বাবা গুরমিত রাম রহিম সিং খালিস্তান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ভিনদ্রানওয়ালের মতো হয়ে উঠছিলেন। তিনিও এটা নিশ্চিত করেছিলেন, যাতে কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস না পায়। কিন্তু তিনি কাগুজে বাঘ হয়ে গেলেন। সিবিআই আদালতের বিচারক যখন তাঁর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন, তখন বাবা প্রকাশ্য আদালতে কাঁদতে শুরু করেন এবং আদালতকে অনুরোধ করেন, যাতে তাঁকে কঠোর শাস্তি না দেওয়া হয়। জানা যায়, তাঁর অনুসারীরাও বাবার এ রকম ধসে পড়ায় বিস্মিত হয়েছেন।
কিন্তু বাবার যে বিপুলসংখ্যক অনুসারী আছেন, তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। তিনি দুজন সাধ্বীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, সেটা তাঁদের কাছে ব্যাপার না। এতে বোঝা যায়, এই অনুসারীরা কতটা অন্ধ ও সহজ-সরল। এঁরা সব সময় নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনার জন্য এই ব্যক্তির দ্বারস্থ হতেন। একইভাবে ভিনদ্রানওয়ালেও বিপুলসংখ্যক অনুসারী নিয়ে ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর এত ভক্ত ছিল যে তিনি যা-ই করতেন, সরকার তাঁর ব্যাপারে চোখ বুজে থাকত।
এখন তো তাঁর গুরুতর শাস্তি হয়ে গেছে। ফলে সম্ভাবনা আছে, তাঁর ডেরার নানা কোনা থেকে আরও অনেক কঙ্কাল বেরিয়ে আসতে পারে। সিবিআই আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলার শুনানি হচ্ছে। আগে হোক বা পরে, আদালত ওসব মামলার রায় দেবেন। ডেরায় সাধুদের খোজা করে দেওয়া হতো বলেও জানা গেছে, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব ঘটনা থেকে বাবার মনোভাব কেমন ছিল, তা বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, কর্তৃপক্ষও এসবে জড়িত ছিল।
ভিনদ্রানওয়ালে ও বাবা রাম রহিমের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। প্রথমজন যদি কংগ্রেসের সৃষ্টি হন, তাহলে দ্বিতীয়জন হরিয়ানা রাজ্যের বিভিন্ন সরকারের আনুকূল্য পেয়েছেন, যার মধ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপিও আছে। বাবা রাম রহিম ভিনদ্রানওয়ালের মতো অতটা জঙ্গি ছিলেন না, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। অর্থাৎ রাজনীতিকেরা তাঁর প্রতি যে ঔদার্য দেখিয়েছেন, তিনি সেটা ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করেছেন। এটা ছাড়া তাঁর পক্ষে এত সম্পদ জোগাড় করা এবং পৃথিবীব্যাপী ১৩২টি ডেরা নির্মাণ করা সম্ভব হতো না। এমনকি তিনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রেও ডেরা বানিয়েছেন।
১৯৭৭ সালে পাঞ্জাবে আকালি-জনতা পার্টি সরকার ক্ষমতায় আসার পর আকালিরা রাজ্যে প্রভাবশালী হতে শুরু করে। তারা সেখানে কংগ্রেসের ভিত দুর্বল করে দেয়। ওই সময় সঞ্জয় গান্ধী ও জৈল সিং আকালিদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্য ভিনদ্রানওয়ালেকে বাছাই করেন। তিনি এত ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন বুঝলেন যে তাঁকে সরাতে হবে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নামিয়ে তাঁকে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির থেকে বের করা ছাড়া উপায় ছিল না।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক ব্যবহারের অনুমতি নেওয়ার জন্য মধ্যরাতে ইন্দিরা গান্ধীর ঘুম ভাঙায়। তো ইন্দিরা গান্ধী শেষমেশ মন্দিরের পবিত্র ভূমিতে সেনা পাঠিয়ে মারাত্মক ভুল করে বসেন, সময়টা ছিল ১৯৮৪ সালের জুন মাস। ভিনদ্রানওয়ালে মারা গেলেও অপারেশন ব্লু স্টার নিয়ে শিখদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তাতে ওই ঘটনার চার মাসের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীকে জীবন হারাতে হয়।
