গত শতকের শেষভাগে কানাডার কয়েকটি প্রদেশের সাংসদেরা নিজ নিজ সংসদে একটি আইন প্রস্তাব তুললেন। উদ্দেশ্য আশি বছরের বেশি বয়স্কদের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স প্রত্যাহার করা ও নবায়ন না করা। কারণ, বয়োবৃদ্ধদের মনঃসংযোগের অভাব, শারীরিক-মানসিক অক্ষমতা, স্মৃতিবৈকল্য রোগ, চালাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়া, পথঘাট ভুলে যাওয়া, ধীরে গাড়ি চালিয়ে পেছনের চালকদের সময় নষ্ট ও বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠা ইত্যাদি। কিন্তু এই উদ্যোগে দারুণভাবে ক্ষুব্ধ বয়োবৃদ্ধরা বিক্ষোভ ও আন্দোলনে নামলেন।
পিটিশনে নাকি তাঁরা লিখেছিলেন, গাড়ির লাইসেন্স বাতিল করায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বৃদ্ধদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হোক। ২০১৩-১৪ সালে এবং বর্তমানকালে কানাডার আলবার্টা ও ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশে বৃদ্ধদের গাড়ির লাইসেন্স টেকাতে দুই বছর পরপর স্বাস্থ্য পরীক্ষার নিয়ম করার চেষ্টা বৃদ্ধরা ঠেকিয়ে রেখেছেন।
বয়স্থজনের অভিমান, উষ্মা, প্রতিবাদ ও ক্ষোভের কারণ গাড়িগুলোই তাঁদের পরিবার, সন্তান বা বন্ধুর মতো নিত্যসঙ্গী। নিকটজনের অনুপস্থিতিতে তাঁদের জীবন বিষাদ-বিষণ্নতা, হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে একাকার নয়। বরং এমন অনেক ঘটনাই স্বাভাবিক যে আঠারো বছর পেরোবার পরও প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান ঘর না ছাড়লে তাঁদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। বাইশ বছর বয়সী সন্তান ঘর ছাড়েনি, তাই বাবা–মা সন্তানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন—এমন ঘটনাও রয়েছে। সন্তানসন্ততি খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁদের বার্ধক্যের সহায় হতে পারেন। বয়োবৃদ্ধরাও স্বাধীনচেতা। সাহচর্য পেলে নিশ্চয়ই দারুণ খুশি হন, কিন্তু নিকটজনের বা সন্তানসন্ততির করুণার পাত্র হয়ে থাকতে চান না। কুকুর-বিড়াল এবং অন্যান্য পোষা প্রাণীকেও অনেক বয়োবৃদ্ধজন সন্তান ও আত্মীয়-পরিজনের চেয়ে নিকটতম ও প্রিয় সঙ্গী করে নেন।
পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে বৃদ্ধাশ্রমকে এখনো অভিশপ্ত ও বঞ্চিতদের স্থান মনে হয়। এই মনে হওয়ায় যুগোপযোগী পরিবর্তন দরকার। নচিকেতার ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার’ শুনে চোখে জল এলেও এমন অমানবিকতা শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত–নিম্নমধ্যবিত্তদের মূল্যবোধের পরিপন্থী। তাদের এপার-ওপার দেখা না যাওয়া ফ্ল্যাট দূরে থাক, স্থানাভাবে বই রাখার শেলফও জলাঞ্জলি দিতে হয়।
জাতিসংঘের হিসাবে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ছিল ৭৫ কোটি। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দ্বিগুণ বা ১৫০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবারদাবারে যুগান্তকারী উন্নয়নের ফলে অকালমৃত্যু কমেছে। জাপানে শতবর্ষীদের সংখ্যা বাড়ন্ত। আমার এক জাপানি বন্ধু কৌতুকচ্ছলে বলেছিলেন, একসময় গবেষণা হবে কীভাবে বৃদ্ধদের মৃত্যু ত্বরান্বিত করা যায়। মৃত্যু এগিয়ে নেওয়ার ওষুধও মিলতে পারে। শারীরিক সমস্যাগুলো যেমন পক্ষাঘাত আলঝেইমার, ডিমেনশিয়া, পার্কিনসন রোগ এবং স্নায়ু, পরিপাক ও রেচনতন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর চিকিৎসার সুব্যবস্থা এখন পৃথিবীর সব দেশেই সহজপ্রাপ্য।
