রাজনীতি

বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে

১ সেপ্টেম্বর বিএনপি ৪০ বছর পূর্ণ করল। এই চার দশকে বিএনপি এমন কঠিন অবস্থায় আর পড়েনি। দলটি ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে একনাগাড়ে এত দীর্ঘ সময় বিএনপি ক্ষমতার বাইরে ছিল না। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে। দলের ‘বিকল্প নেতা’ তারেক রহমান দেশান্তরিত হয়ে লন্ডনে। সরকারের ভাষ্যমতে, তারেক একজন ফেরার আসামি। বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে হাজার হাজার মামলা ঝুলছে। অনেকেই দৌড়ের ওপর আছেন। এরই মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কড়া নাড়ছে। বিএনপির দাবি ছিল এবং এখনো আছে নির্দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। নির্বাচনের আগে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে। দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক সব মামলা তুলে নিতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের হাবভাবে মনে হচ্ছে তাঁরা তাঁদের অবস্থান থেকে একচুলও নড়বেন না।

সে ক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? তারা কি আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করতে পারবে? কিংবা দাবি পূরণ না হলে ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বর্জনের ডাক দেবে? নির্বাচন বর্জন বা প্রতিরোধ গণতন্ত্রের ভাষা নয়। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ অনেকগুলো দল নির্বাচন বর্জন করেছিল। এমনকি বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। এবার পারবেন তার নিশ্চয়তা কী। ১৫৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আইনের দৃষ্টিতে অশুদ্ধ নয়। বরং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের যেকোনো সরকারের চেয়ে কম বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। সংসদের ভেতরে-বাইরে কোথাও তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি। এর অন্যতম কারণ ২০১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন। বিএনপি নির্বাচনে গেলে রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক পরিবেশের এখন যতটা অবনতি ঘটেছে, তা ঘটত না। আওয়ামী লীগের ২০০৯-১৩ এবং ২০১৪-২০১৮-এর সরকারের আচরণগত পার্থক্যটি খেয়াল করুন। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে শুধু দল হিসেবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গণতন্ত্র, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি সংবাদমাধ্যমের ওপর এখন যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তারও অন্যতম কারণ সংসদের ভেতরে-বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তঁাদের দলকে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। তাঁর ভাষায়, ‘ইতিপূর্বে যতগুলো ক্রাইসিস হয়েছে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু, পরবর্তীকালে ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যাওয়া। পরবর্তীকালে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসা। ওয়ান-ইলেভেনের মধ্যে আবার গ্রেপ্তার হওয়া। তারপরও আজকে এই সংকটটা আমার কাছে মনে হয় আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট।’

প্রশ্ন হলো বিএনপি সেই সংকট উত্তরণে কোন পথ বেছে নেবে? আওয়ামী লীগ যে বিএনপির বিরুদ্ধে দু-দুবার সর্বাত্মক আন্দোলনে জয়ী হয়েছে, তার প্রধান কারণ সরকারের বাইরের সব দলকে একত্র করতে পেরেছিল। ২০১৪ সালে বিএনপি সেটি পারেনি বলেই আওয়ামী লীগ তার শর্তে নির্বাচন করে নিতে পেরেছে। তবে বিএনপিকে এ–ও মনে করিয়ে দিতে চাই যে ২০০৬ সালে মহাঐক্যজোটের (বর্তমান ১৪ দল ছাড়াও যার শরিক ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি, বি চৌধুরীর বিকল্পধারা, কামাল হোসেনের গণফোরাম) আন্দোলনের পরও আওয়ামী লীগ ২০০৭ সালের নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। এমনকি মহাজোটের নেতারা মনোনয়নপত্রও দাখিল করেছিলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের গোঁয়ার্তুমির জন্যই ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচনটি হয়নি। তার আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছিলেন। সেটি ছিল ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু ২০১৪ সালে বিএনপির কর্মকাণ্ডে মনে হয়নি তারা সরকারের কাছ থেকে যতটুকু ছাড় পাওয়া সম্ভব, সেটুকু নিয়ে নির্বাচনে যেতে ইচ্ছুক ছিল। বরং তারা নির্বাচন প্রতিরোধ করতে গিয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিরোধ করার পথ সুগম করেছে।

