রাজনীতিতে একটা চালাকি খুব পুরোনো। সেটা হচ্ছে কারও বক্তব্যের উত্তর না দিয়ে উল্টো বক্তার নামে কুৎসা রটানো এবং এভাবে তাঁর বক্তব্য থেকে আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলা। এ দেশেও এই চালাকি আছে। কোনো অভিযোগ বা সমালোচনাকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হয় বক্তা কার লোক, তাঁর উদ্দেশ্য কী, তিনি অতীতে কী করেছেন—এসব বিষয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যত দিন দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ও ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল, তত দিন এসব করে খুব একটা লাভ হয়নি। তবে এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
এখন ক্ষমতাসীনেরা ব্যক্তিগত আক্রমণকে নিয়ে গেছেন প্রায় শিল্পের পর্যায়ে। বক্তব্যকে অনুল্লেখ করে আলোচনা, বিতর্ক কেন্দ্রীভূত তো করতে পেরেছেন বক্তার চরিত্র, সঙ্গ ও দলসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে। তার একটি সর্বশেষ প্রকাশ আমরা দেখলাম রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ জন নাগরিকের একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে। চিঠিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন অনিয়ম–দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কিছু প্রামাণ্য অভিযোগ করা হয়েছিল এবং নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার আবেদন জানানো হয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এই নাগরিক উদ্যোগের সংবাদ সংগত কারণে গণমাধ্যম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছিল। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের কেউ কেউ এ বিষয়ে সংযতভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এমনও বলেছেন যে এ বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে, এটি রাষ্ট্রপতির বিষয়। কিন্তু এ বিষয়ে লক্ষণীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তাঁরা চিঠির বক্তব্যের উত্তর না দিয়ে যাঁরা এ চিঠি লিখেছেন, তাঁদের আক্রমণ করা শুরু করেছেন। তাঁদের কথা হচ্ছে, চিঠিটি যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা বিএনপির দালাল বা দোসর। ভদ্র ভাষায় বললে তাঁরা বিএনপির লোক। ৪২ জন ব্যক্তি চিঠিটি লিখেছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে। চিঠির বক্তব্য নিয়ে নয়, তাঁদের আলোচনাটি হচ্ছে চিঠির লেখকেরা বিএনপির কি না, তা নিয়ে।
অথচ এই ৪২ জনের কেউ বিএনপির সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত নন। বরং এঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁদের অতীত দায়িত্বশীল ভূমিকার সুফল পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। যেমন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধকতার প্রতিবাদে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে আকবর আলি খান ও সুলতানা কামালের পদত্যাগ এবং পরবর্তী পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের জয়লাভ।
চাইলে এই তালিকা অনেক দীর্ঘ করা যায়। কিন্তু তার প্রয়োজন নেই। আমার বরং প্রশ্ন: ৪২ জনের এমনকি সবাইও যদি বিএনপির লোক হতেন, তাতে সমস্যা কী? এতে বক্তব্যটি গুরুত্বহীন হয়ে যেত কেন? এ দেশে বিশিষ্ট নাগরিকদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপিপন্থী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তাঁরাও যদি কোনো বিষয়ে বক্তব্য দেন, তাতে সমস্যা কী? এ দেশের কোন আইন বা রীতিতে আছে যে এতে তাঁদের বক্তব্যের গুরুত্ব কমে যাবে?
বক্তব্যের গুরুত্বকে দেখতে হবে বক্তব্যের সারবত্তা দিয়ে, বক্তব্যটা কে দিয়েছেন, তা এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে যখন মানুষ ছুটে আসে সাহায্য করার জন্য, আমরা জনে জনে জিজ্ঞেস করি না ভাই, আপনি কোন দলের লোক। কাউকে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে ভালো কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত করি না। নির্বাচনব্যবস্থায় আগুন লাগা এর চেয়ে অনেক বড় সংকট। সেটা নিয়ে কেউ উদ্বিগ্ন হলে বা সেটা মেরামতের চেষ্টা হলে তাতে যেকোনো অংশগ্রহণকে স্বাগত জানানো উচিত। চেষ্টাটা কে করছেন, এ নিয়ে শোরগোল তুলে চেষ্টাকে নাকচ করা উচিত নয়।
অতীতে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি একটিমাত্র আসনে উপনির্বাচনে (মাগুরা নির্বাচন) ভয়াবহ কারচুপি করার পর আওয়ামী লীগ, বাম দল, এরশাদের দল আর জামায়াতে ইসলামী মিলে একসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছে। দেশের বহু বিশিষ্ট নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে একমত হয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্যকে কি তাঁরা কোন দলের লোক, এটি বলে খারিজ করাটা সংগত হতো? হতো না।
এখন যে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ৪২ জন নাগরিক উদ্বিগ্ন হয়েছেন, তার সংকট আরও গভীর, আরও অনেক ব্যাপক। এই উদ্বেগ একটি আসনে নির্বাচন নিয়ে নয়, গোটা নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ৬৬ শতাংশ আসনে আগের রাতে ভোট হয়েছে এবং ৬০ শতাংশ আসনে বুথ দখল করে একচেটিয়া ভোট প্রদান হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনে দুই শতাধিক কেন্দ্রে ভোট পড়েছে পুরো শতভাগ, প্রায় ছয় শ কেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের প্রতিটিই পেয়েছেন একজনমাত্র প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত ফলাফলের সঙ্গে কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষিত ফলাফলের গুরুতর গরমিল রয়েছে বহু কেন্দ্রে। এমন একটি নির্বাচনে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে অনিচ্ছুক হলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার সবার আছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব অভিযোগ, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার অধিকার রয়েছে যে কারও।
২.
আমাদের সংবিধানের অন্যতম বিধান হচ্ছে জনগণের অবাধ ভোটাধিকার ও জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা। এসব বিধানের প্রতি এখন মানুষের আস্থা কতটা নিচে নেমেছে, তার প্রমাণ নির্বাচনে অংশ নিতে মানুষের অনীহা। ভোটের প্রচারণা শুধু একটি দল করতে পারছে দেখলে, ভোট দিতে গিয়ে আক্রান্ত হলে বা তা ইতিমধ্যে দেওয়া হয়ে গেছে জানলে, ভোটের হিসাবে শতভাগই একজন পেয়েছে জানলে সেই ভোটে মানুষের আগ্রহ থাকে না। সেটি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে বহু কেন্দ্র জনশূন্য পড়ে আছে, এসব ছবি এখন আমরা দেখি বাংলাদেশে। যে দেশে স্কুলের গভর্নিং বডির নির্বাচনে ভোটারের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে জাতীয় নির্বাচনে এমন অবস্থা কল্পনা করা যায়?
আমাদের সংবিধানে আছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধানের কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকদের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে (বা তাতে সহযোগিতা করলে) তা রাষ্ট্রদ্রোহ। এসব অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির কথাও সংবিধানে বলা আছে। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে (যেমন প্রার্থী, এজেন্ট, ভোটারদের ওপর হামলা) বা অসাংবিধানিকভাবে (যেমন আগের রাতে ভোট) নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসহীন (যার প্রকাশ ঘটে ভোটের হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে) করা ৭ক–এর অধীনের রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধতুল্য কি না, বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের এমনকি এই বক্তব্য পেশ করার অধিকারও আছে।
মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এসব প্রশ্ন তোলা অসংগত নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি অন্তত তা–ই মনে করি।
আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক