ঢাকায় একটি খবর বাতাসে উড়ছে। বিএনপি শেষ পর্যন্ত আর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতি করবে না। এ বিষয়ে বিএনপির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সূত্র উল্লেখ করে ঢাকার একটি সংবাদপত্র এ বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। ওই সংবাদে সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ সদস্যই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের জন্য মত দিয়েছেন। এখন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এর আগেও অনেকবার জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কচ্ছেদের সংবাদ শোনা গিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গেই জোটের রাজনীতি করেছে। এবারও বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে না বলে অনেকেই মনে করছেন। আবার জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের জন্য অনেক দিন ধরেই ভেতর ও বাইরে থেকে বিএনপির ওপর চাপ রয়েছে। বিশেষ করে তৃণমূলে দলটির নেতা-কর্মীদের অনেকেই জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে রাজনীতি করার জন্য শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে জামায়াতের বিরোধিতার প্রশ্নে বিএনপির পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির কেবলই নির্বাচনী জোট। ভোটের রাজনীতিতে মাথায় রেখেই এ জোট করা হয়েছে।
জামায়াতে সঙ্গে বিএনপির জোট গড়ার পর বুড়িগঙ্গায় অনেক জল বয়ে গিয়েছে। এ সময়ে দেশ থেকে অনেক মানুষ হারিয়ে গিয়েছেন, যাঁরা আর ফিরে আসেননি। এদিকে করোনায় জেরবার অবস্থা, ওদিকে ধেয়ে আসছে বন্যা। করোনার ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। এখন বন্যার ত্রাণ কী হয়, তা দেখার অপেক্ষা। অন্যান্য কার্যক্রমের মতো স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও নেই তেমন একটা। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে বিএনপির জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের বিষয়টি আলোচনা এল বেশ হুট করেই।
রাজনৈতিক অঙ্গনের অনাকাঙ্ক্ষিত এই অবকাশ বিএনপিকে বিভিন্ন বিষয় পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ করে দিয়েছে। এই পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় জোটের রাজনীতিও দলটি বিভিন্নভাবে বিবেচনা করতে পারে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যখন ভোটের জোট গড়ে উঠেছিল, তখন দেশে ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক ধরনের ছিল। এখন পরিস্থিতি পুরোপুরিই ভিন্ন। একটি কথা বলা হয় বিএনপি সম্পর্কে, দলটি যুক্তরাষ্ট্রের ৯/১১-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি। যে কারণে দেশে ও দেশের বাইরে নানাবিধ সংকটের মুখে পড়তে হয় দলটিকে। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে বা সম্পর্কে ঘাটতি নেমেছে। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী নিয়ে নানাবিধ চাপের মধ্যে আছে বিএনপি। জোট গড়ে ওঠার সময় এক ধরনের ভোটের হিসাব ছিল। ওই সময় জামায়াতের সঙ্গে জোট গড়া বিএনপির জন্য লাভজনক হলেও এখন ভোটের হিসাবও বদলে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজা হয়েছে। এ অবস্থায় জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থানের দায় অনেকটা বিএনপিকেও বহন করতে হচ্ছে। ভোটের জোট বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সবকিছু শুধু ভোটের রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। জোট হিসাবেও কিছু দায়দায়িত্ব থেকে যায়। তাই হতে পারে, বর্তমান ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শুরুর দিকে ভোটের রাজনীতিতে জোটের হিসাব ভিন্নমাত্রা যোগ করেছিল। এখন দেশে নির্বাচন অর্থহীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভোটের আগেই ফল নির্ধারণ হয়ে যায়। দেশে যেহেতু স্বাভাবিক ভোট প্রয়োগের কোনো অবস্থা নেই, তাই জোটের রাজনীতিও কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। তাই জোটের রাজনীতির দিকে মনোযোগ খুব বেশি না দিয়ে এখন দলকে সংগঠিত করার দিকেই বিএনপির ভাবনা স্থির করা প্রয়োজন। বিএনপি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। বিএনপিকে ভবিষ্যৎ জোট ও ভোটের রাজনীতি হিসাব মাথায় রেখে সবকিছু শুরু করতে হবে। দীর্ঘদিন বিএনপি ক্ষমতায় নেই। এই ক্ষমতায় না থাকাকে বিএনপি সুযোগ হিসাবে নিতে পারে। সরকারে গেলে কখনোই দল গোছানো হয় না। তখন ক্ষমতার নানা হিসাব-নিকাশ থাকে। বিএনপির উচিত সবকিছু পরিষ্কার করে নতুন দিনের রাজনীতি শুরু করা।
দল গোছানোটা শুরু হওয়া উচিত তৃণমূল থেকে। করতে হবে নতুন কিছু। দলের কর্মীদের তালিকা তৈরি, সম্ভব হলে সবাইকে দলীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে পারে। প্রতিটি পর্যায়ে কর্মীদের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে পারে। এ রকম কিছু করতে পারলেই দলের সাংগঠনিক দক্ষতা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বিএনপির বিশাল জনসমর্থন ও ভোটার গোষ্ঠী রয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপির পক্ষে এখন জোরালো অবস্থান নেওয়া সম্ভব না। নেতাদের খুশি রাখলেই যেহেতু পদ-পদবি মিলে যায়, তাহলে আর সাংগঠনিক কাজকর্ম করে লাভ কী—নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ ধরনের মনোভাব জেঁকে বসাই স্বাভাবিক। রাজনীতির ‘ভাই’ সংস্কৃতি থেকে দলটিকে বের হয়ে আসতে হবে। কর্মীদের এমনভাবে ক্ষমতায়ন করা উচিত যাতে কর্মীরা ভাবতে শুরু করেন, আমার সিদ্ধান্ত ও মতে দল পরিচালিত হয়।
সবচেয়ে বড় কথা বিএনপির রাজনীতির দর্শন কী, এটা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একটি দর্শন থাকে। বিএনপিরও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এটা বিএনপি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে বিএনপির বুদ্ধিজীবীরা ব্যর্থ হয়েছেন। আওয়ামী লীগ, বামপন্থী, ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলতে পারবেন। কিন্তু বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বলতে পারবেন বলে মনে হয় না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপির এককভাবে পথচলার প্রস্তুতি শুরু করা উচিত বলে মনে হয়। বিএনপির সেই শক্তি ও সামর্থ্য আছে। দরকার এই শক্তি ও সামর্থ্যকে বাস্তবে প্রয়োগ করা। বিএনপি জামায়াতনির্ভর দলে পরিণত হয়েছে—এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে বিএনপিকে। নিজেদের নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করতে হবে। জোটের রাজনীতি থাকবে। জোট থেকে অনেকেই বেরিয়ে যাবে। নতুন করে যুক্ত হবে। কিন্তু জোটের রাজনীতি মানেই সবকিছু জলাঞ্জলি দেওয়া না।
ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।