বিএনপি তাদের নেতা-কর্মীদের ওপর মামলা-হামলার যেসব অভিযোগ করেছে, তা অসত্য নয়। পুরোনো মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে। অচিরেই কারাবন্দী খালেদা জিয়ার ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনাও কম।

এরই মধ্যে নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন একটি মেরুকরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, বি চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে বিএনপি নেতারা তাঁকে স্বাগত জানান। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের সমাবেশে বিএনপি নেতারা গিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এই প্রকাশ্য কার্যক্রমের বাইরেও নানা তৎপরতা চলছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে বিএনপি নেতারা কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন। তাঁরা বলছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাঁরা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করুক। কিন্তু বিএনপি যদি নির্বাচনেই না যায়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নটিও অবান্তর হয়ে যায়।

মহাজোটের বিপরীতে বিএনপি যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে, তার প্রধান বাধা জামায়াতে ইসলামী। যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যের নেতারাও বলেছেন, জামায়াতকে নিয়ে তাঁরা কোনো ঐক্যে যাবেন না। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকায় দল হিসেবে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু দলের নেতা-কর্মীরা তো আছেন। এরশাদবিরোধী তিন জোটের আন্দোলনেও জামায়াত ছিল, তারা যুগপৎ কর্মসূচি পালন করত। এবারও জামায়াত হয়তো সেই কৌশল নেবে।

বিএনপিকে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে কিংবা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাব না, সে রকম অনড় অবস্থান দলকে নতুন করে ঝুঁকিতে ফেলবে। মনে রাখতে হবে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্যের নেতারা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মাঠে নামবেন না। সেটি বিএনপির দলীয় দাবি হতে পারে।

গত জুন মাসে বিএনপির তিনজন প্রভাবশালী নেতা ভারতের রাজনৈতিক নেতা ও থিংক ট্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা ভারতীয়দের এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে বিএনপি ভারতবিরোধী দল নয়। ‘অতীতে যা-ই হোক না কেন’ আমরা ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যাতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, সে বিষয়ে প্রতিবেশী এই বড় দেশটি ভূমিকা রাখতে পারে। বিএনপি নেতারা বুঝে গেছেন যে আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়, ভারতই বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতের গণমাধ্যম ও সাবেক কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তার সবটা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায় না। অতএব, দিল্লিতে বিএনপির ‘ধরনা’ পুরোপুরি নিষ্ফল হয়েছে বলা যাবে না।

এ অবস্থায় বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার কোনো বিকল্প আছে বলে মনে করি না। নির্বাচন শুধু ভোটের লড়াই নয়, কৌশলেরও লড়াই। কৌশলের লড়াইয়ে জয়ী হতে না পারলে ভোটের লড়াইয়েও জেতা যায় না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যতই জনপ্রিয় দল হোক না কেন, নব্বইয়ের পর কোনো দল এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ভবিষ্যতে পারবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। যে দল জোটের পরিধি যত বাড়াতে পারবে, নির্দলীয় ভোটার টানতে পারবে, তারই জয়ের সম্ভাবনা বেশি।

বিএনপিকে বুঝতে হবে ২০১৪-এর বাস্তবতা এখন আর নেই। সেবার বিএনপি সংসদে ছিল। আওয়ামী লীগ জাতিসংঘ দূতের মধ্যস্থতায় হলেও বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছিল। কিন্তু এবার তারা কোনো রকম আলোচনায়ও রাজি নয়। বিএনপি নেতারা বলে থাকেন, সরকার ২০১৪ সালের মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন করতে চায়। তারা যদি মনে করে, সেটাই ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য তাহলে বিএনপির উচিত হবে প্রবল প্রতিকূল পরিবেশেও নির্বাচনে অংশ নেওয়া। এমনকি তাঁরা যদি মনে করেন আন্দোলন করেই খালেদা জিয়াকে ছাড়িয়ে নিতে হবে, সে ক্ষেত্রেও তাদের নির্বাচনে যেতে হবে।

বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার হাজারটা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু যাওয়ার একটিই যুক্তি এবং তা হলো ‘মুমূর্ষু’ গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com