মস্কোতে না হলেও বার্লিনে স্পষ্ট শান্তিচুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন লিবিয়াসহ দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু শান্তি অধরাই থেকে গেল। বিশ্বশক্তির কর্তারা অনেকটা দায়সারাভাবেই লিবিয়ার যুদ্ধে আর কোনো অস্ত্র সরবরাহ না করার অঙ্গীকার দিয়েই বার্লিন ত্যাগ করেছেন। আদতে এই দায়সারা গোছের বক্তব্য আর সম্মেলন বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারকে বৈধতা দিয়েছে এবং হাফতারের আগ্রাসনকে গতি দিয়েছে। গাদ্দাফির বিদায়ের পর জাতিসংঘ-সমর্থিত ঐকমত্যের সরকার আর বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের দ্বন্দ্বই হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমা ও রুশ-সমর্থিত শক্তির ছায়াযুদ্ধ। তাই হাফতার শক্তিশালী হওয়া মানে জাতিসংঘসহ অন্যদের স্বীকৃত জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের দুর্বল হওয়া।
গত সপ্তাহে মস্কোতে শান্তির জন্য আয়োজিত অনুশীলন ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার পর সবার নজর ছিল বার্লিনে। তবে মস্কোতে সবাইকে বিশেষ করে রুশ কর্মকর্তাদের নিরাশ করে যখন খলিফা হাফতার অস্ত্রবিরতিতে স্বাক্ষর না করে মস্কো ত্যাগ করেন, তখন বার্লিন সম্মেলন যে অনেকটা নামকাওয়াস্তের সম্মেলন হবে, তার ইঙ্গিত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আগেভাগেই দিয়েছেন। কিন্তু আশাই যাদের শেষ সম্বল, সেই লিবিয়াসহ যুদ্ধবিরোধী জনতার স্বপ্ন ছিল হয়তো বার্লিন থেকে শান্তির আওয়াজ উঠবে।
শান্তির আওয়াজ না উঠলেও বার্লিন সম্মেলন অনেক বিষয়ের কাগুজে সুরাহার প্রচেষ্টা করেছে। সম্মেলন শেষে আঙ্গেলা ম্যার্কেল সব বিদেশি শক্তিকে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ২০১১ সালে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি সবাইকে মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে সব পক্ষকে দীর্ঘমেয়াদি অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়ে নিজস্ব মিলিশিয়া বাহিনীকে বিলোপের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে একক রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গঠনে জোর দিয়েছেন। কিন্তু ম্যার্কেলসহ পশ্চিমারা এই আহ্বান বাস্তবে রূপান্তর করার দায়িত্ব দিয়েছেন হাফতার আর লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারকে। হয়তো এখানেই ছিল বার্লিন সম্মেলনের বড় ব্যর্থতা। কারণ লিবিয়ায় হাফতারের কোনো বৈধতা নেই, বৈধতা তো কেবলই জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় হাফতারের বিরুদ্ধে কালক্ষেপণের যে অভিযোগ, তার প্রমাণ মিলেছে বারবার। যার সর্বশেষ নমুনা ছিল মস্কোয়। সহজ বাংলায় মস্কো থেকে হাফতার পালিয়েছিলেন। রাশিয়া-তুরস্কের যৌথ প্রচেষ্টায় হাফতার আর লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের মধ্যে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষরের কথা ছিল। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে হাফতার চুক্তি স্বাক্ষরে গড়িমসি শুরু করেন এবং স্বাক্ষর না করেই বাড়ি ফেরেন। তুর্কি মিডিয়ার খবরে প্রকাশ, ফ্রান্স ও আমিরাতের চাপেই হাফতার রুশ কর্মকর্তাদের নাখোশ করে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেননি। কারণ একদিকে হাফতারের অর্থ জোগানদাতা আমিরাত, অন্যদিকে গোয়েন্দা তথ্যের জোগানদাতা ফ্রান্স। সৌদি বলয় আর ফ্রান্সের এই অবস্থান বেশ পুরোনো। কারণ উভয় পক্ষই আলোচনার টেবিলে জাতিসংঘের বৈধতাহীন হাফতারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার নেই জেনেই বারবার হাফতারকে আলোচনার টেবিল থেকে নিবৃত্ত রাখতে চেষ্টা করেছে।
সৌদি বলয় ও ফ্রান্সের তৎপরতায় মস্কো ও বার্লিনে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর না হওয়ায়, আপাতদৃষ্টিতে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে শান্তির কোনো অগ্রগতি না হয়ে বরং হাঙ্গামার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে। তার প্রমাণ হাফতার ও তাঁর অনুসারীরা দিয়েই চলেছেন। আল জাজিরার খবরে প্রকাশ, হাফতার অনুসারীদের লাগাতার আক্রমণের কারণে লিবিয়ার জাতীয় পেট্রল করপোরেশন বার্লিন সম্মেলনের ঠিক আগ মুহূর্তে লিবিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আল-সারার এবং আল-ফিল তেলক্ষেত্র বন্ধ করে দিয়েছে। এই দুই তেলক্ষেত্রে উৎপাদনহীনতার দরুন লিবিয়া প্রতিদিন হারাবে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ, যার ক্ষতিকর প্রভাব ইতিমধ্যেই দেশটির মুদ্রার আন্তর্জাতিক মান কমিয়ে দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে লিবিয়ান দিনার হারিয়েছে ১০ থেকে ১৫ ভাগ মূল্য।
