শারদোৎসবের এই দিনগুলোয় বাঙালির মন যখন ফুরফুরে, আকাশ-বাতাসে ভর দিয়ে প্রকৃতি যখন অপরূপা, সবার মনে আনন্দ বইছে কুলকুল করে, আমার মন তখন ভারাক্রান্ত। বাতাসে শিউলির বদলে হঠাৎই বারুদের গন্ধ! হাটে-ঘাটে-বাটে যেখানেই যার সঙ্গে দেখা, একটাই প্রশ্ন, যুদ্ধ কি তাহলে বাধবেই? রাজনীতিকদের মন বোঝাও বেশ দায়। তবু যেহেতু এই দুনিয়ায় পাগলের চেয়ে সুস্থ মানুষের সংখ্যা বেশি, তাই বুক ঠুকে আশ্বাস দিই। বলি, না না। তাই কখনো হয় নাকি? দুটোই যে পরমাণু শক্তিধর দেশ!
মনটা কেন ভারাক্রান্ত, তা বলার আগে কয়েকটা নাম উচ্চারণ করি। সাইফ আলী খান, ওম পুরী, অনুরাগ কাশ্যপ, অনুরাগ বসু, নাগেশ কুকুনুর, করণ জোহর, রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা, মহেশ ভাট, রণবীর কাপুর, কৈলাস খের, বরুণ ধাওয়ান, সালমান খান। তাঁরা ছাড়াও রয়েছেন অনেকে। তাঁরা এই মুহূর্তে ‘ভিলেন অব দ্য পিস’। কিংবা গোদা বাংলায় তাঁরা সবাই মোটামুটি ‘পাকিস্তানের দালাল’।
বাংলাদেশের মানুষজনের কাছে এই নামগুলো মোটেই অপরিচিত নয়। অবধারিত প্রশ্ন তাই, তাঁরা কী করলেন যে পাকিস্তানের দালাল হয়ে গেলেন? সংক্ষিপ্ত উত্তর, পাকিস্তানি অভিনেতা, অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের মুম্বাইয়ের সিনেমাশিল্পে কাজ করতে না দেওয়ার যে ফতোয়া রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) জারি করেছে, তাঁরা সবাই কোনো না কোনোভাবে তার সমালোচনা করেছেন! অতএব...।
ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের রসায়ন যখনই গুলিয়ে যায়, অর্বাচীন কিছু মানুষ তখনই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তারা নানাভাবে তাদের দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে থাকে। কখনো কোপ পড়ে ক্রিকেটের ওপর, কখনো বা বিনোদনের জগতে। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল এই অর্বাচীনের দল কতবার ক্রিকেটের পিচ খুঁড়েছে, দুদেশের টেস্ট ম্যাচের আগের রাতে উইকেটে জল ঢেলে দিয়েছে, আমাদের জানা। এবার উরি-হামলার পর এদের ফরমান, পাকিস্তানের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মুম্বাইয়ে কাজ করা চলবে না। গায়ক-গায়িকাদের গান করা বন্ধ করতে হবে। এমনকি এই ধরনের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে, কোনো সিনেমায় পাকিস্তানের কেউ যদি কিছুটা কাজ করেও থাকেন, তাহলে তাঁকে বাদ দিয়ে ভারতীয় কাউকে দিয়ে সেই কাজ করানো হোক।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মুম্বাই ছেড়ে অনেকেই পাকিস্তানে চলে গেলেন! তাঁরা সবাই হয় শিল্পী, নতুবা টেকনিশিয়ান, সিনেমা বা টেলিভিশনের মেগা সিরিয়ালে কাজ করছিলেন। একটা ছেলে, ফাওয়াদ খান, ভারি সুন্দর অভিনয় করেন। আর একজন আলী জাফর। দুজনেই ভারতীয়দের মনে পাকা জায়গা করে নিয়েছেন। দুজনেই দেশে ফিরে গেছেন। চমৎকার গান করেন যাঁরা, যেমন আতিফ আসলাম, শফকত আমানত আলী, কিংবা রাহত ফতে আলী খান, কোপ পড়েছে তাঁদের ঘাড়েও। তাঁদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সিনেমাতেও তাঁদের গাইতে দেওয়া হচ্ছে না। কেই-বা আর যেচে ঝামেলা ডেকে আনতে চায়!
