আজ-কাল-পরশু

বিএনপিকে নতুন কার্ড খেলতে হবে

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

বিএনপি আজ নানা সংকটে জর্জরিত। এ জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। এই দলের নানা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সরকারও বিএনপির নেতা ও কর্মীদের ওপর খড়্গহস্ত। কোনো বড় দলই তাদের সমান প্রতিদ্বন্দ্বী চায় না। আওয়ামী লীগও চায় না বিএনপি একটি বড়, শক্তিশালী ও জনপ্রিয় দল হিসেবে টিকে থাকুক। কিন্তু দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশে একক দলের একচেটিয়া ক্ষমতা থাকা উচিত নয়।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের স্বার্থে আমরা চাই, দেশে তিন, চার বা তারও বেশি রাজনৈতিক দল খুব সক্রিয় থাকবে। মানুষের সমর্থন তাদের ঘিরেই আবর্তিত হবে। অন্তত চারটি বড় রাজনৈতিক দল বা জোটের ওপর যেন নির্বাচন, সরকার পরিবর্তন নির্ভর করে। দুঃখের বিষয়, বহু বছর রাজনীতি করেও ক্ষমতায় যাওয়ার মতো বাংলাদেশে তৃতীয় দল বা জোট এখনো তৈরি হয়নি। কাজেই ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বা তাদের নেতৃত্বের জোটই ক্ষমতায় যায় বা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।
বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। দুবার পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় ছিল। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের পক্ষে আবারও ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন ছিল না। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুপস্থিতি এবং দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিএনপিকে এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে যে তাদের পক্ষে আবার ক্ষমতায় যাওয়া শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। ক্ষমতাসীন দল বুঝতে পেরেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির পক্ষে জয়লাভ করা হয়তো সম্ভব হবে। তাই নানা ফন্দিফিকির করছে। নির্বাচনে না যাওয়া ছিল আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে বিএনপির প্রথম পরাজয়। ক্ষমতায় যেতে হলে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে। নির্বাচন না করে ক্ষমতায় যাওয়ার কোনো সুযোগও নেই। কাজেই বিএনপিকে এখন ক্ষমতাসীনদের ছকের নির্বাচন করেও কীভাবে জয়লাভ করা যায় তার কৌশল বের করতে হবে। সেই কৌশল কাজে লাগাতে না পারলে বিএনপিকে চিরকাল বিরোধী শিবিরে থাকতে হবে। এই কৌশল বের করা এখন বিএনপির জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার আওয়ামী লীগ মানবে বলে মনে হয় না।
বিএনপির দুর্বল নেতৃত্ব, ভুল কৌশল, দুর্বল বক্তব্য ও ভুল কার্ড খেলে দলটি গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। বিএনপি এখনো তার প্রতিষ্ঠাকালের (১৯৭৮) রাজনৈতিক আবহে রয়ে গেছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের চিন্তাধারা, কৌশল, জনগণ সম্পর্কে তাদের ধারণা, ছাত্র ও তরুণ সম্পর্কে তাদের ধারণা—সবই প্রায় আশির দশকের। সেই চিন্তায় বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কী সেই বক্তব্য? ১. মুক্তিযুদ্ধের আংশিক ইতিহাস বলা (শুধু জিয়ার অংশগ্রহণকে হাইলাইট করা), ২. ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী লীগ শাসনকালের সমালোচনা, ৩. বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সুবিধাবাদী নীরবতা, ৪. ভারতবিরোধী জিগির তোলা ইত্যাদি।
নানা কারণে দেশের অনেকেই তখন আওয়ামী লীগ শাসনামলের সমালোচনায় মুখর ছিলেন। এর যৌক্তিকতাও ছিল। কিন্তু রাজনীতিতে এক কার্ড বেশি দিন খেলা যায় না। কারণ, দর্শক বদলে যায়। আশির দশকে এসব রাজনৈতিক বক্তব্যের হয়তো গ্রহণযোগ্যতা ছিল। নইলে বিএনপি এত বড় ও জনপ্রিয় দল হয়েছিল কীভাবে? দর্শকের বয়স বাড়ে। দর্শক পরিপক্ব হয়। অনেকে পড়াশোনা করেন। ইতিমধ্যে ইতিহাসমূলক প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে। অনেক ছাত্র, তরুণ বড় হয়েছে। ছাত্রদলের সেই দাপট আর নেই। রাজনীতির অঙ্গন দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতির বক্তব্য, ইস্যু, স্লোগান বদলে গেছে। ’৯০-এর পরে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নানা গুণগত পরিবর্তন এসেছে। চিকিৎসা, বেড়ানো ও ব্যবসা করার জন্য ভারতে বাংলাদেশের মানুষের যাতায়াত বহুগুণে বেড়েছে। এই যে নানা সেক্টরের এত গুণগত পরিবর্তন হয়েছে, বিএনপি নেতৃত্ব তা ধারণ করতে পারেনি।
বিএনপি নেতৃত্ব, আমাদের ধারণা, সেই আশির দশকেই রয়ে গেছে। দেশ ও দেশের মানুষ কিন্তু আশির দশকে আর নেই। অতি প্রবীণদের দিয়ে রাজনীতি করার দিনও শেষ। মাস্তান বা সন্ত্রাসীদের এখন মানুষ ঘৃণা করে। দলের নেতৃত্বে তাদের মানুষ দেখতে চায় না। বিএনপি নেতৃত্বের অনেকেই বয়সের ভারে পীড়িত, কেউ কেউ দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ। এঁদের সামনে রেখে একবিংশ শতাব্দীর একটি রাজনৈতিক দল এগোতে পারবে না। বিএনপিকে এটা বুঝতে হবে। সময়ের পরিক্রমায় ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাড়া দিয়ে বিএনপিকে আগের অনেক কার্ড ফেলে দিতে হবে। আশির দশকের কার্ড ও স্লোগান এখন অচল। অযৌক্তিক ভারতবিরোধিতা, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস না বলা, বঙ্গবন্ধুকে তাঁর যথাযথ মর্যাদা না দেওয়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে কৌশল অবলম্বন করা—এগুলো এখন চলবে না।
বিএনপির মুসলিম লীগ অংশ (১০ শতাংশের বেশি হবে বলে মনে হয় না) হয়তো এখনো এসব বক্তব্যের পক্ষেই থাকবে। বাকি ৯০ শতাংশ নেতা, কর্মী ও সমর্থক এগুলো সমর্থন করে বলে মনে হয় না। ’৭২-৭৫ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা, তিস্তার পানি বণ্টনসহ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবিতে সোচ্চার হওয়া এবং বাংলাদেশের স্বার্থে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দলের বক্তব্য তুলে ধরতে হবে যৌক্তিকভাবে। কী কী ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতপার্থক্য, তা–ও বিএনপিকে বলতে হবে। কেন বিএনপি একটি পৃথক দল, তা জনগণকে বোঝাতে হবে। সাম্প্রদায়িকতাকে কোনোভাবেই দলে স্থান দেওয়া যাবে না। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করা যাবে না। এগুলো পাকিস্তানি চিন্তা। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ—এগুলো বাতিল চিন্তা। একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিতে এসব কার্ড নিয়ে আর আসর জমানো যাবে বলে মনে হয় না। জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতি হয় না। সামরিক শক্তি, বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করেও গণতান্ত্রিক রাজনীতি হয় না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির একমাত্র মূলধন জনসমর্থন। বিএনপিকে এটা বুঝতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিসচেতন অনেক মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দল চায়। বিএনপি সেই দল হতে পারত। এখনো পারে। যদি এই দল তাদের ঘুণে ধরা রাজনীতি ত্যাগ করে যুগোপযোগী নতুন রাজনীতি গ্রহণ করে। অনেকে বলতে পারেন, ‘বিএনপির মূল আদর্শ বাদ দিলে আর বিএনপির থাকে কী!’ আমরা বলব, এগুলো ভুল আদর্শ ও ভুল স্লোগান ছিল। কোনো গণতান্ত্রিক দলের ও রকম আদর্শ থাকতে পারে না। তা ছাড়া সময়ের পরিবর্তন বা রাজনৈতিক বাস্তবতা না বুঝলে সেই দলের সার্থকতা কোথায়? একসময় মুসলিম লীগ অনেক বড় দল ছিল। সেই দল এখন কোথায়? শুধু রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে নিজেদের কর্মসূচি ও আদর্শ পরিবর্তন করতে পারেনি বলে আজ মুসলিম লীগ প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। একসময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনেকে রজনীতি করেছেন। সোভিয়েতের পতনের পর কি তাঁরা তাঁদের দলের আদর্শ ও কর্মসূচিকে নতুন করে বিন্যাস করেননি?
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণফোরাম—এসব দলে বিরাট আদর্শগত, কর্মসূচিগত পার্থক্য তেমন নেই। শুধু নেতার ক্যারিশমাগত পার্থক্য রয়েছে। বিএনপি যদি এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, তাদের কিছু জনপ্রিয় কর্মসূচি নিতে হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ দিয়ে ও গবেষণা করে এসব কর্মসূচি তৈরি করতে হবে। দেশের সবকিছু রাতারাতি পাল্টে দেওয়া কোনো দলের পক্ষে সম্ভব হবে না। বিএনপি দেশের কয়েকটি সেক্টর বেছে নিতে পারে। যেমন: দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান, কারিগরি শিক্ষা, দুর্নীতি দমন বা হ্রাস, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নারীর নিরাপত্তা, তথ্যপ্রযুক্তি ইত্যাদি। নির্বাচিত হওয়ার পর ২৫ বছরে এসব সেক্টরে কী কী বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে, প্রতি পাঁচ বছরে কী পরিবর্তন আনবে, তা জনগণকে বলতে হবে।
একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিতে খেলতে হবে এসব কার্ড। ছাত্র ও তরুণেরা রাজনৈতিক দল থেকে এগুলো শুনতে চায়। বিএনপি যদি আশির দশকের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং নতুন রাজনীতির কার্ড গ্রহণ করতে পারে, তাহলে দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তখন বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করতে চাইলে জনগণ সাড়া দিতে পারে। এখন কেন সাড়া দেবে? আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি ভালো শাসন উপহার দেবে, তার নিশ্চয়তা কী? বিএনপির অতীত রেকর্ড তা বলে না। জনগণ খুব সচেতন। বেশি সচেতন তরুণেরা। বিএনপিকে বোঝাতে হবে তারা ভালো বিকল্প। তাদের কর্মসূচি আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো। অতীতের ভুল তারা আর করবে না।
বিএনপি একটি বড় দল। তারা যদি অতীতের ভুল মেনে নিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করতে রাজি হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে থাকবে। সরকার গঠন করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। শুধু দরকার আত্মোপলব্ধি ও আত্মসমালোচনা। বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চার স্বার্থে একাধিক বড় দলের সক্রিয় থাকা খুব জরুরি। এটাই নাগরিক সমাজের স্বার্থ।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।