বার্লিনে অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়ার আরেক কারণ ভূমধ্যসাগরে সৌদি বলয়, ইসরায়েল, গ্রিস আর তুরস্কের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকার আর তুরস্কের মধ্যে স্বাক্ষরিত ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া-তুরস্ক বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গঠন চুক্তি এই প্রতিযোগিতায় আঙ্কারাকে দারুণভাবে ফিরিয়ে এনেছে। লিবিয়া-তুরস্কের এই চুক্তি ইসরায়েল, গ্রিস ও সাইপ্রাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন চুক্তিকে অকেজো করে দিয়েছে। ইস্টমেড গ্যাস পাইপলাইন ভূমধ্যসাগরের তলদেশ দিয়ে ইসরায়েলের গ্যাস নিয়ে যাবে ইউরোপে। গ্রিস, ইসরায়েলসহ ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী সব দেশ তুরস্ক ও লিবিয়ার জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের মধ্যকার স্বাক্ষরিত লিবিয়া-তুরস্ক বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গঠন চুক্তির বাতিল চায়। এবং এই চুক্তি বাতিলের আপ্রাণ চেষ্টার অংশ হিসেবে গ্রিস সরকারের দাওয়াত যুদ্ধবাজ হাফতারকে এথেন্সে নিয়ে এসেছিল বার্লিন সম্মেলনের ঠিক আগের দিন। গ্রিস, ফ্রান্স আর সৌদি বলয় আপাতদৃষ্টিতে সফল। কারণ এথেন্সে হাফতার ঘোষণা দিয়েছেন, যদি তিনি পশ্চিমাদের সহায়তায় ত্রিপোলি দখলে সক্ষম হন, তবে ভূমধ্যসাগরে লিবিয়া-তুরস্ক বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গঠন চুক্তি বাতিল করবেন। আঙ্কারার ভয় এখানেই। যদি হাফতার ওই চুক্তি বাতিল করে গ্রিসের সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি করেন, তাহলে ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাসে আঙ্কারার অধিকার অনেকটাই সংকুচিত হয়ে পড়বে।
অস্ত্রবিরতি ঘোষিত না হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল লিবিয়ার রাস্তায় স্বল্প পরিসরে তুর্কি সেনার উপস্থিতি। আলোচনার মধ্য দিয়ে দিয়ে তুর্কি সেনাদের লিবিয়া থেকে বিদায় করে ত্রিপোলি জয়ের পরিকল্পনা ছিল হাফতারের। সে সুবাদেই হাফতার গিয়েছিলেন মস্কোয়। কিন্তু মস্কোর আলোচনায় আঙ্কারা সৈন্য প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানালে হাফতার চুক্তি না করেই মস্কো ত্যাগ করেন। এখন তিনি যেকোনো আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে লিবিয়া থেকে তুর্কি সৈন্যের প্রত্যাহার চান। কারণ হাফতারের পক্ষে তুর্কি সেনাদের উপস্থিতিতে ত্রিপোলি দখল সম্ভব নয়। হাফতারের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি বলয় বিশেষ করে মিসর কোনোভাবেই তুর্কি সেনার উপস্থিতি মানতে রাজি নয়। কারণ মার্কিনদের প্রিয় স্বৈরশাসক জেনারেল সিসি, আঙ্কারা যাঁর বৈধতা শিকার করে না, ভালো করেই জানেন যে লিবিয়ায় তুর্কি সৈন্যের উপস্থিতি কায়রোতে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সাহস জোগাবে। তাই মিসরও যেকোনো অস্ত্রবিরতিসহ হাফতারের আলোচনার টেবিলে যাওয়ার বিপক্ষে।
রাজনৈতিক এই বিষম অঙ্কের মধ্যে সিরিয়ার মতো করেই লিবিয়ার গৃহযুদ্ধকে গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতার আয়না দিয়ে দেখার সুযোগ নেই। কারণ সিরিয়া, ইয়েমেন আর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে পশ্চিমাদের ভূমিকা দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ কীভাবে একের পর এক দেশে ভয়াবহ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করে যাচ্ছে। এথেন্সে হাফতারের দাম্ভিক উপস্থিতি ও গ্রিসের ত্রিপোলি দখলে সহযোগিতার আশ্বাস আবার প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্র কীভাবে তার স্বার্থ রক্ষার নামে অবৈধ শক্তির সঙ্গে আপস করে।
রাহুল আনজুম: পর্যবেক্ষক, তুরস্ক প্রবাসী বাংলাদেশি।