রাজার চেয়ে পারিষদেরা সব সময়ই বেশি কথা বলে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। মুম্বাইয়ের প্রযোজকদের সংস্থা ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন বা ‘ইমপা’ সঙ্গে সঙ্গেই নড়েচড়ে বসল। তারাও জানিয়ে দিল, ভবিষ্যতে তারা আর কোনো পাকিস্তানি শিল্পী ও কলাকুশলীকে কাজে নেবে না। বলল, তাদের কাছে ‘সবার আগে দেশ’।
যে নামগুলো এই লেখার শুরুতে লিখেছি, তাঁরা সবাই মোটামুটিভাবে এই ফরমানের সমালোচনা করেছেন। সইফ আলী খান বললেন, পৃথিবীর সব দেশের ট্যালেন্টদের জন্যই ইন্ডাস্ট্রির দরজা খোলা রাখা দরকার। বিশেষ করে সীমান্ত পারের প্রতিবেশীদের জন্য। সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানকে সব সময়ই উৎসাহ দেওয়া উচিত। করণ জোহর বললেন, পাকিস্তানি শিল্পীদের কাজ করতে না দেওয়াটা যদি সমাধানসূত্র হয়, তাহলে তা হোক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটা সমাধানের সূত্র নয়। রণবীর কাপুর বললেন, সময়টা কঠিন। তবে তিক্ততা ও নেতিবাচক আবহে গা ভাসানো ঠিক নয়। ওম পুরী বললেন, পাকিস্তানি শিল্পীদের থাকতে দিলে বা ভাগিয়ে দিলে অবস্থার বিন্দুমাত্র হেরফের ঘটবে না। গায়ক কৈলাস খের জানালেন, পাকিস্তানি শিল্পীরা কেউই ভারতবিরোধী কোনো প্রচার করছেন না। তা ছাড়া কোনো শিল্পীই হিংসা ছড়ান না। বরং মনের সঙ্গে মন জোড়েন।
এই বিতর্কের মধ্যেই বোমা ফাটালেন সালমান খান। সালমান ও বিতর্ক যেন সমান্তরাল রেললাইন। উরি আক্রমণের পর ভারতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে সমর্থন করে তিনি বললেন, সরকার ঠিক কাজই করেছে। কারণ, আঘাতটা হানা হয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের ওপর। এর পরই অবধারিতভাবে ধেয়ে আসে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। সালমান বলেন, আর্টিস্টরা টেররিস্ট নন। আর্টিস্টরা টেররিস্ট হলে সরকার তাঁদের ভিসা দিত না। মুম্বাইয়ে যে শিল্পীরা কাজ করেন, সরকার তাঁদের ভিসা দেয়। কাজের অনুমতিও দেয়। টেররিস্ট হলে তাঁদের সেই অনুমতি নিশ্চয় দেওয়া হতো না।
দেশপ্রেমের দাউ দাউ আগুনের জ্বলে ওঠার সেই শুরু। রে রে করে উঠেছে চরম হিন্দুত্ববাদীরা। তাঁদের সবার কপালে ‘পাকিস্তানি দালাল’-এর তকমা এঁটে নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। হাওয়া বেশ গরম।
সরাসরি যাঁরা এই ধরনের ফতোয়ার বিরোধিতা করেছেন, তাঁরা আপাতত একঘরে। যাঁরা করেননি, তাঁদের মধ্যে স্পষ্ট দুটো ভাগ দেখতে পাচ্ছি। একটা ভাগে রয়েছেন অনুপম খের, হেমা মালিনীদের মতো অনেকে, যাঁরা সরাসরি শাসক বিজেপির সঙ্গে যুক্ত কিংবা রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদী। হেমার কথা, ‘আমি এক শ ভাগ আমাদের জওয়ানদের সঙ্গে আছি। পাকিস্তানি শিল্পীদের কাজ একজন শিল্পী হিসেবে পছন্দ করি। তবে তাঁরা এ দেশে থাকবেন কি না, সে বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।’ কেউ কেউ আবার বলছেন, পাকিস্তানি শিল্পীরাও তো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারেন। কই, তাঁরা তো তা করছেন না?
তাঁদের পাশাপাশি দেখতে পাচ্ছি এমন কিছু অতিপরিচিত মুখ, যাঁরা চিরকালই এই ধরনের বিতর্ক থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আয়ত্ত করেছেন। যেমন অমিতাভ বচ্চন। এখনো কেউ এই বিষয়ে তাঁর মুখ খোলাতে পারেনি! তিনিও বলতে আগ্রহী নন। প্রতিদিন নিয়ম করে তিনি ‘ব্লগ’ লেখেন। তাঁর বিবেক এই ফরমানে এপাশ-ওপাশ কোনো পাশেই আন্দোলিত হয়ে ওঠেনি!
