বার কাউন্সিল: পরীক্ষার জন্য প্রার্থনা

আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি নীরব নৈরাজ্য চলছে। প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবী তিন বছর ধরে বার কাউন্সিলে তালিকাভুক্তি পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন। আশা করা হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে প্রায় ৪৪ হাজার ২৮ ফেব্রুয়ারি তিন ধাপের পরীক্ষার প্রথম ধাপে বসবেন। কিন্তু তাঁরা কেউ জানবেন না, কবে তাঁরা বাকি দুটি ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত ফল পাবেন। কবে তাঁরা আইনজীবীর সনদ হাতে পাবেন। তাঁদের জীবন থেকে আরও একটি বছর খসে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

বার ও বেঞ্চকে নিয়েই বিচার বিভাগ। বার ও বেঞ্চকে বলা হয় এক ইগলের দুই ডানা। প্রায় ৪০ লাখ বিচারাধীন মামলাজটের দেশে বার ও বেঞ্চ গঠনপ্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে ও গতিশীল থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সার্বিকভাবে একটা স্বচ্ছতার ঘাটতি চলছে। কেউ কর্মজীবনের শুরুতে বিচারপতি হয়ে পরে আইনজীবী হতে পারেন না। প্রথমে হতে হবে আইনজীবী। কিন্তু সেই আইনজীবী হওয়ার প্রক্রিয়া রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছে। আমরা বহু বছর ধরে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের আইন নিয়ে উচ্চকিত থেকেছি, কিন্তু সেটা মেলেনি। এতকাল বার কাউন্সিল থেকে নিয়মিত আইনজীবী বেরিয়েছে, সেটা গত কয়েক বছর হলো পুরোপুরি থমকে গেছে। শত শত রিট জমা পড়ে আদালতে। আদালতের একটি উল্লেখযোগ্য সময় এখন এই আইনজীবী হওয়ার রিট নিষ্পত্তিতে ব্যয় হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক সেমিস্টারে অনধিক ৫০ জন ছাত্র আইন বিভাগে ভর্তি করতে পারবে। এই যুক্তির পেছনে কী যুক্তি, সেটা তর্কের বাইরে নয়। বলা হয়ে থাকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো, বিশেষ করে আইন পড়ানোর মতো লোকবল না থাকায় এই কোটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিশ্চয় এ রকম নিয়ম গড়পড়তা সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। কারণ, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পড়ানোর পর্যাপ্ত যোগ্যতা ও সামর্থ্য আছে। কিন্তু গড়ে সবার জন্য প্রকারান্তরে একটি অভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তব ফল হলো, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এটা মানছে না।

এই না মানার বিষয়টি বাস্তবে বার কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে ওপেন সিক্রেট। বার কাউন্সিলে চারবারের নির্বাচিত সদস্য আইনজীবী জেড আই খান পান্না। ১২ বছর এর সঙ্গে যুক্ত থাকার পর তিনি সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। বার কাউন্সিলের গোটা এনরোলমেন্ট প্রক্রিয়ার ওপর তিনি মহা ত্যক্ত-বিরক্ত। এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যখনই কথা হয়, তখনই তিনি গভীর দুঃখ ও অনুশোচনা ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য যাঁরাই কমবেশি বার কাউন্সিলের পরীক্ষাসংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে সোচ্চার, তাঁরা কোনো সুষ্ঠু প্রতিকার পাচ্ছেন না। রিট দায়েরের মাধ্যমে যেভাবে সমস্যার একটা সাময়িক বা অস্থায়ী প্রতিকার কেউ কেউ পাচ্ছেন, সেটা আদর্শিক সুরাহা নয়।

যেমন আপিল বিভাগের বেঁধে দেওয়া ১০ লাখ টাকা জরিমানার শর্ত মেনে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শেষ মুহূর্তে পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহের অনুমতি পেয়েছেন। আবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ জন শিক্ষার্থী (রিট নং ১১৯৩৭/২০১৯) গত ডিসেম্বরে হাইকোর্ট থেকে আদেশ পান আসন্ন পরীক্ষায় বসার। ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা সকালে লিখিত নোটিশ পেল প্রবেশপত্র সংগ্রহের, কিন্তু এদিন তারা পেল না। আইন অঙ্গনে এ রকম একটি অবস্থা যে চলতে পারে, তা অকল্পনীয়।