বার্ধক্যযাপন নিয়ে বয়োবৃদ্ধদের বিশেষ অভিযোগ নেই। বার্ধক্যকে অভিশাপও ভাবেন না। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক প্রস্তুতি নেন বার্ধক্য বরণের। বার্ধক্যবিমা নেন। রাষ্ট্র তো আছেই, সম্ভাব্য প্রাতিষ্ঠানিক সব উপায়ে তাঁদের দেখভালের এবং শেষ দিনগুলোকে যতটা পারা যায় গ্লানিমুক্ত ও আনন্দময় করে তোলার জন্য। তাতে নিকটজনের সাহচর্যের অভাবটুকু মেটে না বটে, কিন্তু মনঃকষ্ট বা বিষাদ-বিষণ্নতায় ন্যুব্জ হয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটে না। বার্ধক্যজনিত মানসিক সমস্যার সহজ চিকিৎসা নেই। মধ্যবয়স হতেই পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ এবং এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের সহায়তাই যে একমাত্র চিকিৎসা—এ সত্যকে সহজে আত্মস্থ করতে পারার কারণেই উন্নত দেশগুলোতে বয়োবৃদ্ধরা ব্যক্তিগতপর্যায়ে ততটা মানসিক রোগগ্রস্ত নন, এবং সে কারণে দীর্ঘজীবী হয়েই বেঁচে থাকেন। মনে-প্রাণে সহজ-স্বাভাবিক জীবন বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার প্রস্তুতির কারণে তাঁদেরকে আত্মঘাতী হতে হয় না।
বাংলাদেশে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান আত্মহত্যা করলেন। টানা ১৭ মিনিটের ফেসবুক লাইভে জানালেন তাঁর বার্ধক্যকালের আগাম একাকিত্ব, ভীতিসহ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধতার কথা। যেখানে ১৭ সেকেন্ড পরই তাঁর আত্মহত্যা ঠেকানোর ত্বরিত ব্যবস্থা হওয়ার কথা, সেখানে দীর্ঘ ১৭ মিনিটেও তাঁর প্রাণরক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি। জনবহুল বাংলাদেশে অন্তত ‘দেখি না উনি কী করেন’ ধরনের ঔৎসুক্য নিয়ে দর্শকদের নির্লিপ্ত থাকার কথা নয়। পুলিশ বিভাগ কল পেয়েও করণীয় নির্ধারণ করতে পারেনি। অর্থাৎ জনসুরক্ষা বিষয়ে তাদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি নেই। মোটাদাগে এটিই সত্য যে বাংলাদেশে প্রবীণবিষয়ক জনভাবনা ও রাষ্ট্রভাবনা নেই বললেই চলে। গত নির্বাচনে বর্তমান শাসকদলের ইশতেহারে অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল বার্ধক্য ও বৃদ্ধসেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার। কিন্তু প্রতিশ্রুতিই সার।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশ-জাতি-সমাজ-সম্পর্ক–মূল্যবোধ সবই পাল্টাচ্ছে। এতটাই দ্রুততার সঙ্গে পাল্টাচ্ছে যে প্রবীণেরা ভাবনার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ছেন প্রান্তে। বস্তুতান্ত্রিক সমাজে অনিঃশেষ ব্যস্ততাই বাস্তবতা। যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙে ছোট ছোট একক পরিবার তৈরি হওয়া এখন সময়েরই দাবি। এ নিয়ে আক্ষেপ বা হা-হুতাশের সুযোগ কম। তরুণ পুরুষ-নারী দুজনকেই কাজে নামতে হচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে শহরমুখো হওয়াই নয়, বিদেশমুখোও হতে হচ্ছে। ফলে পরিবার ছোট রাখাই তাদের জন্য বাধ্যতর বাস্তবতা। জীবনযাত্রার মান বজায় রাখার তাগিদ বা চাপও আরেকটি বাস্তবতা।