একইভাবে, বাবা রাম রহিম বিজেপির সমর্থন পেয়েছিলেন, কারণ এটা দলটির ভোট ব্যাংকের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। বাবা ২০১৪ সালের লোকসভা ও হরিয়ানা রাজ্যসভার নির্বাচনে বিজেপিকে সমর্থন দেন। তিনি পাঞ্জাবে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গেরুয়া দলকে সমর্থন দেন, যদিও তাতে কাজ হয়নি। গুজব আছে, হরিয়ানার ক্ষমতাসীন মনোহর লাল খাত্তারের পুরো মন্ত্রিসভা মুখ্যমন্ত্রীকে ছাড়া বাবার ডেরা পরিদর্শন করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে এতে অন্য দলের দায় নেই। ২০০৯ সালে ডেরাপ্রধান কংগ্রেসকে সমর্থন দেন। ব্যাপারটা হলো, ২০০৭ সালে কংগ্রেস তাঁকে যে জেড প্লাস নিরাপত্তা দেয়, তার পুরস্কারস্বরূপ তিনি সেবার কংগ্রেসকে সমর্থন দেন। বাবা কতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন তা বোঝা গেল তখন, যখন তাঁর নিজস্ব সেনাদের সামনে রাজ্য পুলিশের হঁাটু কাঁপা শুরু হলো। হরিয়ানা রাজ্য ইচ্ছাকৃতভাবে ১৪৪ ধারা জারি করেনি, এর মধ্যে তারা খুনিদের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে শীতল আমন্ত্রণ পাঠায়। শেষমেশ আদালতের নির্দেশে তারা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।
ইতিহাসের যখন পুনরাবৃত্তি ঘটে, তখন সে যেন আমাদের ব্যবস্থা নিয়ে তামাশা করে। কারণ, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। এই যে এত মানুষ মারা গেল এবং সরকারি সম্পদ ধ্বংস হলো, তার দায় কে নেবে? কিন্তু বিজেপি হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী খাত্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি, কারণ তাঁর পেছনে আরএসএসের সমর্থন আছে। অর্থাৎ ভারতে এই ঈশ্বরমানবদের সামাল দেওয়া এবং তাঁদের প্রতি সরকারের সমর্থন বন্ধ করাটাই বড় ব্যাপার। তাঁরা হয়তো ভোট ব্যাংক জোগান দেয়, কিন্তু রাষ্ট্রের অপূরণীয় ক্ষতি করে দেয়।
গণতন্ত্রে ভোটারদের সঙ্গে দলের সরাসরি যোগাযোগ থাকতে হয়। কিন্তু এর মধ্যে এই বাবারা এসে পড়েন, যাঁরা সমান্তরাল কর্তৃপক্ষ হয়ে ওঠেন। অন্য কোনো শক্তি যখন ব্যালট বাক্স আটকে দেয়, তখন গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়। সে কারণে যে ব্যবস্থা জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে চলে, সেখানে এসব ঈশ্বরমানবের স্থান নেই। তাঁদের যত বাড়বাড়ন্ত হবে, মুক্তবাকের স্বাধীনতা ততই খর্ব হবে।
ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, ফলে রাম রহিমের মতো বাবারা যত দিন আধ্যাত্মিকতা প্রচার করবেন, তত দিন সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁরা যখন অবৈধ কাজ ও জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখনই সমস্যা। এমনকি তাঁরা ধর্ষণ ও হত্যার মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়েন। আর রাজনৈতিক দলগুলো যখন স্বীয় স্বার্থের জন্য তাঁদের সমর্থন দেয়, তখন ব্যাপারটা একদম নোংরা হয়ে যায়।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।