আমরা বারুদের স্তূপের ওপরে বসে আছি। যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে বড় বিস্ফোরণ। এই শঙ্কা কেবল পাড়া-মহল্লার বাহ্যিক অবকাঠামোর জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা আমাদের সমাজের জন্যও প্রযোজ্য। চাঁদপুর, কুমিল্লা, পীরগঞ্জ, চৌমুহনী কিংবা রামুর চরম লজ্জাজনক সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, সহিংসতা সেই বড় প্রলয়-দুর্যোগের সামান্য পূর্বাভাস মাত্র। এ লক্ষণগুলো বলছে, আমাদের সমাজদেহে অনেক বড়, অনেক গভীর অসুখ বিরাজ করছে।
বৈষম্য খুব বড় একটা সমস্যা। আমরা কোটিপতি উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড করেছি। বিদেশে টাকা পাচারেও এ দেশের রেকর্ড দেখে অন্য দেশগুলো লজ্জা পাবে। অন্যদিকে প্রান্তিক মানুষেরা হাতে একটা মুঠোফোন পেয়েছেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যায়, কিন্তু তাঁদের বাঁধা আয়ে সংসারের ব্যয় মেটে না, আশার আগুন দগ্ধ করে চরম হতাশার শিখা হয়ে!
কী হবে, একদিন যদি পোশাকশ্রমিকেরা একযোগে বেরিয়ে পড়ে, সমস্ত অন্যায্যতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে! ঢাকা শহরে এবং এর আশপাশে শত শত সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়! হাজারে হাজারে জিপিএ–ফোর-ফাইভ পেয়ে তরুণেরা এসে জড়ো হয়েছে এখানে। এসে তাল মেলাতে পারছে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোর্স ফি লাখ টাকা। মা–বাবা তা দিতেই সর্বস্বান্ত। তার মধ্যে ছেলেমেয়ে ঢাকার এই জৌলুশপূর্ণ জীবনের সঙ্গে, বড়লোক সহপাঠীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে কী করে? তারা তাল মেলাতে পারছে না বর্তমানে, কিন্তু তার সামনে ভবিষ্যৎ কই? পাস করে যে কাজ পাবে, সেই নিশ্চয়তা কই? কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাই তারা যোগ দিয়েছিল হাজারে হাজারে, লাখে লাখে। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, সে–ও শুধু সড়কের নিরাপত্তার দাবিতে নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিরাপত্তার দাবিতেও। আছে কওমি মাদ্রাসার লাখ লাখ ছেলেমেয়ে। তাদের কাজ দিতে হবে, মূলধারার সঙ্গে তাদের মেলাতে হবে। তারা যদি তাদের বঞ্চনার ক্ষোভ মেটাতে একযোগে বেরিয়ে পড়ে, তাদের দোষ দেবেন কীভাবে?
আর আছে সাম্প্রদায়িকতা। আপনারা যেকোনো পত্রপত্রিকার ফেসবুক পোস্টের নিচের মন্তব্যগুলো পড়ে দেখুন। শুধু পত্রিকার লেখাই-বা বলি কেন, ফেসবুকে সাকিব আল হাসানের পারিবারিক ছবির নিচে, যেকোনো তারকার ছবি বা লেখার নিচের মন্তব্যগুলোয় একবার চোখ বোলান। আমাদের মনের মধ্যে হিস হিস করছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ফণা, আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠেছে সেগুলো প্রকাশের ক্ষেত্র। কিছুদিন আগে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তাঁর মায়ের ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করে করুণতম বাস্তবতা দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন। এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার ফণা তোলা লোকের সংখ্যা এত বেশি! আর তারা ফেসবুকে এত সরব, সক্রিয়! এই সব দেখলে আপনার মনে হবে, এই দেশে ভালো মানুষেরা সংখ্যালঘু। আপনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন, সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলেন, বৈষম্যহীনতার পক্ষে বলেন, বাক্স্বাধীনতার কথা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন, আপনি সংখ্যালঘু।
এরপর তিনটা খবরের দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।
এ দেশে সাম্প্রদায়িকতার ফণা তোলা লোকের সংখ্যা এত বেশি! আর তারা ফেসবুকে এত সরব, সক্রিয়! এই সব দেখলে আপনার মনে হবে, এই দেশে ভালো মানুষেরা সংখ্যালঘু। আপনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেন, সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলেন, বৈষম্যহীনতার পক্ষে বলেন, বাক্স্বাধীনতার কথা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন, আপনি সংখ্যালঘু।
খবর ১.
