জাতীয় সংসদে ঘোষিত বাজেট প্রস্তাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আর রাজস্ব আয়ের বড় লক্ষ্য সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘টাকা কোথা থেকে আসবে, সে চিন্তা আমরা করিনি।... অর্থ যা–ই লাগবে, সেটা জোগাড় করা হবে।’
কী উপায়ে আয় হবে আর কীভাবে তা ব্যয় করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা দরকার। দরকার জনগণের অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
অর্থসংস্থানের পরিসর সংকুচিত হবে
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ও যৎসামান্য বিদেশি অনুদানসহ বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, জিডিপির ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত পাঁচটি অর্থবছরে এনবিআর কর রাজস্ব আদায় করেছে গড়ে জিডিপির ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।
অর্থনীতির চলমান সংকোচনকালে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর সন্দেহ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৭৪ শতাংশ রাজস্ব সংগ্রহ করতে পেরেছে। ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ এক গবেষণায় দেখিয়েছে, করোনার কারণে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ কমে যাবে। বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা বা জিডিপির ২ দশমিক ৪০ শতাংশ আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রকৃত বাজেটের হিসাব অনুযায়ী গড়ে বৈদেশিক ঋণ এসেছে জিডিপির শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ। এভাবে কর আদায় কমে যাওয়ায় এ বাজেট পুরো বাস্তবায়িত হতে হলে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অতিমারি প্রলম্বিত হলে আরও বাড়বে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৯ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা বা জিডিপির ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ থেকে অনেক বেশি ঋণ করতে হবে।
উন্নয়ন অন্বেষণ হিসাব করে দেখিয়েছে, বাজেটে প্রস্তাবিত ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগ অর্জন করতে হলে অতিরিক্ত ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের গৃহীত ঋণ ইতিমধ্যে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে আগের বছরের তুলনায় ১৩৮ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছে। ফলে অর্থসংস্থানের পরিসর (ফিসক্যাল স্পেস) সংকুচিত হবে; ফলে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি ইত্যাদি খাতে প্রস্তাবিত যৎসামান্য বরাদ্দ সংস্থান করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
জনগণের অর্থে জনগণের নিয়ন্ত্রণ নেই
বাজেটের আয় ও ব্যয় জনগণের অর্থ। অর্থ ব্যবস্থাপনায় জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। প্রক্রিয়াটি আমলাতান্ত্রিক, নির্বাহী বিভাগের একক নিয়ন্ত্রণে। অনেক কারণ আছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। প্রথমত, সংসদীয় পদ্ধতিতে জনগণ সংসদকে তার পক্ষে কাজ করতে নিয়োজিত করে। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটির অর্থবিল যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। নির্বাহী বিভাগের সুপারিশ ছাড়া অর্থবিল উত্থাপন করা বা উত্থাপিত বিলে কোনো নতুন প্রস্তাব রাখার সুযোগ নেই। সংসদ বাজেট পুরো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে, কিন্তু পরিবর্তন করতে পারে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাংসদেরা দলের মতের বাইরে ভোট দিতে পারেন না বিধায় বাজেট বর্জনের উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন বাজেট–সম্পর্কিত তথ্য–উপাত্ত পেতে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বছর বার্ষিক অর্থনৈতিক সমীক্ষাও প্রকাশ করা হয়নি। ফলে কী পরিস্থিতি, হিসাব ও অর্থনৈতিক সূচকের ওপর ভিত্তি করে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। তৃতীয়ত, কী প্রক্রিয়ায় বাজেট সংশোধন করা হয়, তা নিয়েও নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। বিভিন্ন খাতে কেন ব্যয় বাড়ল বা কেন বরাদ্দ অর্থের পূর্ণাঙ্গ ব্যয় সম্ভব হয়নি, তার জবাবদিহির সুযোগ নেই। উদাহরণস্বরূপ, সংশোধিত বাজেটের আকার ছোট হলেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ অর্থের আকারে খুব বেশি হেরফের হয়নি। যদিও গত অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এডিপির মাত্র ৩৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছিল। চতুর্থত, গোষ্ঠীস্বার্থে স্ট্যাটিউটরি রেগুলেটরি অর্ডার (এসআরও) দিয়ে কর দাক্ষিণ্য বিতরণ করা হয়। পঞ্চমত, অর্থনীতিতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির বড় ধরনের প্রভাব থাকলেও সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। ষষ্ঠত, আইনের মাধ্যমে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ঋণচুক্তিতে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজকর্ম জবাবদিহির বাইরে থেকে যাচ্ছে। সপ্তমত, বাজেট প্রক্রিয়ায় সংসদীয় পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের খুব সুযোগ নেই। বছর শেষে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিরীক্ষিত হিসাবের ওপর ভিত্তি করে সংসদের সুপারিশ করা ছাড়া কোনো জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই।
প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক বাধা গোষ্ঠীতন্ত্র
এবারও বাজেটে গোষ্ঠীতন্ত্রের স্বার্থ রক্ষাই অগ্রাধিকার পেয়েছে। খেলাপি ঋণের ভারে ভঙ্গুর ব্যাংক খাতের পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব সংস্থানের সংকুচিত পরিস্থিতিতে অনুন্নয়নশীল খাতগুলোয় ব্যয় হ্রাসের প্রয়োজন ছিল। অনুৎপাদনশীল খাতে বরাদ্দ প্রাধান্য পেয়েছে। জনপ্রশাসন খাতে বাজেটের সর্বোচ্চ ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য এ খাতের পরিচালন ব্যয় গত অর্থবছরের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ করতে পারলে অনেক অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।
করের আওতা বাড়ানো হয়নি। কর জালিয়াতি ও কর ফাঁকি নিরসনে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নেই। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে ট্রান্সফার প্রাইসিংসহ কর আদায়ে নতুন উদ্যোগ না নিয়ে এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য চাপ না দিয়ে অ–তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে হ্রাসকৃত করপোরেট করের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ আগের তুলনায় কমেছে। পেনশন ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি বাদ দিলে এ বরাদ্দ ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়। এ বরাদ্দ নতুন দারিদ্র্য পরিস্থিতি সামাল দিতে কতটুকু সক্ষম হবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। উন্নয়ন অন্বেষণ গবেষণায় দেখিয়েছে, ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের আয় আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে; অসমতা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হবে। চলমান কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়; কিছু নির্দিষ্ট দল, গোষ্ঠীকে লক্ষ করে গৃহীত। এভাবে মূলত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টন করে গোষ্ঠীতন্ত্র লালন করা হয়।
জীবন বাঁচাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ঠিক করুন
করোনা সংক্রমণে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বে ১৭তম অবস্থানে চলে এসেছে। সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন বাঁচাতে সবার আগে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ঠিক করার দরকার ছিল। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে সর্বজনীন করা প্রয়োজন। সংক্রমণ রোধ করা না গেলে মানুষের জীবনে স্বস্তি ও স্থিতি আসবে না। অর্থনীতির চাকা সচল হবে না।
জীবন ও জীবিকা পরস্পরের পরিপূরক। জীবনের জন্য জীবিকা। অনিয়ম, দুর্নীতি, গোষ্ঠীতোষণ ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টন বন্ধ করা প্রয়োজন। নইলে জীবন ও জীবিকা কিছুই রক্ষা পাবে না; গোষ্ঠীতন্ত্রই ফুলেফেঁপে উঠবে। বাজেট–প্রক্রিয়াকে এককেন্দ্রিকতা থেকে অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। বাজেট ব্যবস্থাপনায় নিরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, তদারকি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নইলে বাজেটকে গোষ্ঠীতন্ত্রের হাত থেকে উদ্ধার করা যাবে না। ফলে বাজেটে সর্বজনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, অধিকার রক্ষিত হবে না।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন
অন্বেষণের চেয়ারপারসন
rt@du.ac.bd