ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় জাতি ভুলে গেছে, ৪০ বছর আগে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। সে সময় এক লাখের বেশি মানুষকে বিনা বিচারে আটক করা হয়েছিল। গণমাধ্যম এই পরিস্থিতি তুলে ধরতে পারত, কিন্তু তার কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল। সরকারি কর্মকর্তারা অনুগত হয়ে আদেশ জারি করেছেন। তবে এই আদেশ আসত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর কাছ থেকে, মায়ের নামে তিনি সংবিধানবহির্ভূতভাবে দেশ চালাতেন।
তখন বিচার বিভাগও নতি স্বীকার করে, তারা অনুমোদন করে, সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে। এমনকি জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণারও যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা হয়। শুধু একজন বিচারপতি এর বিরুদ্ধমত প্রকাশ করেছিলেন, তিনি হলেন বিচারপতি এইচ আর খান্না। তবে তাঁর মত খারিজ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীকে ভারত শাস্তি দিয়েছিল, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। পরবর্তী নির্বাচনে জাতি তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
যে ব্যাপারটি আমাকে হতাশ করে তা হলো, যে রায়ের কারণে বিচার বিভাগের বদনাম হলো, সুপ্রিম কোর্ট সেটার বিরোধিতা করে কখনো প্রস্তাব পাস করেননি বা সেই বদনাম দূর করতে কিছু করেননি। এমনকি এখনো বেশি দেরি হয়ে যায়নি। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে উদার বিচারক আছেন। তাঁরা ক্ষতিটা পুষিয়ে দিতে প্রস্তাব পাস করাতে পারেন, তাঁদের পূর্বসূরি বেঞ্চ জরুরি অবস্থার বৈধতা দিয়ে ভুল করেছেন।
অন্তত আগের সরকার জরুরি অবস্থার সময় বাড়াবাড়ি করেছে—প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করা উচিত। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল নীরেন দে এমনকি আদালতে এই কথাও বলেছেন যে জরুরি অবস্থার সময় মানুষের জীবনযাপনের অধিকারও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
আমার স্ত্রী তখন জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দাখিল করেছিলেন, এ নিয়ে দিল্লির আইনজীবীদের থরহরিকম্প দশা হয়েছিল। এরপরও আমাকে তিন মাস কারাগারে থাকতে হয়েছিল। বিচারক এস রঙ্গরাজন ও আর এন আগারওয়াল আমার মুক্তির আদেশ দিয়েছিলেন। তাঁদের শাস্তি হয়েছিল। প্রথম জনকে গুয়াহাটিতে বদলি করা হয়, যেখানকার মানুষ নিরপেক্ষতার জন্য এখনো তাঁকে স্মরণ করে। দ্বিতীয় জনকে পদাবনতি দিয়ে সেশনস আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে তাঁরা ক্ষান্ত হননি, বরং সাহসিকতার সঙ্গে স্বাধীনভাবে কাজ করে গেছেন তাঁরা।
সম্ভবত গণমাধ্যম সজাগ থাকায় সম্প্রতি বিচারকদের ওপর চাপ কমেছে। কিন্তু ভারতের বিচারক নিয়োগের বেলায় সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটি ঘটছে। শাসকেরা ইচ্ছেমতো বিচারক নিয়োগ দিচ্ছেন। কংগ্রেস সরকারের আমলে এটা শুরু হয়েছে, এরপর বিজেপি ক্ষমতায় এসেও তা চালিয়ে যাচ্ছে।
মনে পড়ে, ইন্দিরা গান্ধীর আমলে এটি শুরু হয়েছে। তিনি তিনজন বিচারপতিকে ডিঙিয়ে বিচারপতি এ এন রায়কে প্রধান বিচারপতি করেছিলেন। নির্বাচনে জালিয়াতি করার অভিযোগে তাঁকে সংসদ থেকে গদিচ্যুত করে ছয় বছর নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। সম্মানের সঙ্গে রায় মেনে না নিয়ে তিনি জরুরি অবস্থা জারি করলেন এবং নির্বাচন আইন পর্যন্ত সংস্কার করলেন।
ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী যে বাড়াবাড়ি করেছেন, তা ইতিহাসের অংশ। যাঁরা ভুক্তভোগী হয়েছেন, শুধু তাঁরা নন, যাঁরা গণতন্ত্র সমর্থন করেন, তাঁরাও সেই জরুরি অবস্থা স্মরণ করেন। ইন্দিরা গান্ধীকে পরাজিত করে জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসে, তারা সংবিধান সংশোধন করে জরুরি অবস্থা জারি নিষিদ্ধ করে। বিচারপতি খান্নার ভিন্নমত ছিল যে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যাবে না, সেটা রীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলো। এর মধ্য দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। ফলে এরপর আর কোনো সরকারের পক্ষে বিচার বিভাগে হাত দেওয়া সম্ভব হলো না।
চূড়ান্ত বিচারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিন্তু বিচারকদের গুণমানের ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট বিচারকে বিভক্ত। কিন্তু তাঁদের যেহেতু আজীবনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়, সেহেতু দলীয় প্রার্থীরা একসময় দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন।
ভারতে সরকার যখন বিচারক নিয়োগ দিত, তখন সেরা বিচারকেরা নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু এখন দলীয় রাজনীতি ঢুকে গেছে। উচ্চ আদালতের বেলায় অন্তত এটা দেখা গেছে যে ক্ষমতাসীন দল সেরা আইনজীবীদের নিয়োগ দেয়নি, বরং যাঁরা বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছেন, তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের কিছু নিয়োগও সন্দেহের তালিকায় আছে।
অতীতকালের কিছু নজিরের প্রশংসা করতে হয়। সাবেক সলিসিটর জেনারেল গোপাল সুব্রামানিয়ামকে হাইকোর্টে নিয়োগের ব্যাপারটা যখন নরেন্দ্র মোদি সরকার স্থগিত করে দেয়, তখন তিনি বলেন, ‘আইনজীবীর স্বাধীনতা আমার মধ্যে এই উপলব্ধি সৃষ্টি করেছে যে আমি সরকারের সঙ্গে তাল মেলাব না। মূলত এটাই আমাকে নিয়োগ না দেওয়ার কারণ।’ এরপর তিনি প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। একটি ব্যাপার উল্লেখ করা দরকার, এক মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্ত আসামি অমিত শাহকে জামিন দিলেও তাঁর পরামর্শে আদালত অমিত শাহর গুজরাটে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন।
গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে করুণ। আমার মনে আছে, যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, তখন মানুষ ক্রোধান্বিত হয়ে উঠেছিল। জরুরি অবস্থার সমালোচনা করতে আমি যে সভার আহ্বান করেছিলাম, সেখানে শতাধিক সাংবাদিক হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর আবার যখন শুরু করতে গেলাম, তখন কাউকে পাওয়া ভার। ইন্দিরা গান্ধী সাংবাদিকদের মনে যে ভীতি সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে তাঁরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চেয়ে চাকরি নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। যদিও অন্যথায় তাঁরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষপাতী।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।