এসব দেখে-শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। বিষিয়েও গেছে। ভারতীয় সেনাদের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’কে কেন্দ্র করে যেভাবে অযথা প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে রাজনৈতিক কাজিয়া শুরু হয়েছে, তা আরও মারাত্মক। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রেস কনফারেন্স হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। করলেন ভারতের ডিজিএমও লে. জেনারেল রণবীর সিং। আগাগোড়া পাশে বসে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ। রণবীর সিং খুবই নিখুঁতভাবে সেই ‘সফল অভিযানের’ বর্ণনা দিলেন। কিন্তু সাংবাদিকদের একটিও প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রেরা এরপর গোটা দিন ধরে অভিযানের খুঁটিনাটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে দিলেন। সারা দেশ ধন্য ধন্য করতে লাগল। পাকিস্তানের উরি নামক ইটের জবাব সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নামক বোমার মধ্য দিয়ে যাঁরা দিয়েছেন, সেই সেনানীদের ওপর দেশবাসী পুষ্পবৃষ্টি শুরু করলেন। পাড়ায় পাড়ায় দেশাত্মবোধের একটা ফল্গু বইতে লাগল। পাশাপাশি পাকিস্তান বলতেই থাকল, ভারতীয় বাহিনী মোটেই সীমান্ত পেরিয়ে হামলা করেনি। যা হয়েছে তা নিয়ন্ত্রণরেখার ওধার থেকে রুটিন গোলাগুলি।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে শুরু রাজনৈতিক চাপান-উতরের। প্রথমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তারপর পি চিদাম্বরম, সঞ্জয় নিরুপম এবং অবশেষে গোটা কংগ্রেস পার্টি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের রাজনীতিকীকরণের সমালোচনায় মুখর হলেন। তাঁরা দাবি জানালেন, পাকিস্তানকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে অভিযানের ছবি প্রকাশ করা হোক। রাহুল গান্ধী সরাসরি বললেন, সেনানীদের কৃতিত্বকে বিজেপি রাজনৈতিক স্বার্থে হাতিয়ার করছে। সেনাদের সঙ্গে দলের নেতাদের ছবি দিয়ে পোস্টার-হোর্ডিং টাঙানো হয়েছে দেশজুড়ে। সেনাদের কাঁধে বন্দুক রেখে বিজেপি দালালি শুরু করেছে।
পাল্টা রে রে করে উঠেছে বিজেপি। দলের সভাপতি অমিত শাহ বললেন, রাহুল গান্ধী সেনাদের কৃতিত্বকে সন্দেহ করছেন। কোথায় তিনি গর্ববোধ করবেন তা না, পাকিস্তানিদের সুরে কথা বলছেন! রাজনীতির চরিত্র হয়তো এমনই। এই রাজনীতি কুটোটি নেড়ে কার উপকার করছে, বুঝি না। দেশের সেনানীদের নিয়ে এই টানাপোড়েন কার কাজে আসে, জানি না। শুধু জানি, মন, পরিবার, সমাজ ও দেশ এভাবেই দ্বিখণ্ডিত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন অশান্তির।
নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি আমার খুব প্রিয় অভিনেতা। উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগরের বুধানা গ্রাম থেকে সেই কত বছর আগে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন অভিনেতা হবেন বলে। দুই দশক ধরে ভিখিরি বা চোর কিংবা পকেটমার অথবা হাবিলদারের মতো অকিঞ্চিৎকর পার্ট করে পেট চালাতে চালাতে সুজয় ঘোষের কাহানি হঠাৎই তাঁর ভাগ্য খুলে দেয়। আজ তিনি ‘স্টার’।
নওয়াজউদ্দিনের আজীবনের স্বপ্ন, তাঁর গ্রাম বুধানার রামলীলায় অভিনয় করার। সেই শৈশব থেকে লালিত স্বপ্ন এবার সত্যি হতে হতেও হলো না। রামলীলায় ‘মারীচ’ সেজেছিলেন তিনি। সেই মারীচ, যে সোনার হরিণ সেজে রাবণকে সীতা হরণে সাহায্য করেছিল। রামের তিরে বিদ্ধ হয়ে যার প্রাণ যায়। দিন কয়েক রিহার্সালও হলো। কিন্তু হায়, চায়ের কাপ ও ঠোঁটের ব্যবধানও যে বিপুল হয়ে ওঠে, নওয়াজউদ্দিন তা টের পেলেন। স্থানীয় শিব সৈনিকদের আপত্তিতে ‘হিন্দু’দের রামলীলায় ‘মুসলমান’ নওয়াজের ‘মারীচ’ হওয়া আর হলো না। স্বপ্ন ভেঙে খান খান! অথচ এই দেশটার আনাচে-কানাচে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে যুগ যুগ ধরে রামলীলা করে আসছেন!
শরতের নীল আকাশ, মিহি বাতাস, সাদা মেঘ, ঝকমকে রোদ্দুর, শিউলির ঘ্রাণ, কাশফুলের মোলায়েম পরশ মনকে ফুরফুরে করে তোলে। শারদোৎসব মানুষকে ডাকে, আয়, কাছে আয়। তেপান্তরের মাঠ পেরোনো সেই ডাক ছাপিয়ে কেন যেন কু গাইছে মন। মনটা ভার হয়ে রয়েছে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।