মতামত

বাপেক্সের গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশিদের না বলুন

ভোলা গ্যাসক্ষেত্র
ছবি : সংগৃহীত

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে যে আদর্শ সামনে রেখে এগিয়েছিলেন, তার মূলমন্ত্র ছিল আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠা। তিনি জ্বালানি সম্পদে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার গুরুত্ব যে কতটা অনুধাবন করতেন, তার সাক্ষ্য বহন করে বহুজাতিক বিদেশি তেল কোম্পানির কাছ থেকে বিরাট মজুতের গ্যাসসম্পদ নিজের হাতে নিয়ে নেওয়ার চুক্তি। আমাদের কর্মযজ্ঞে বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ উজ্জীবিত থাকবে, এটি সবার কাম্য।

বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে ভোলা দ্বীপে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানে জাতীয় তেল গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি বাপেক্স পুরোপুরি নিজস্ব সক্ষমতায় যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা যেন স্বনির্ভরতার আদর্শকে ধারণ করারই সাক্ষ্য। ১৯৯৫ সালে বাপেক্স এখানে শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। পরে ভোলা দ্বীপে আরও গ্যাস আবিষ্কার করার সম্ভাবনা খুঁজতে বাপেক্স দ্বীপটি বরাবর ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ চালায় এবং জরিপ থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নতুন কূপের স্থান শনাক্ত করে। ২০১৭ সালে সেখানে কূপ খননের মাধ্যমে দ্বিতীয় একটি গ্যাসক্ষেত্র ‘ভোলা নর্থ’ আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কার জাতীয় কোম্পানির কর্মীদের আত্মনির্ভরতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে।

এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধানের বর্তমান চ্যালেঞ্জ হলো কূপ খননের স্থান নির্ধারণে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করা এবং নির্ধারিত স্থানে অনুসন্ধান কূপ খনন করা। এর প্রথমটিতে বাপেক্সের দক্ষতা প্রমাণিত হয় ভোলায় দ্বিতীয় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি তথা ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপে প্রাপ্ত উপাত্তের সঠিক বিশ্লেষণ বাপেক্সের কারিগরি দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। আর কূপ খননে বাপেক্সের দক্ষতা ও সফলতা বাংলাদেশে শুধু ভোলা দ্বীপেই নয়, দেশে ইতিমধ্যে আটটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। এসব কারণে বাপেক্স পেতে পারে অনুপ্রেরণা, সমর্থন এবং অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা।

দুঃখের বিষয়, ভোলার গ্যাসের ক্ষেত্রে বাপেক্সের ভাগ্যে এসবের কিছুই জোটেনি; বরং অনুপ্রেরণার পরিবর্তে জুটেছে হতাশা, সমর্থনের বদলে বিরোধিতা আর পৃষ্ঠপোষকতার বদলে অবহেলা। বাপেক্সকে নিজের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন করতে না দেওয়ার ফলে বাপেক্সে জন্ম নিয়েছে হতাশা। মাঠপর্যায় থেকে বাপেক্সকে কার্যত সরানো হয়েছে, আর এ কাজ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিদেশি কোম্পানি গাজপ্রমকে। ইতিমধ্যে এ লক্ষ্যে সরকারি উচ্চপর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি মন্ত্রিসভা কমিটিতে পেশ করা হয়েছে এবং তারপর প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে।

কিন্তু জাতীয় সক্ষমতা, জনবল ও আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নে বিদেশি কোম্পানিকে এনে কাজে নামানোর যৌক্তিকতা কী হতে পারে। এটি কি এমন যে গাজপ্রম অপেক্ষাকৃত কম খরচে কূপগুলো খনন করে দেবে। কিন্তু তা তো নয়। গাজপ্রম প্রতি কূপ খনন করতে ২১ মিলিয়ন ডলার বা ১৮০ কোটি টাকা নেবে, যেখানে জাতীয় কোম্পানি বাপেক্স প্রতি কূপ খনন করতে খরচ করে ৮০ থেকে ৯০ কোটি টাকা। অথবা বিষয়টি কি এমন যে গাজপ্রম যে কূপ খনন করে, তা অন্যদের খনন করা কূপের তুলনায় টেকসই ও মজবুত বেশি। কিন্তু তা–ও নয়। গত পাঁচ বছরে এই কোম্পানি দেশে যে কটি কূপ খনন করেছে, তার মধ্যে একাধিক কূপে পরবর্তী সময়ে কারিগরি সমস্যা দেখা দেয় এবং এসব সমস্যা বাপেক্সের কারিগরি দলই সমাধান করে কূপ পুনরায় চালু করে। গাজপ্রম কূপ খননের চুক্তি করে বটে, কিন্তু এ কোম্পানি নিজে কূপ খনন করে না বরং মধ্য এশিয়ার কোনো খনন কোম্পানিকে কূপ খনন করতে কাজ দেয়। তাহলে এই কোম্পানি টেবিলে বসে চুক্তি স্বাক্ষর করে কেবল ঠিকাদারি ব্যবস্থাপনা করার জন্য এ দেশে আসে—প্রশ্নের উত্তরটি বুঝে নেওয়া সহজ।

বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত হওয়ার জন্য সাধারণত প্রতিযোগিতামূলক যাচাই-বাছাই পর্ব পেরিয়ে আসে। তবে গাজপ্রমের সঙ্গে এই চুক্তি কোনো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়নি, বরং তা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের (বিশেষ বিধান) আওতায় সম্পাদন করা হয়। রাশিয়া বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ। কিন্তু একই সময় রাশিয়ার অন্য অন্তত দুটি রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানিকে দেশের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার গ্যাস অনুসন্ধান ও উন্নয়ন প্রকল্পে যোগ দেওয়ার জন্য অন্যান্য আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হচ্ছে। একই দেশের একাধিক কোম্পানির মধ্যে একটির প্রতি এহেন পক্ষপাতিত্বের কারণ কী? কী কারণে একটি বিশেষ কোম্পানি বিশেষ সুবিধার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে পাওয়া যায় না।

২০০৩ সালে জাতীয় কোম্পানির অধীনে সিলেটের ছাতক গ্যাসক্ষেত্র অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে কানাডার নাইকো কোম্পানিকে দেওয়া হয়। নাইকো ২০০৫ সালে কূপ খনন করতে গিয়ে বিস্ফোরণ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও পরিবেশ বিনষ্ট করে রাষ্ট্রের বিরাট ক্ষতি সাধন করে। পরবর্তী সময়ে কানাডার আদালতে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে নাইকোকে বাংলাদেশে দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিস্ফোরণটি না ঘটলে নাইকোকে আদালতে যেতে হতো না এবং নাইকোর দুর্নীতির কুশীলবদের তথ্য বেরিয়ে আসত না। অনেক ক্ষেত্রেই অনৈতিক-অন্যায্য চুক্তি লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়; তার অন্দরমহলের কুশীলবেরা থাকে নিশ্চিন্তে।

সরকারি প্রশাসন প্রায়ই দাবি করে যে তারা তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জাতীয় কোম্পানিকে দক্ষ অভিজ্ঞ করে গড়ে তুলতে সর্বতোভাবে সহায়তা করার পক্ষে। কিন্তু ভোলা দ্বীপে জাতীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি বাপেক্স সম্পূর্ণ নিজস্ব সক্ষমতায় গ্যাস আবিষ্কারের যে ধারার সূচনা করেছে, তা বিকাশ হতে না দেওয়া আত্মঘাতী হওয়ার শামিল।

ভোলায় দুটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করার পর বাপেক্স তার ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানসূত্রে মত প্রকাশ করে যে এ দ্বীপ এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আরও গ্যাস থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে। সিলেট অঞ্চল যেমন গ্যাসসম্পদে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ, তেমনি ভোলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চল বলে প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। এই অবস্থায় বাপেক্সকে ভোলায় খনন ও অনুসন্ধানকাজ করতে না দিয়ে বিদেশি কোম্পানিকে অস্বচ্ছ চুক্তির বিনিময়ে নিয়োগ করা জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করবে।

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ব্রিটিশ-ডাচ তেল কোম্পানি শেল অয়েলকে বাংলাদেশে তাদের আবিষ্কৃত ও পরিচালিত পাঁচটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাসটিলা ও বাখরাবাদ জাতীয় কোম্পানির কাছে দিয়ে চলে যেতে রাজি করান এবং নামমাত্র মূল্যে গ্যাসক্ষেত্র ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত করেন। বঙ্গবন্ধু এ কাজের মধ্য দিয়ে জাতিকে এ শিক্ষাই দিয়েছিলেন যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের সম্পদ গড়ে তোলা এবং তাতে নির্ভর করাই অর্থনৈতিক মুক্তির প্রকৃত পথ। আমরা কোনোভাবেই সে পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারি না।

বদরূল ইমাম : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