প্রথম আলোয় ১৯ অক্টোবর প্রকাশিত ‘৩০ মিনিটের তাণ্ডবে তাঁরা নিঃস্ব’ শীর্ষক খবরের একটা জায়গায় আছে, ‘ধানখেতেই তাঁরা লুকিয়ে ছিলেন। ধানপাতার খোঁচায় শিশুরা কাঁদছিল। কিন্তু বাবা-মায়েরা তাদের মুখ চেপে রেখেছিলেন।’ আপনাদের কি ১৯৭১ সালে সেই মায়ের কথা মনে পড়ছে না, যিনি পাকিস্তানি মিলিটারির ভয়ে শিশুসন্তান কোলে জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন, শিশু কেঁদে উঠলে তার মুখ চেপে ধরেছিলেন, মিলিটারি চলে যাওয়ার পর দেখেন শিশুটি মারা গেছে! প্রথম আলোর ওই খবরেই আছে তারা রানী আর তাঁর ৯ বছরের মেয়ে বর্ষার কথা। তাদের চারটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা কাঁদছিল। ৯ বছরের বর্ষার মনের মধ্যে কী আঁকা থাকবে? রাত এলেই সে ভয়ে কাতরাবে, লোকের আওয়াজ শুনলেই সে আতঙ্কে নীল হয়ে যাবে, আগুন দেখলেই সে আর্তনাদ করে উঠবে। একজন কিশোর ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট দিয়েছে। সেই বাড়িতে পুলিশ প্রহরা ছিল। কাজেই উত্তেজিত জনতা আরেক পাড়ায় হামলা করল। তাদের ‘অপরাধ’ তারা হিন্দু। কোনো যুক্তি দিয়েই তো এই জঘন্য অপরাধকে ব্যাখ্যা করা যায় না। সমাজের গভীরে কত ভয়াবহ জীবাণু দগদগ করলেই কেবল একডাকে জনতাকে ‘উত্তেজিত’, ‘বিক্ষুব্ধ’, বিধ্বংসী করে তোলা যায়! উত্তেজিত বটে, তবে টাকাটা, টেলিভিশনটা, গরুটা লুট করে নেওয়ার সময় হুঁশ কিন্তু ঠিকই টনটনে থাকে!
খবর ২.