 জরিমানার অর্থ জমা দিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুমতি পেয়েছে, তারা নির্বিকার। ৫০ এর পরিবর্তে ৭৫০ জন ভর্তির উদাহরণ আছে। কে কোন সেমিস্টারে কত ভর্তি করাল, সেটা বার কাউন্সিল আগেই জানে। তখন তারা চুপ থাকে বলে অভিযোগ আছে। পরে পরীক্ষার তারিখ ঘনিয়ে এলে বার কাউন্সিল প্রতিবাদী হয়। তখন যোগ্যতাসম্পন্ন অর্থাৎ বৈধভাবে স্নাতক হওয়া শিক্ষার্থীরা রিট করেন। কারণ, প্রত্যেক সনদধারীর পরীক্ষা দেওয়া একটি মৌলিক অধিকার। বার কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। একজন বললেন, প্রায় ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ৩৯টি রিট জমা পড়েছে। এই রিটই বাধা। কিন্তু আরেকজন কর্তা জানালেন, ৩৯টির মধ্যে ৫০–এর কোটা লঙ্ঘনের দায়ে রিট হয়েছে অনধিক ১০টি। বাকিগুলোর কারণ ভিন্ন। এ পর্যন্ত ওই ১০টির প্রায় সব কটিই ১০ লাখ টাকা জরিমানার শর্তে রিটে জয়ী হয়েছে। সুতরাং যেসব কর্মকর্তা দাবি করেন, শুধু রিটের কারণেই তাঁরা পরীক্ষাজটে পড়েছেন, সেটা ধোপে টেকে না।

বার কাউন্সিলের একজন কর্তাকে বলি, আপনারা জানেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা কোনো স্বয়ংক্রিয় বা বাধ্যতামূলক িবষয় নয়। কিন্তু জবাব এল, তাঁরা এ বিষয়ে আইনজীবী নিয়োগ দেন। তাঁরাই সিদ্ধান্ত নেন। তো এভাবে আপিল বিভাগে সব ক্ষেত্রেই যথাসময়ে যে তাঁরা যান, সেটাও কিন্তু নয়।

যে পাঁচটিতে তাঁরা হাইকোর্টে আপিল করেছেন, তাতে সবাইকে ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। প্রতীয়মান হয় যে মানবকল্যাণের নৈতিক মানদণ্ডে এই জরিমানা করা হয়েছে। কারণ, জরিমানার অর্থ বারডেম হাসপাতাল, চট্টগ্রামের হাসপাতাল এবং বার কাউন্সিলের তহবিলে (একটি সূত্রমতে বার কাউন্সিল এই প্রথম জরিমানার অঙ্ক বাবদ ৪০ লাখ টাকা পাবে) জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এবার না হয় এভাবে যাবে, এরপরের পরীক্ষাগুলোতে কী হবে? কিছুদিন আগে অল্প সময়ের ব্যবধানে নিয়মিত তালিকাভুক্তির পরীক্ষার দাবিতে ছাত্ররা
আমরণ অনশনের মতো কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছিল। বার অঙ্গনে এমন দৃশ্যপট অচিন্তনীয়। অথচ চলতি মাসের পরীক্ষার পরের তারিখ কখন আসবে, সেটা সবার কাছে অস্পষ্ট। সে কারণে এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা স্থায়ীভাবে কোনো সমাধানসূত্রে পৌঁছাতে অপারগ থাকেন। কারও জানা নেই, আসন্ন এমসিকিউর পরের দুটি (রিটেন ও ভাইভা)  ধাপ কখন কীভাবে চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হবে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা পরিষ্কার যে বিচার বিভাগ গঠনপ্রক্রিয়ায় একটি বড় মাপের অবিচার চলছে। খালি চোখে এর মারাত্মক অভিঘাত পড়ছে আইন পেশায় আসার স্বপ্নে বিভোর তরুণদের জীবনে। তাঁরা হতাশ, তাঁরা বিভ্রান্ত। তাঁদের পথ দেখানো আজ সময়ের দাবি। আমরা মুখে বলি আইনের শাসন। কিন্তু যে প্রক্রিয়া থেকে তার সূচনা, সেখানে আমরা একটা বড় রকমের তালগোল পাকিয়ে বসে আছি। কে দায়ী, সেটা খুঁজে বের করার চেয়ে কখন কী উপায়ে সমাধান, তার উত্তর জানা জরুরি। শিক্ষিত বেকারের দেশে ৫০ হাজারের বেশি তরুণ প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের পরে তাঁরা নিজের খরচে, নিজের মা-বাবার খেয়েপরে উঠে দাঁড়াতে চাইছে, আর রাষ্ট্রযন্ত্র তাঁদের পিঠ চাপড়ানোর পরিবর্তে পিঠে কিলঘুষি মারছে। এটা তো অসম্ভব, অসহনীয় একটা বাস্তবতা।

