আজ–কাল–পরশু

বিএনপি কি বদলাবে, না আরও পস্তাবে?

.

আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ও বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশনে কোনো তুলনা হতে পারে না। তবু দুটিই দেশের বড় দল, তাই নানা প্রসঙ্গে তুলনা আসবেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন দল এবং বর্তমানে সরকারের নানা সাফল্য দলটিকে উজ্জীবিত করে রেখেছে। কাউন্সিল অধিবেশনে পরোক্ষভাবে সেটা উদ্‌যাপনও করা হলো। দলটির নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি তাঁর নেতৃত্বের নানা চমক দেখাতে পেরেছেন। কাউন্সিল অধিবেশনে সেটারও উদ্‌যাপন করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার যে আজ বিএনপিকে মামলা–হামলার মাধ্যমে কাবু করে ফেলেছে, এটা আওয়ামী লীগের একধরনের বিজয়। কারণ, মামলা করার মতো সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বিএনপি। বিএনপির আন্দোলনের সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলে-বাসে পেট্রলবোমা–সন্ত্রাস কারা করেছিল, তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। একদিন প্রমাণিত হবে। তবে যারাই করুক, তার দায়ভার বিএনপিকেই নিতে হচ্ছে। মামলাও হয়েছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে। এই পেট্রলবোমা–সন্ত্রাস ব্যবহার করে সরকার আরও বহু মামলা দিতে পারবে। সেই মামলা চলবে হয়তো আগামী নির্বাচন পর্যন্ত।
রাজনীতি তো কৌশলেরই খেলা। বিএনপি তার দুর্বল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, দেশি-প্রবাসী যৌথ দুর্বল নেতৃত্ব, সিদ্ধান্তহীনতা, বহু রকম ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল নীতি, অতীতে পারিবারিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে প্রশ্রয় দান ইত্যাদি নানা কারণে আজ একটি দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে। অথচ তার বিরাট জনসমর্থন ছিল। জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল। খালেদা জিয়ারও জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু দল হিসেবে বিএনপি এর সুফল নিতে পারেনি।

বিএনপির অনেকে বলে থাকেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের রাজনীতি করতে দিচ্ছে না। রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না। মিটিং করতে দিচ্ছে না। নেতাদের গ্রেপ্তার করছে। মামলা দিয়েছে ইত্যাদি। এগুলো সবই সত্য। কিন্তু বাংলাদেশে এর নামই রাজনীতি। সামরিকতন্ত্র, স্বৈরাচার, নির্বাচিত স্বৈরাচার এ দেশে কি আগে হয়নি? এর আগে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এরশাদ কি এ রকম দমননীতি চালাননি? এভাবেই তো এ দেশের রাজনীতি হয়েছে। আরও অতীতে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের ছয় দফার আন্দোলন কি দমননীতির মধ্যে পরিচালিত হয়নি? শেখ মুজিবসহ শত শত আওয়ামী লীগ নেতাকে কি গ্রেপ্তার করা হয়নি? সেই দমন নীতির মধ্যেও ছয় দফার আন্দোলন এগিয়ে গেছে। ছয় দফাকে ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তার ফল পেয়েছে ৭০-এর নির্বাচনে।

তবে ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার অন্তত ১০০ জন লড়াকু নেতা, জীবন বাজি রেখে যাঁরা রাজপথে ছিলেন, ছিল ছাত্রলীগের মতো সংগ্রামী ছাত্রসংগঠন, যারা রাজপথ প্রকম্পিত করে রেখেছিল, ছিল ইত্তেফাক-এর মতো জনপ্রিয় পত্রিকা, ছিল তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ক্ষুরধার কলাম ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’। আইয়ুব সরকারের শত দমন নীতি, গ্রেপ্তার, নির্যাতনও আওয়ামী লীগ ও ছয় দফার আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। এরই নাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সরকারের দমন নীতি ও নির্যাতনের দোহাই দিয়ে বর্তমানে বিএনপির নেতারা যেভাবে ঢাকার দুটি অফিসে অবস্থান নিয়েছেন, তাতে তাঁদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায়।