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে এই চাপ ভয়াবহ। এই দুই বিত্তগোষ্ঠীর কর্মক্ষমদের জীবনে কর্মব্যস্ততাই সারকথা। আনন্দময় পারিবারিক যৌথ সময়যাপনের একটি দিন বের করার বেলায়ও আজকাল তাদের দীর্ঘ প্রস্তুতি দরকার হচ্ছে।
ইদানীং একটি অভিযোগ নিত্যই মিলছে যে ‘মা-বাবাসহ পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ আর আগের মতো নেই।’ এ ধরনের সরলীকরণ সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। এ রকম ভাবনার পেছনে আবেগ বেশি, বিজ্ঞান কম। চাইলেই গ্রামীণ সমাজের সনাতন পরিবার প্রথা ছেড়ে আসা শহুরে নব্য মধ্যবিত্ত আর পুরোনো ভাবধারায় ফিরতে পারবে না। বাংলাদেশের ষাটোর্ধ্ব শহুরে সচ্ছল মধ্যবিত্তের মনে ও মগজে গ্রামীণ মূল্যবোধ সেঁটে থাকতেই পারে। কিন্তু তাঁদের উত্তরপ্রজন্ম, যাদের জন্ম শহরে, তাদের সেই ভাবধারা বা ভাবালুতা থাকার কথা তো নয়। শহুরে মধ্যবিত্ত প্রবীণদের যাঁরাই চাইছেন, তাঁদের সন্তানসন্ততি তাঁদের প্রত্যাশাকে আমলে নিয়ে আচরণ করবেন, তাঁরা প্রায় ক্ষেত্রেই সময়ানুগও নন, বাস্তব চিন্তামুখীনও নন। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মিল না থাকায় তাঁরা গভীর বিষাদের ফাঁদে আটকা পড়েন। আগামী আরও দ্রুতগতির অর্থনীতি ও আন্তর্ব্যক্তিক সম্পর্কহীনতার সময় হয়ে উঠবে।
পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে বৃদ্ধাশ্রমকে এখনো অভিশপ্ত ও বঞ্চিতদের স্থান মনে হয়। এই মনে হওয়ায় যুগোপযোগী পরিবর্তন দরকার। নচিকেতার ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার’ শুনে চোখে জল এলেও এমন অমানবিকতা শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত–নিম্নমধ্যবিত্তদের মূল্যবোধের পরিপন্থী। তাদের এপার-ওপার দেখা না যাওয়া ফ্ল্যাট দূরে থাক, স্থানাভাবে বই রাখার শেলফও জলাঞ্জলি দিতে হয়। হতাশা বাড়ানোর বদলে পরিবর্তনের বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মধ্যবয়সীদের মানসিকভাবে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে তোলা দরকার যে তাদেরও ঠিকানা হতে পারে বৃদ্ধাশ্রম, এবং তাতে আসলে গ্লানিকর কিছু নেই। বরং নিকটজনের করুণা থেকে মুক্তির ও স্বাধীনতার আনন্দ আছে।
বার্ধক্যবিষয়ক দু–একটি সংগঠন যেমন প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, আগারগাঁওয়ের জেরিয়াট্রিক হাসপাতাল বেশ কার্যকর হলেও প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য মাত্রার সেবা দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বার্ধক্যজনিত মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সবিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার। আগামী দিনগুলোর জন্য বার্ধক্য–ভাবনা ও বার্ধক্য–প্রস্তুতির এখনই সময়, এবং রাষ্ট্রেরই মূল উদ্যোগটি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড স্যোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়