উন্নয়ন–নীতিনির্ধারকদের মানতে হবে যে যাঁরা একদিন বিচার বিভাগের অংশে পরিণত হবেন, তাঁরা জীবনের শুরুতেই অকারণে হোঁচট খাচ্ছেন। দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হচ্ছেন। আইনে ডিগ্রি লাভের পরে শিক্ষার্থীরা সিনিয়র ধরেন। তাঁর অধীনে ছয় মাস পিউপিলেজ করেন। এই ছয় মাসের শর্ত পূরণ হলেই যে কেউ পরীক্ষায় বসতে পারবেন, আইন এটাই বলছে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে এ রকম শর্ত পূরণ করা কমপক্ষে ২০ হাজার তরুণ জানেন না, তাঁরা কবে আইন পেশায় পরীক্ষা দিতে পারবেন। বিসিএস ও পাবলিক পরীক্ষাগুলোর জট কমাতে বর্তমান সরকার সফল হয়েছে। কিন্তু কারা এখানে ব্যর্থতার বীজ বুনলেন, সেটা সরকারকে খুঁজে দেখতে হবে।

গত ৩ নভেম্বর বা তার আগে ছয় মাসের শর্ত পূরণ করতে পেরেছে, এমন শিক্ষার্থীরাই শুধু ২৮ ফেব্রুয়ারি বসতে পারছেন। অথচ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গত অক্টোবরে। পরবর্তী প্রায় চার মাসে যাঁরা যোগ্য হয়েছেন, সেসব তরুণ অবাক বিস্ময়ে দেখছেন, শুধু রিটকারী হলে পরীক্ষার মাত্র দিন দশেক আগেও পরীক্ষায় বসা যায়, অন্যথায় ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকাই তাঁদের ভবিতব্য।

 নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি—এই চার মাসে আরও হাজার হাজার শিক্ষার্থী যোগ্য হলেন। তাঁদেরও কেউ কেউ রিট করেছেন। মোটকথা, বার কাউন্সিল অস্বচ্ছতা বজায় রাখছে। তাদের চিন্তার মধ্যে হাইকোর্টের রায় এবং তার বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়টিই ঘুরেফিরে আসে। তারা কোন নৈতিকতায় আপিল করে। তারা কেন পরীক্ষাবিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার ভাবমূর্তি মলিন হতে দিচ্ছে?

আগে ছয় মাস অন্তর ঠিকঠাক পরীক্ষা হতো। এখন একটি পরীক্ষা থেকে আরেকটি পরীক্ষা আসতে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লাগছে। এই ধারা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সহজে নিরাময়যোগ্য এই সমস্যা দেশে অপ্রত্যাশিত বেকারত্ব ও ভবিষ্যতের বিচার বিভাগের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে।

দুটি বিষয় সব থেকে জরুরি। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার তফসিল নির্দিষ্ট করতে হবে। আগামী এমসিকিউর তারিখ এ মুহূর্তে ঘোষণা করতে হবে। আইনজীবী হতে আগ্রহী অনেক তরুণ, পরীক্ষা নামের কৃত্রিম দেয়াল টপকানোর আশা ছাড়ছেন। তাঁরা অন্য পেশায় বাধ্য হয়ে ক্যারিয়ার গড়ছেন। 

বার কাউন্সিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠান কী করে পরীক্ষার প্রতি এতটা নির্লিপ্ত, সেটা বিরাট প্রশ্ন। তারা নিয়ম করেছিল, তিনটি ধাপের মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে আবার তাকে এমসিকিউ দিয়ে শুরু করতে হতো। শিক্ষার্থীরা তুমুল প্রতিবাদ করেছেন বলেই তারা ঠেকায় পড়ে এই নীতি বদলেছে। অথচ এটা তাদের স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ হতে পারত।

বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার গল্প আমরা জানি। এ দেশে বার পরীক্ষার জন্য আইনে স্নাতক তরুণ সমাজের প্রার্থনা ও অপেক্ষার অবসান চাই। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে বিদ্যমান ব্যবস্থাটা বর্তমানের তরুণ আইনজীবী বা ভবিষ্যতের বিজ্ঞ বিচারপতিদের মধ্যে আইন পড়ালেখার প্রতি অনীহা জন্মাচ্ছে। আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে। আদালতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। তখন বিচারাঙ্গনে একি দেখছি? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কতটা কী শিখিয়ে (ছয় মাস পড়িয়ে নাকি কেউ চার বছরের অনার্স সনদ দিচ্ছে) কী ডিগ্রি দিচ্ছে? আপাতত আমাদের উদ্দীপ্ত তারুণ্য দ্রুত পরীক্ষার পিঁড়িতে বসতে চাইছে। এটা কি খুব বেশি দাবি?

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
mrkhanbd@gmail.com