দেশের রাজনীতির এই পটভূমিতে বিএনপিকে তার করণীয় সম্পর্কে ভাবতে হবে। বিএনপির বর্তমান হালহকিকত দেখে মনে হয়, বিএনপি এই লড়াইয়ের জন্য নিজেদের এখনো তৈরি করতে পারেনি। তারা এখনো একটি পাকাপোক্ত কেন্দ্রীয় কমিটিই (সব শাখার) তৈরি করতে পারেনি। লড়াই তো পরের কথা। তাদের ছাত্রদল ও যুবদলের রাজপথে কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের অস্তিত্ব কমিটিতেই সীমাবদ্ধ। ঢাকা নগর কমিটি (যাদের ওপর আন্দোলন অনেকটা নির্ভর করে) নানা গ্রুপিংয়ে বিভক্ত। দলের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। দুই অফিসে বসে প্রেস ব্রিফিংয়ের মধ্যে দলের কর্মসূচি সীমাবদ্ধ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না বিএনপি আগামী মৌসুমে খেলতে চায়। বিএনপি দলটির মধ্যে অনেক সমস্যা। ১. দলের মধ্যে বলিষ্ঠ ও একক নেতৃত্ব নেই। ঢাকা-লন্ডন সব সময় এক নীতিতে চলে বলে মনে হয় না। দ্বিমুখী নেতৃত্বের কবলে পড়ে দলটি প্রায় সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্রমেই ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ২. রাজপথে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ৫০ জন লড়াকু নেতাকেও পাওয়া যায় না। ৩. কেন্দ্রের অনেক নেতা নানা কারণে নিষ্ক্রিয়। অনেকে বয়সের ভারে ক্লান্ত। ৪. কেন্দ্রের অনেক নেতা পরস্পরকে ‘সরকারের এজেন্ট’ বলে সন্দেহ করেন। খোদ খালেদা জিয়ার পাশেই এ রকম এজেন্ট বসে রয়েছেন বলে অনেক নেতার সন্দেহ। ৫. মহাসচিবকে কেন্দ্রের সব নেতা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। দলের মধ্যে সমান্তরাল নেতৃত্ব দেখা যায়। খালেদা জিয়া তা প্রশ্রয়ও দেন। ৬. ছাত্রদল ও যুবদলের নেতৃত্ব এখন আর আন্দোলনের উপযুক্ত নয়। বেশির ভাগ ছাত্র ও যুব নেতাই এখন নিষ্ক্রিয় বা আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত। অনেকে গ্রেপ্তার ও মামলার আতঙ্কে ভীত। ৭. ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

এই সংকটের তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। এত সংকটের মুখোমুখি হয়ে একটি বিরোধী দল রাজনীতি করবে কীভাবে?

আগামী সংসদ নির্বাচন বিএনপি কীভাবে মোকাবিলা করবে সেটাও একটা বড় সংকট বিএনপির জন্য। কারণ, অনেকেরই ধারণা, বর্তমান সরকার এমন ‘নির্বাচন কমিশন’ করবে না, যে কমিশন সরকারের পরিকল্পনার বাইরে যাবে। পুলিশ, র‍্যাব বা সরকারি প্রশাসনও আগের নির্বাচনের মতোই সরকারি দলকে সহযোগিতা করবে বলে মনে হয়। আগামী সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগ নিজের নিয়ন্ত্রণ থেকে কোনোভাবেই ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। বিগত সংসদ নির্বাচন, তিন মেয়র ও অন্যান্য নির্বাচনের মতোই আগামী সংসদ নির্বাচন হবে, এটাই অনেকের ধারণা।

এ রকম পরিস্থিতি হলে (এটা আমাদের আশঙ্কা, এ রকম না-ও হতে পারে।) বিএনপি কী করবে? প্রায় সবার ধারণা, দলের বৃহত্তর স্বার্থে দলকে এবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হবে এবং তা দলীয় সরকারের অধীনেই। নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি বিরাট সংকটে পড়তে পারে। তাই সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে অংশ নিতে হবে।

বিএনপির মতো বড় দলের একটা বড় দুর্বলতা হলো জোড়াতালি দিয়ে দল পরিচালনা করা। জোড়াতালি দিয়ে আর যা-ই হোক, রাজনীতি হয় না। রাজনীতির সুস্পষ্ট আদর্শ, লক্ষ্য, কর্মসূচি, শত্রু, মিত্র চিহ্নিত থাকতে হবে। এসব ব্যাপারে কোনো জোড়াতালি চলে না। জোড়াতালির রাজনীতি করতে গিয়ে বিএনপির আজ এই দুরবস্থা। বিএনপির গণতন্ত্রমনা নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই দলকে ঢেলে সাজানো উচিত।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিরোধী, দুর্নীতিবাজ, অতীতে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, বিএনপির বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের হোতা (ভুল সিদ্ধান্তের একটা তালিকা হওয়া দরকার) উপদলীয় কোন্দল ও গ্রুপিংয়ে সক্রিয়, এ ধরনের ব্যক্তিদের দল থেকে বাদ দিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন বিএনপি গড়ে তোলার এখনই সময়। জোড়াতালি দিয়ে দল পরিচালনা করলে আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে বারবার পরাজিত হতে হবে। রাজনীতি এখন আগের মতো নেই। প্রক্সি ও প্রম্পট করে রাজনৈতিক দল পরিচালনা করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন ডিজিটাল রাজনীতির যুগ। বিএনপি কি নিজেদের বদলাবে, নাকি আরও পস্তাবে? দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মতো আরও একটি শাক্তিশালী দল দরকার।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।