বিএনপির ‘আত্মহনন’ নিয়ে আওয়ামী লীগ এত বিচলিত কেন?

দেশে যখন ভোজ্যতেলের সংকট চলছে, বঙ্গোপসাগরের অশনি দেশবাসীকে মহা অশনিসংকেত দিচ্ছে, তখন আওয়ামী লীগের নেতারা সেসব নিয়ে কথা না বলে কীভাবে বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষা নিয়ে নিদ্রা হারাম করে চলেছেন। একজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা বিএনপির মঙ্গল চাই। কিন্তু বিএনপির নেতারা চান আত্মহনন।’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি এই সহমর্মিতা প্রকাশের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আছে বলে আমাদের জানা নেই।

হত্যার মতো আত্মহননও অপরাধ। আওয়ামী লীগ নেতারা, সরকারের মন্ত্রীরা যদি বিএনপির নেতাদের এই আত্মহনন থেকে ফিরিয়ে আনেন, সেটি খুবই পুণ্যের কাজ হবে। বাংলাদেশে সব সরকারি দলই বিরোধী দলকে আত্মহনন থেকে, সন্ত্রাস ও অশান্তি থেকে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে সদা সচেষ্ট থাকে। আর এই শান্তি প্রক্রিয়ায় তারা দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও নিয়োজিত করে থাকে। আগে কাজটি হতো লুকিয়ে-ছাপিয়ে, এখন প্রকাশ্যে। সরকার বিরোধী দলের নেতাদের হক-নাহক মামলা দিয়ে যে জেলে পাঠায়, তারও ইতিবাচক দিক অস্বীকার করা যায় না। বাইরে আন্দোলন করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। জেলখানায় কিছুদিন বিশ্রাম নিতে পারবেন। আর জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর এই নেতারা নিজেদের কারা নির্যাতিত বলে বাড়তি সম্মান-শ্রদ্ধাও আদায় করতে পারবেন।

আমাদের ধারণা, সরকারি দলের এই উপদেশ আমলে নিয়েই বিএনপি ১২ ও ১৪ মে দুই দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অঙ্গসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভা শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি অবশ্য কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতাদের সদুপদেশ কিংবা উদ্বেগের কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘গত কদিন সারা দেশে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের থেকে শুরু করে অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে একটা সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছে। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ওপর হামলা ও তাঁর বাসভবনে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের আক্রমণ এবং পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। একই সঙ্গে কুমিল্লার চান্দিনায় এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের গাড়িতে হামলা ও তাঁকে গ্রেপ্তার, ফেনীতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক জয়নাল আবেদীনের ওপর হামলা, পটুয়াখালীর সদস্যসচিব শিতাংশু সরকারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়াসহ সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ, পটুয়াখালীর নেতাদের ওপর হামলা করেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।’

দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতার হাতবদল হয়নি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন তারা করতে পারেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক শাসককে হটিয়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেছে। আবার আদালতের দোহাই দিয়ে সেই সরকারব্যবস্থা বাতিলও করেছে। কিন্তু নির্বাচনী সংকট থেকে দেশ মুক্ত হয়নি। এখন আওয়ামী লীগের নেতারা যে বিএনপির আত্মহনন ও অস্তিত্ব নিয়ে বিচলিত বোধ করছেন, তারও মূলে ওই নির্বাচন।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও দলের প্রধান শেখ হাসিনা বিএনপিসহ সব বিরোধী দলকে নিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। কমিটির বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির সভা-সমাবেশে এখন থেকে বাধা দেওয়া হবে না। তারা নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালন করতে পারবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, সংবিধানের অধীনে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হবে।

কিন্তু মন্ত্রী-নেতাদের কথার সঙ্গে তৃণমূল স্তরের রাজনীতির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, বিএনপি নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করতে পারবে। আর ঈদের সময় বিএনপির নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গেলে স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাধা দিয়েছেন। কোথাও প্রতিরোধ করার ডাক দিয়েছেন। বিরোধী দল কোথাও সভা আহ্বান করলে সরকারি দলও একই স্থানে একই সময়ে সভা ডেকে থাকে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সভা-সমাবেশমুক্ত রাখার দাবি করেছিলেন পরিবেশবিদেরা। আমাদের সরকার সেই দাবি আংশিক মান্য করেছেন। বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হয় না। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ আরও অনেক দল সমাবেশ করতে চাইলে সহজেই পেয়ে যায়। আওয়ামী লীগ নেতারা এটাকেও আত্মহননের পথ থেকে বিএনপিকে বিরত রাখার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতে পারেন।

বিএনপির নেতাদের উপদেশ দেওয়ার আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের উচিত ছিল নিজ দলের কর্মীদের হামলা ও বাধা দেওয়া থেকে বিরত রাখা। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গেলে আওয়ামী লীগের এত বিচলিত হওয়ার কারণ কী? সেই সঙ্গে এ কথাও বলা প্রয়োজন যে বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ নেতা সুবিদ আলী ভূঁইয়াও এলাকায় যেতে পারেননি। এখন মোশাররফ হোসেন যেতে পারছেন না। রাজনীতি ও গণতন্ত্রের নামে এসব করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি প্রশ্নে ইতিমধ্যে এলডিপি বিভক্ত। রেদোয়ান আহমেদ যেই গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক, সেই গ্রুপ বিএনপির সঙ্গেই আছে।

বাংলাদেশে যেই দলই যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা নিজেদের দেশের মালিক-মোক্তার ভাবে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকতে যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী দল সামরিক শাসনের অধীনে অংশ নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে আসছিল, তখন বিএনপি থেকে প্রার্থী ধার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তারা বোঝাতে চেয়েছিল, আওয়ামী লীগে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করার মতো যোগ্য প্রার্থী নেই। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবি করলে তিনি এই বলে দম্ভ প্রকাশ করেছিলেন যে বি-টিমের সঙ্গে কোনো খেলা হবে না। খালেদা জিয়ার আমলে বিএনপি নেতারা বলে বেড়াতেন, আওয়ামী লীগ আগামী ৪২ বছরে আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আর এখন আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, ২০৪১ সাল পর্যন্ত তাঁরা ক্ষমতায় থাকবেন। তা মনে করতেই পারেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা না থাকার বিষয়টি কে ঠিক করবেন? জনগণ। আর সেই ঠিক করার সর্বজনীন পথ হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।

দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে ক্ষমতার হাতবদল হয়নি। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন তারা করতে পারেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক শাসককে হটিয়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেছে। আবার আদালতের দোহাই দিয়ে সেই সরকারব্যবস্থা বাতিলও করেছে। কিন্তু নির্বাচনী সংকট থেকে দেশ মুক্ত হয়নি। এখন আওয়ামী লীগের নেতারা যে বিএনপির আত্মহনন ও অস্তিত্ব নিয়ে বিচলিত বোধ করছেন, তারও মূলে ওই নির্বাচন।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com