অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিতের রেকর্ডটি বেশ চমকপ্রদ। ৭ জুন তিনি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের যে বাজেট পেশ করেন, গণমাধ্যমে তাকে তাঁর দশম বাজেট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আসলে এটি হওয়ার কথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের একটানা দশম বাজেট, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দ্বাদশ। কেননা, প্রায় ৩৬ বছর আগে তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও তিনি ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরেরও বাজেট পেশ করেছিলেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বারোটি বাজেটের কোনোটির ক্ষেত্রেই তাঁকে কার্যত কোনো বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের সময়কালে সংসদে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ছিল বটে, তবে তারা ছিল ইতিহাসের ক্ষুদ্রতম বিরোধী দল। আর বর্তমান মেয়াদে সংসদের বিরোধী দলে যাঁরা আছেন, তাঁরা তো সরকারেরই অংশ।
একসময়ে সংসদে বাজেট উত্থাপনের পরপরই তাকে গণবিরোধী অভিহিত করে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ দেখানো হতো। হরতালের কর্মসূচিও ছিল অবধারিত। এদিক থেকেও আওয়ামী লীগই সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে। হরতাল করার দিক দিয়ে যেমন, তেমনি তাদের আমলে হরতাল না হওয়ার দিক থেকেও। অন্তত গত পাঁচ বছরে বাজেটের বিরুদ্ধে একটি হরতালও হয়নি। এই সৌভাগ্য মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও মরহুম সাইফুর রহমান—কারোরই হয়নি। হতে পারে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায়’ অর্থমন্ত্রী মুহিতের প্রতি দেশবাসীর অগাধ আস্থাই এর কারণ। অথবা জাতি হিসেবে আমরা এখন খুবই সহনশীল হয়ে উঠেছি। তবে অন্য আরেকটা সম্ভাবনাও নাকচ করা যায় না, পুলিশি মারপিট বা হয়রানির ভয়। কেননা, জননিরাপত্তা খাতে যেভাবে বরাদ্দ বাড়ছে, তাতে পুলিশ-র্যাবসহ নানা ধরনের বিশেষায়িত ইউনিটের সামর্থ্য ও পরিধিরও তো অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছে। ২০১৮-১৯ নির্বাচনের বছর হওয়াই জননিরাপত্তায় বরাদ্দ দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়ার কারণ কি না, সেটা অবশ্য তিনিই ভালো বলতে পারবেন। বিশেষ করে আরেকটা ৫ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা যখন প্রবল।
দেখা যাচ্ছে, জননিরাপত্তায় বরাদ্দের পরিমাণ ৫.৭ শতাংশ, যা কৃষি খাতের জন্য নির্ধারিত বরাদ্দের সমান। আবার স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ তার চেয়ে কম, মাত্র ৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে নিরাপত্তা খাতে এবারের বরাদ্দের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বাড়লেও সরকারি ব্যয়ের শতাংশ হিসাবে তা গত বছরের মতোই রয়েছে। অবশ্য যুক্তি উঠতে পারে যে ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসের হুমকির জন্য জননিরাপত্তায় বাড়তি চাপের কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। সন্ত্রাসবাদের হুমকি আমাদের চেয়ে যুক্তরাজ্যের কম নয় এবং সেখানকার জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেশি, কিন্তু সেখানেও জননিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ সরকারি ব্যয়ের ৪ শতাংশ (সূত্র: ইউরোস্ট্যাট)। সরকারের সাফল্যের তালিকায় আমরা যখন শুনতে পাই, ‘জঙ্গিবাদ পরাস্ত হয়েছে’ এবং ‘গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত’ হয়েছে—তখন র্যাব-পুলিশের জন্য আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বাজেট বাড়ানোর উদ্দেশ্য যে এসব বাহিনীকে তুষ্ট করা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং মাত্রাতিরিক্ত শক্তিপ্রয়োগ ও নির্যাতনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে যখন অভিযোগের পাল্লা ভারী, তখন তাদের জন্য বাড়তি সম্পদের ব্যবস্থা করার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন না করে পারা যায় না। মানবাধিকারবাদীদের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচিত এসব বাহিনী যেন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে অবস্থান করছে। ২০১৪ সাল থেকেই বিএনপি অভিযোগ করে আসছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে না দেওয়া। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, শুধু বিএনপি নয়, সরকারের বিরুদ্ধে হলেই তাকে আর রাস্তায় নামতে না দেওয়াই এখন তাদের কাজ। বিনা ইউনিফর্মে কাউকে গ্রেপ্তার এবং কোথাও অভিযান পরিচালনা না করার জন্য আদালতের নির্দেশনা অনুসরণেও তাদের অনীহা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীই হোক কিংবা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, কারোরই রেহাই নেই। সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চের নেতার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। জননিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীগুলোর জন্য বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে সরকার যেমন এসব বাহিনীর অনুসৃত নীতি ও কৌশলকে উৎসাহ জোগাচ্ছে, তেমনি বিরোধীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করছে। কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্রে এ ধরনের বরাদ্দ অনুমোদন পেত কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য এখন অবান্তর।
বাজেটের কয়েক মাস আগে থেকেই সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের নানা ধরনের বাড়তি সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা আসছিল। সচিবেরা এখন বাড়িতে বাবুর্চি এবং প্রহরী রাখুন আর নাই রাখুন, সেই বাবদ ভাতা পান। এখন বাড়ি-গাড়ির জন্যও সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশকে কম সুদে ঋণ জোগানোর দায়িত্বও সরকার নিয়েছে। বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যত সুবিধা পেয়েছেন, জীবনেও তাঁরা তা পাননি। সরকারি কর্মচারীরা ভালো থাকুন, সেটা আমরাও চাই। কিন্তু বেসরকারি খাতের কর্মীদেরও তো ভালো রাখার দায়িত্ব সরকারের। বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যবধান এখন যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তার নজির বিরল। বেসরকারি খাতে ওই মাপের বেতন-ভাতা যাঁরা পান, তাঁরা মোট কর্মীর ১০ শতাংশও হবেন কি না সন্দেহ। এই বৈষম্য টিকিয়ে রাখার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খোঁজা হলে তা কি অন্যায় হবে? আইনের বাইরে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার কাজে আমলাদের ব্যবহার করার উদ্দেশ্য, বিশেষ করে নির্বাচনের বছরে, কোনোভাবেই সততার পরিচয় দেয় না।
ইতিমধ্যেই এবারের বাজেটের বিষয়ে যে সমালোচনাটি জোরালোভাবে উঠেছে তা হচ্ছে, এতে বিত্তবানদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত রয়েছে এবং ব্যাংকিং খাতের নৈরাজ্যকে নিয়ন্ত্রণের বদলে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কারণটিও রাজনৈতিক বলে অভিযোগ উঠেছে। কেননা, তাঁরা নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলকে বড় আকারে চাঁদা দিতে পারবেন।
অর্থমন্ত্রী মুহিত ৩৬ বছর আগে প্রথম যখন বাজেট দিয়েছিলেন, তখন বাজেটের আকার ছিল ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। তবে, তখন ছিল সামরিক শাসনের অধীনে থাকা দরিদ্র রাষ্ট্র। এখন তাঁর বাজেটের আকার ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। ১০ বছর আগে মহাজোট সরকারের প্রথম বাজেট ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। ১০ বছরে তা বেড়েছে প্রায় চার গুণ। সরকারি হিসাবে, মাথাপিছু গড় জাতীয় আয় বাড়ল ৭৫৯ ডলার থেকে ১ হাজার ৭৫২ ডলার। সরকারের অনেকেই দাবি করে থাকেন, আমাদের সমৃদ্ধি এখন সবার কাছে নজির হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অথচ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬ বিশ্লেষণ করে অর্থনীতিবিদেরা জানিয়েছেন, পারিবারিক পর্যায়ে ব্যক্তির আয় আসলে কমেছে, ব্যয়ও কমেছে। ২০১০ সালের আয়ের তুলনায় ২ শতাংশ কম এবং ভোগের জন্য প্রত্যেকের প্রকৃত ব্যয় কমেছে প্রায় ১ শতাংশ। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশ যে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, সেই খাতে মজুরি কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। দেশে জনপ্রতি পুষ্টি গ্রহণের হার ২০০৫ সালের তুলনায় ২০১০–এ কমেছিল ৫ শতাংশ, আর ২০১৬ সালে কমেছে আরও ৯ শতাংশ। অর্থনীতিবিদেরা আরও দেখিয়েছেন যে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন সর্বোচ্চ।
বাজেট বিশ্লেষণ প্রধানত অর্থনীতিবিদদের বিষয়। কিন্তু বাজেটের রাজনৈতিক দিকটিও উপেক্ষণীয় নয়। অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, তাঁর প্রতিটি বাজেটই নির্বাচনী বাজেট। কেননা, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে এমন বাজেটই দিতে চান, যা মানুষ পছন্দ করবে। ব্যাংকের উদ্যোক্তা, উচ্চবিত্ত এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি পক্ষপাত কীভাবে মানুষের কাছে পছন্দনীয় হবে, সেই প্রশ্নটি করার মতো রাজনৈতিক পরিবেশও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিরোধী মত দমনের সাম্প্রতিক প্রবণতার পটভূমিতে পুলিশি কাজে বাড়তি বরাদ্দ কি তার কোনো ইঙ্গিত বহন করে?
কামাল আহমেদ সাংবাদিক