সরেজমিন চাঁদপুর (প্রথম আলো, ২০ অক্টোবর ২০২১)। ফেসবুকে ঘোষণা দেওয়া হয়, সন্ধ্যায় হাজীগঞ্জ বিশ্বরোড থেকে আন্দোলন হবে। মুসলিম ভাইয়েরা জড়ো হন। কে দিয়েছে স্ট্যাটাস? চাঁদপুর পৌর এলাকার এক ছাত্রলীগ কর্মী! তার মা আওয়ামী লীগের সমর্থনে কাউন্সেলরও হয়েছিলেন। আর সন্ধ্যায় জড়ো হলো কারা? ‘সেখানে জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করে একদল কিশোর ও তরুণ।’ এখন তো দেশে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কাজেই যেখানেই যা হবে, ভালো কিংবা মন্দ, লীগওয়ালারা থাকবেই। এখন লীগওয়ালারা কি আসলেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন? মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, সাবেক মেয়র থেকে শুরু করে অনেক ধরনের লীগ, তাদের জাতীয় কমিটি থেকে পাড়া কমিটির কজন আসলে আমাদের সংবিধানের মূল চার নীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মর্মবাণী মর্মে ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী কজন পড়েছেন, কজন উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
১৯৪৭ সালে ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমাদের অসাম্প্রদায়িকতাবাদী আন্দোলন শুরু করতে হবে। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় বঙ্গবন্ধু ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ লিফলেট বিলি করে বেড়িয়েছেন, দাঙ্গার সময় একবার মাত্র তিনজনে মিলে বড় দাঙ্গাকারী দলকে ধাওয়া করে ছত্রভঙ্গ করেছেন, তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে হিন্দু পরিবারগুলোকে আশ্রয় দিয়েছেন। এই খবরে লক্ষ করুন, প্রথমে সমবেত হলো কিশোর আর তরুণেরা। আমাদের কিশোর আর তরুণদের জন্য আমরা ফেসবুক, ইউটিউব ছাড়া আর কী রেখেছি? সেখানে ক্রমাগতভাবে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, সহিংসতার ডাক! ভিডিওগুলো তো দেখা যায় না। অশিক্ষিত মানুষের বলদর্পী চিৎকার: ‘এখনই শেষ করে ফেলব! চলুন!’—এই হচ্ছে বেশির ভাগ জনপ্রিয় ভিডিও ক্লিপিংয়ের বার্তা। এর মধ্যে প্রায় দুই বছর ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ।
খবর ৩.
এই খবরও ২০ অক্টোবরের প্রথম আলোর। ‘চট্টগ্রামে মণ্ডপের তোরণ ভাঙচুর: ৬ মাস ধরে কারাগারে থাকা বিএনপির তিনজনও আসামি।’ মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!
এত বড় সাম্প্রদায়িক হামলা হলো, নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জাতিসংঘ নড়ে বসেছে, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজে সাড়া কই? ষাটের দশকে এই ধরনের ঘটনার প্রতিবাদে রাজনৈতিক দল থেকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা একযোগে রাস্তায় নামত, এরশাদের আমলে সাম্প্রদায়িক হামলার পর পুরো রাস্তা প্রতিবাদী মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল, এখন কেন নাগরিক সমাজ সাড়া দেয় না! এই প্রশ্নটা ভালোমতো ভাবা দরকার। সরকারের উন্নয়নের গাড়ি ছুটছে, কিন্তু তাতে মানুষ সওয়ার হতে পারছে কি? আমাদের সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর স্বাধীন কার্যক্রম আর দেখা যায় না! একটা ছাত্রসংগঠন ছাড়া আর কোনো ছাত্রসংগঠন দাঁড়াতে পারে না। করোনার শুরুর দিনগুলোতে যখন বিধিনিষেধ দেওয়া হলো, তখন বলেছিলাম, শুধু পুলিশ কিংবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে বলবে, নাকি মানুষকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে? কোথায় আমাদের স্থানীয় নেতারা, স্থানীয় সরকার, এলাকার সাংসদ, কাউন্সেলর, কোথায় আমাদের ধর্মীয় নেতারা, সামাজিক নেতারা, ছাত্র–যুবশক্তি! করোনাভাইরাসের চেয়েও সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাস ভয়াবহ। তার মোকাবিলাতেও তো সামাজিক শক্তিগুলোর বিকাশ এবং সমাবেশ দরকার। সেই বিকাশের স্বাধীন জল-হাওয়া-রোদ কই? নেই। নেই সংস্কৃতির চর্চা! নেই মুক্তচিন্তার চর্চা, নেই মন খুলে কথা বলার পরিবেশে! নেই বলেই আমাদের সমাজ হয়ে উঠছে বারুদের স্তূপ, আর আমরা বসে আছি তার ওপরে। যেকোনো সময় বড় প্রলয়কাণ্ড ঘটে যেতে পারে। চাঁদপুর, চৌমুহনী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, পীরগঞ্জ তারই পূর্বাভাস মাত্র।
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক