ভারতের নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের সবচেয়ে প্রহেলিকাময় অংশ ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গে। সম্ভবত, দলটি নিজেও এত ব্যাপক বিজয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের অতি খারাপ ফলও বিস্ময় জাগিয়েছে। অনেকে বলছেন, এই দুই ‘বিস্ময়’-এ ‘যোগসূত্র’ আছে—বামরা বিজেপিকে ভোট ছেড়েছে। এ নিয়ে সতর্ক অনুসন্ধান প্রয়োজন।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে বামপন্থীরা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী রাজনীতির বড় এক কেন্দ্র। যদি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির বিজয়ের কারণ হয় বামদের ভোট, সেটা অবশ্যই ভারতবর্ষে এক বড় রাজনৈতিক বার্তা। শতাব্দীপ্রাচীন একটি আদর্শবাদী ধারার রাজনীতির মর্মমূলে আঘাত হানে এই সন্দেহ।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য অনেক উপায় আছে। এখানে কেবল ভোটের হিসাবকে ভিত্তি করে প্রতীকী এক অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
বিজেপি ও বামফ্রন্টের বিস্ময়ভরা উত্থান-পতন
ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফল সবার জানা। ৪২ আসনে তৃণমূল পেয়েছে ২২টি, বিজেপি ১৮টি, কংগ্রেস ২টি। বামফ্রন্ট কোনো আসন পায়নি। অথচ এই রাজ্যে গত পাঁচ দশকে তারা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। অধিক আসন দখলে থাকায় তৃণমূলকে বিজয়ী মনে হলেও বাস্তবে সব অর্থেই জয়ী বিজেপি। আসনের ক্ষেত্রে তারা ২টি থেকে ১৮টিতে গেছে—ভোটের হিস্যায় ১৭ থেকে ৪০ ভাগে। অভাবনীয় বৃদ্ধি। বামফ্রন্টের আসনসংখ্যা ২ থেকে শূন্যতে চলে এসেছে। ভোটের হিস্যা নেমেছে ৩০ থেকে ৭ ভাগে।
প্রতীকী অনুসন্ধান
কিন্তু বামফ্রন্টের ভোটের নাটকীয় পতনের কারণ কী আর এই পতনের সঙ্গে বিজেপির ভোট বাড়ার সম্পর্ক আছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাঁচটি আসনের ফল বিশ্লেষণ করা হয়েছে নিচে। দৈবচয়ন পদ্ধতিতে আসনগুলো বাছাই হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী আসনের নাম বর্ণমালা অনুযায়ী যেভাবে সাজানো থাকে, সেটাকে মেনে ওপর থেকে পাঁচটি আসনকে অনুসন্ধানে নেওয়া হয়েছে।
আসন: আলিপুরদুয়ার
এখানে জিতেছেন বিজেপির জন বার্লা। ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন তৃণমূলের দশরথ টির্কে। পেয়েছেন ভোটের ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বামফ্রন্টের প্রার্থী পেয়েছেন ৪ শতাংশ।
পাঁচ বছর আগে এই আসনে তৃণমূলের প্রার্থী পেয়েছিলেন ভোটের ৩০ শতাংশ, বামফ্রন্ট ২৮ শতাংশ, বিজেপি ২৭ শতাংশ। তৃণমূলের ভোট এখানে সামান্য বেড়েছে। কিন্তু বিজেপির ভোট দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একইভাবে বামফ্রন্টের ভোট অভাবনীয়ভাবে কমে গেছে—শতকরা ২৭ ভাগ থেকে ৪ ভাগে। মূলত, এই ভোটই এখানে বিজয়ে নির্ধারক ভূমিকা পালন করেনি তো?
