশবাসীকে উজ্জীবিত করে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে দলীয় রাজনীতি এতটা ভঙ্গুর ও দিগ্ভ্রান্ত অবস্থায় কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না। এটি সরকারি ও বিরোধী—উভয় দলের জন্য সত্য।
বাংলাদেশে এখন চার ধরনের দল আছে। এক. সরকারি দল আওয়ামী লীগ। দুই. বিরোধী দল বিএনপি ও তার সহযোগীরা। তিন. অনিচ্ছুক বিরোধী দল, যার মধ্যে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের ছোট শরিকেরা আছে। নির্বাচনের আগে তাদের অবস্থান মোটামুটি এক হলেও এখন ভিন্ন হয়ে গেছে। এরা কেউ বিরোধী দলে থাকতে চায়নি। কিন্তু বড় শরিক আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এবারে নির্ভেজাল আওয়ামী লীগ সরকার হবে। অন্য দলের কেউ সরকারে থাকবেন না। চার. সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল, যারা গত নির্বাচনে অংশ নিলেও কোনো আসন পায়নি।
নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, বিএনপি একটি বড় দল, তিনবার ক্ষমতায় ছিল। তাদের সঙ্গেই ক্ষমতাসীনদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বর ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেল, জাতীয় পার্টি ২২টি আসন পেলেও বিএনপি ও তার জোট শরিকেরা পেয়েছে মাত্র ৮টি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেওয়ায় তাদের আরও একটি আসন কমে গেছে। ফলে বিএনপি জোটের মোট আসন ৫+২=৭। সংরক্ষিত আসনের রুমিন ফারহানাকে ধরলে ৮।
আওয়ামী লীগের নেতারা ও তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলার চেষ্টা করেন যে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে থাকেননি বলেই নির্বাচনটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি এবং বিরোধী দলের ভরাডুবি হয়েছে। তাঁদের দাবি, সরকারের দমনপীড়ন সত্ত্বেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঠে টিকে থাকা উচিত ছিল। এসব কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা সম্ভবত ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ও ২০০৭-৮ সালে আওয়ামী লীগের লড়াকু সেনাদের পশ্চাদপসরণের কথা ভুলে যান। যাঁদের অপকর্মের জন্য আওয়ামী লীগ ২০০১ সালের নির্বাচনে হেরেছিল, তাঁদের অনেকেই প্রথম সুযোগে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন। আর এখানে বসে সংখ্যালঘুরা বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-ক্যাডারদের হাতে মার খেয়েছেন। অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সবিনয়ে তাঁদের জানাতে চাই, নির্বাচন তো গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিতে পছন্দসই প্রতিনিধি বাছাই করার একটি সর্বজন স্বীকৃত মাধ্যম। তা নিয়ে মারামারি, লাঠালাঠি কিংবা খুনখারাবি করতে হবে কেন? আওয়ামী লীগ নেতারা এখন আর জিয়া-এরশাদ-খালেদা আমলে নির্বাচনে কারচুপির কথা উচ্চকণ্ঠে বলেন না বা বলার নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছেন।
নির্বাচনের আগে তো বটেই, পরেও আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে ‘কী হইলে কী করিতে হইবে’ ধরনের উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির বর্তমান দুরবস্থার জন্য কেউ কেউ আফসোসও করছেন। কিন্তু তঁারা যদি বিএনপিকে নিয়ে একটু কম মাথা ঘামিয়ে নিজ দলের দিকে দৃষ্টি দিতেন, তাহলে উপলব্ধি করতেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থা কত শোচনীয়। অন্তঃকলহে দলের সাংগঠনিক শক্তিই শুধু দুর্বল হচ্ছে না, ঘরে ঘরে ‘গৃহবিবাদ’ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক জেলা, উপজেলা কমিটি অকার্যকর। মন্ত্রী বনাম সাংসদ, সাংসদ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম ভাইস চেয়ারম্যান বিরোধ চরমে। আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল কী পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার কিছু নমুনা পাওয়া গেল ৩০ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশিত খবরে। এতে বলা হয়,
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অন্তত ১৭ জন নেতা-কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে উপজেলা নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় দুজন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১২ জন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে দুজন, গাছ কাটা নিয়ে একজন নিহত হয়েছেন। পদ-পদবি, আধিপত্য ধরে রাখা, ব্যবসা-বাণিজ্য, টেন্ডার ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় এসব খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিরোধী দল সক্রিয় না থাকায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে দলটির মধ্যে খুনোখুনি ও কোন্দল বাড়ছে। (৩০ মে ২০১৯ বাংলাদেশ প্রতিদিন)
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেছেন, দলের নেতা-কর্মীরা যে সংঘাত-সংঘর্ষে মারা যাচ্ছেন, তার কারণ রাজনৈতিক নয়, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।
তাহলে কি আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হলো? যে দল দেশ পরিচালনা করছে, সেই দলের নেতা-কর্মীরা সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে খুনোখুনিতে মত্ত হলে সাধারণ মানুষের বিচলিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আওয়ামী লীগের নেতারা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়াও কিন্তু একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়।
এক দিন পর যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, তাঁর ও যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ চাঁদাবাজি করেন, তাহলে যেন তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর অর্থ তাঁর ও সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে। গত ২৩ এপ্রিল যুগান্তর খবর দিয়েছে, কোটি টাকা চাঁদাবাজি মামলায় ফতুল্লায় যুবলীগ নেতা নজরুল গ্রেপ্তার। নারায়ণগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
আওয়ামী লীগের অপর সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ বলতে গেলে প্রতিদিনই পত্রিকায় শিরোনাম হচ্ছে। তবে ভালো কাজের জন্য নয়। কখনো পদ–পদবি নিয়ে মারামারির কারণে। কখনো ডাকসুর সভাপতি ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হকের ওপর চড়াও হয়ে। এই ক্ষীণ স্বাস্থ্যের তরুণটি যে কতবার ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়েছেন, তার হিসাব নেই। কয়েক দিন আগে ছাত্রলীগ কর্মীরা বগুড়ায় তাঁকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁকে ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেননি। কক্ষ তালাবদ্ধ করে রেখেছেন। বিদেশ থেকে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিএনপিকে ইফতার অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনীতি করতে না বলেছেন। তিনি বিএনপিকে উপদেশ দেওয়ার আগে যদি ছাত্রলীগকে উপদেশ দিতেন, তাহলে নুরুল হককে এভাবে মার খেতে হয় না।
৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ তাৎক্ষণিকভাবে লাভবান হলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে যে অবক্ষয় তৈরি হলো, তা অদূর ভবিষ্যৎ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আর এ ক্ষেত্রে দল বা সংগঠনের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাজনীতি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতি হলো নিয়ামক শক্তি। কিন্তু এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে নানা শক্তি দ্বারা।
নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর বিএনপির মধ্যে হতাশা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। তদুপরি দলটির প্রধান কারাগারে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটির ভেতরেও যে অন্য ধরনের হতাশা ও দিগ্ভ্রান্ত অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা টের পেতে শুরু করেছেন। ব্যক্তিগত কিংবা ঘরোয়া আলাপে অনেকে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেনও। কিন্তু উচ্চকণ্ঠে কিছু বলতে পারছেন না। এই বলতে না পারাই ৭০ বছর বয়সী আওয়ামী লীগের বড় ব্যর্থতা বলে মনে করি। ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের কমিটির মধ্যে ৯৯ জন না ১৯ জন বিতর্কিত, তা নিয়ে ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত ও পদাধিকারীরা বিতর্কে লিপ্ত। সেটি তঁাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত ১২৫ জনের মধ্যে যখন তথ্য–প্রমাণসহ ছাত্রলীগের ২১ জন নেতা-কর্মীর নাম আসে, তখন আর আত্মপক্ষ সমর্থন বা সাফাই গাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।
নির্বাচনে বিধ্বস্ত বিএনপি ভালো নেই। কিন্তু নির্বাচনে বিপুল ভোট জয়ী আওয়ামী লীগ কতটা ভালো আছে?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com