আসন: আরামবাগ
এখানে জিতেছেন তৃণমূলের অপরূপা পোদ্দার। তিনি ২০১৪ সালে ভোটের ৫৫ শতাংশ পান। এবার ৪৫ শতাংশ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির প্রার্থী ২০১৪ সালে পেয়েছিলেন ১২ শতাংশ ভোট, এবার ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ চার গুণ বৃদ্ধি। অন্যদিকে, বামফ্রন্টের প্রার্থী শক্তিমোহন মালিকের ভোট পাঁচ বছরের ব্যবধানে শতকরা ৩০ ভাগ থেকে ৭ ভাগে নেমে এল। কংগ্রেসের ভোট সামান্যও হেরফের হয়নি। পাঁচ বছর ব্যবধানে তাদের ভোটের হিস্যা ২ শতাংশই আছে। ভোট যা নড়চড় হয়েছে, তা বাম ও বিজেপি শিবিরে। কিছু ভোট যে তৃণমূলে গিয়েছে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। বরং তাদের কিছু ভোট কমেছে।
আসন: আসানসোল
গতবারের মতো বিজেপির বাবুল সুপ্রিয় জিতেছেন। এখানেও তৃণমূলের ভোট আগের ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ৩১ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু বাবুল সুপ্রিয়ের ভোট ৩৭ থেকে বেড়ে ৫১ শতাংশ হয়ে গেছে। পাশাপাশি সিপিএমের গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জির ভোট ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৭ শতাংশ। বাবুল সুপ্রিয়ের ভোট বেড়েছে ২ লাখ ১২ হাজার। সিপিএম প্রার্থীর ভোট কমেছে ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো। কংগ্রেসেরও ভোটও কমেছে ২০ হাজার মতো। স্পষ্টত, ফলাফল নির্ধারণ করেছে সিপিএমের বাক্সে না পড়া ভোট।
আসন: বহরমপুর
আমাদের দৈবচয়ন পদ্ধতিতে চতুর্থ আসন বহরমপুর। বামফ্রন্ট এখানে কংগ্রেসকে সমর্থন দিলেও জোটভুক্ত আরএসপি বিদ্রোহ করে প্রার্থী দেয়। এই জটিলতার কারণে আমরা এটাকে অনুসন্ধান থেকে বাদ দিচ্ছি। যদিও উল্লেখ করে রাখছি, এই আসনে ২০১৪ সালে আরএসপির প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের শতকরা ২০ ভাগ পেয়েছিল, এবার পেয়েছে ১ ভাগ মাত্র। কিন্তু এখানে কংগ্রেসের প্রার্থীর ভোট গতবারের ৫ লাখ ৮৩ হাজার থেকে মাত্র ৫ লাখ ৯১ হাজার হওয়া প্রমাণ করছে, বামপন্থীদের ভোট কংগ্রেসের দিকে যায়নি।
আসন: বালুরঘাট
বামফ্রন্টের গতবারের প্রার্থী পেয়েছিলেন ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ ভোট। এবার ৬ শতাংশ। বিজেপির প্রার্থী আগেরবার পেয়েছিলেন ২১ শতাংশ, এবার ৪৫ শতাংশ। তৃণমূলের ভোট এখানেও প্রায় স্থির। গতবার ৩৯ শতাংশ, এবার ৪২ শতাংশ। আসনটি নিয়েছে বিজেপি।
আসন: বনগাঁ
এখানে ২০১৪ সালে তৃণমূল ৪৩ শতাংশ ভোট পায়। এবার ৪১ শতাংশ। প্রায় একই অবস্থা কংগ্রেসের। তারা আগে পায় ৩ শতাংশ, এবার ২ শতাংশ। এই দুই দলের ভোটের উত্থান-পতন উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু সিপিএম আর বিজেপির দৃশ্যটি আগের আসনগুলোর মতোই। সিপিএমের প্রার্থী সেবার পেয়েছিলেন ৩২ শতাংশ, এবার ৬ শতাংশ। বিজেপির প্রার্থী আগে ১৯ শতাংশ, এবার ৪৯ শতাংশ।
বামফ্রন্ট আসনপ্রতি ২ লাখ ৬০ হাজার ভোট হারাল, বিজেপি বেশি পেল ২ লাখ ৯৩ হাজার করে!
পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের প্রথম ছয়টি থেকে বহরমপুরকে বাদ দিয়েছিলাম আমরা। সেখানে বামফ্রন্টের প্রার্থী ছিল না। বাকি পাঁচ আসনে দেখা গেছে, তৃণমূল ২০১৪ সালে ভোট পেয়েছিল ২৪ লাখ ২১ হাজার। সর্বশেষ নির্বাচনে পায় ২৬ লাখ ৭৪ হাজার ভোট। অর্থাৎ ২০১৪-এর প্রতি ১০০ ভোটে তার প্রায় ৯১টি রক্ষা করেছে। ৯ ভোট হারিয়েছে। আলোচ্য পাঁচ আসনে তাদের ক্ষতি ২ লাখ ৫২ হাজার।
বিজেপি ২০১৪ সালে পায় ১৩ লাখ ৮২ হাজার ভোট; এবার ৩২ লাখ ৫৬ হাজার ভোট। আগের প্রতি ১০০ ভোটকে তারা ২৩৬ ভোটে পরিণত করেছে। এই পাঁচ আসনে তাদের ভোট বেড়েছে ১৮ লাখ ৭৪ হাজার। তৃণমূলের হারানো আড়াই লাখের পুরোটা পেলেও বিজেপি আরও ১৬ লাখ ২২ হাজার বেশি ভোট পেয়েছে। সেটা কার? কংগ্রেসের? অংশত হতে পারে। তবে কংগ্রেসের ‘অবদান’ সামান্যই। উল্লিখিত পাঁচ আসনে তারা হারায় ১ লাখ ৫৭ হাজার ভোট। অর্থাৎ তৃণমূল ও কংগ্রেসের বাইরে থেকে বিজেপি পাঁচটি আসনে অন্তত ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ভোট বেশি পেয়েছে। আসনপ্রতি এটা প্রায় ২ লাখ ৯৩ হাজার।
বিজেপির এই ভোট কংগ্রেস ও তৃণমূলের না হওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, এটা সিপিএমের সাবেক কর্মী-সমর্থকদের ভোট। বলে রাখা ভালো, বাম সমর্থকেরা সচেতন না অবচেতনভাবে এই ভোট স্থানান্তর করেছেন, সেটা এই লেখায় মনোযোগ দেওয়া হয়নি।
আলোচ্য পাঁচ আসনে বামফ্রন্ট ভোট হারিয়েছে ১৩ লাখ। ২০১৪ সালে তারা এই পাঁচ আসনে পায় ১৭ লাখ ৬ হাজার ভোট। এবার পেয়েছে ৪ লাখ ৫ হাজার। আসনপ্রতি তাদের বাক্স থেকে গেছে ২ লাখ ৬০ হাজার ভোট।
অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রতি আসনে গড়ে ২ লাখ ৬০ হাজার ভোট হারিয়েছে আর বিজেপি গড়ে ২ লাখ ৯৩ হাজার করে ভোট বেশি পেয়েছে। যেহেতু এবার পশ্চিমবঙ্গে ভোটার ‘টার্ন আউট’ গতবারের মতো, সেহেতু বিজেপির প্রাপ্ত নতুন ভোট সিপিএমের পূর্বতন সমর্থকদের ভোট হিসেবে দেখার একটা জমিন রয়েছে।
পরিসংখ্যানে ‘মোদি–ঢেউ’ নেই
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে এরূপ অভিমত নজরে পড়েছে, এবারও ‘মোদি–ঢেউ’ কাজ করেছে ভোটে। এটা সত্য হলে কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোটেও টান পড়ত। কিন্তু আমরা তা দেখছি না। মোদি–ঢেউ কেবল বেছে বেছে বামফ্রন্টের ভোট কমাবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
পশ্চিমবঙ্গের অন্তত দুজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক—সৌমিত্র দস্তিদার ও অর্ক ভাদুড়ি বর্তমান লেখককে বলেছেন, এবারের নির্বাচনে সেখানে ‘হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ ঘটেছে’। অর্ক ভাদুড়ি বলেন, বামফ্রন্ট, তৃণমূল ও কংগ্রেসের হিন্দু ভোটের একাংশ পেয়েই বিজেপির ভোট বেড়েছে।
অপর একটি অভিমত রয়েছে, বামফ্রন্ট থেকে ছুটে যাওয়া হিন্দুরা বিজেপিকে ভোট দিলেও মুসলমানরা তৃণমূলকে দিয়েছে। অভিমতসমূহ বিতর্কযোগ্য। এরূপ হলে তৃণমূলের ভোট বেশ বাড়ত, যা হয়নি। মুসলমানপ্রধান অঞ্চলে অতীতের মতো কংগ্রেস দুটি আসন পেয়েছে। যেহেতু মুসলমানরা একচেটিয়া তৃণমূলে যায়নি এবং পুরো রাজ্যে এই দলের ভোট হিস্যা ৩-৪ শতাংশ বেড়েছে তাতে প্রমাণ হয়, হিন্দু ভোটাররা কমই তাঁদের ছেড়েছেন। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে ধর্মবাদী আদলে ভোট হয়েছে বলে পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দিচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে তৃণমূলের ভোটের হিস্যা অনেক কমে যেত। বরং ওপরের অনুসন্ধান বলছে, ভোট হয়েছে ‘তৃণমূল বনাম অন্য সকলে’। বামফ্রন্টের সাবেকরা বেশি হারে ‘অন্য সকল’ভুক্ত হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর তাতে বিজয়ের হাসি হেসেছে বিজেপি।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক।