কয়েক বছর ধরে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিছু থোক বরাদ্দ ছাড়া করোনাকালের দুই অর্থবছরেও স্বাস্থ্য খাতের নিয়মিত বাজেটে তেমন নড়চড় হয়নি। করোনার শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বৃদ্ধিতে সহায়ক হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। ফলে এ বছরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫ শতাংশের ঘরে সীমাবদ্ধ থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, সরকারের এ খাতের প্রতি নজর কম। আসলেই কি তা-ই?
বিগত বছরগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতের পরিচালন বরাদ্দের ৩ থেকে ৫ শতাংশ এবং উন্নয়ন বরাদ্দের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অব্যয়িত থাকে। যেটা খরচ হয়, তা-ও অনেক ক্ষেত্রে গুণগত মানের নয়। খরচ করতে না পারলে বাজেট বাড়ানোর যৌক্তিকতা কোথায়?
উন্নয়ন বা পরিচালন বাজেটের যে অংশ অব্যয়িত থাকে, তার একটি মূল কারণ হচ্ছে, কেনাকাটা ও প্রকিউরমেন্ট-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ পুরোপুরি খরচ করতে না পারা। এসব প্রক্রিয়ার সঙ্গে একদিকে যেমন জড়িত রয়েছে সময়মতো বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা এবং বার্ষিক প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনা তৈরি, অন্যদিকে তেমন রয়েছে ঊর্ধ্বতন দপ্তর থেকে এসবের দ্রুত অনুমোদন। তা ছাড়া রয়েছে সময়মতো অর্থ ছাড়ের বিষয়। প্রথমটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিটি কস্ট-সেন্টারের ব্যবস্থাপকের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত দক্ষতাসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রকিউরমেন্ট পলিসি এবং দরপত্রের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা। আর দ্বিতীয়টি নির্ভর করে ঊর্ধ্বতন দপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের একাগ্রতা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার ওপর। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই ঘাটতি বেশ স্পষ্ট।
স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য বনিয়াদি প্রশিক্ষণসহ আর্থিক হিসাব-নিকাশ, প্রকিউরমেন্ট ও অডিট-সংক্রান্ত উপযুক্ত প্রশিক্ষণের তেমন ব্যবস্থা নেই। মেডিকেল প্রফেশনালদের প্রশিক্ষণের জন্য বহুকাল ধরে ঢাকার অদূরে ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যানেজমেন্ট নামে একটি ট্রেনিং একাডেমি নির্মাণাধীন থাকলেও জনবল নিয়োগের জটিলতায় তা এখনো চালু হয়নি। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী মেডিকেল প্রফেশনালদের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের ব্যবস্থাপক এবং প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো বনিয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, এমনকি ওরিয়েন্টেশনেরও তেমন ব্যবস্থা নেই। ফলে তাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষ ব্যবস্থাপক বা পরিচালক হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারেন না। তা ছাড়া হিসাবরক্ষক, পরিসংখান কর্মকর্তাসহ অন্যান্য সহায়ক জনবল, যাঁরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাজেট তৈরি এবং খরচের সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাঁদের সংখ্যা, যোগ্যতা ও সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি আছ। তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদানেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। উল্লেখ্য, তাঁদের বড় একটি অংশ অধস্তন পদ থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে এসব পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় সমস্যার গভীরতা আরও বেশি।
উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যোগ্য প্রকল্প পরিচালকের অভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব অর্পণ, তাঁকে প্রশিক্ষণ এবং দাপ্তরিকভাবে জনবল দিয়ে সক্ষম করে না তোলা, একাধিকবার প্রকল্প পরিচালকের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবে যোগ্য ফার্ম বাছাই করতে না পারা, ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা, নিয়োগকৃত ফার্মের আর্থিক সক্ষমতার অভাবসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত।
অন্যদিকে, ক্ষেত্রবিশেষে ঊর্ধ্বতন দপ্তরের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের একাগ্রতা, দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার অভাবে অনুমোদনের প্রক্রিয়া অনেক বিলম্বিত হয়। আবার ইন্টিগ্রেটেড বাজেট অ্যান্ড অ্যাকাউন্ট সিস্টেমের (আইবিএএস++) মাধ্যমে বছরের প্রথম দুই কোয়ার্টারের বরাদ্দ দ্রুত ছাড় করা হলেও তৃতীয় ও চতুর্থ কোয়ার্টারের বরাদ্দ ছাড়ের ক্ষেত্রে বেশ বিলম্ব হয়।
উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে যোগ্য প্রকল্প পরিচালকের অভাব, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব অর্পণ, তাঁকে প্রশিক্ষণ এবং দাপ্তরিকভাবে জনবল দিয়ে সক্ষম করে না তোলা, একাধিকবার প্রকল্প পরিচালকের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবে যোগ্য ফার্ম বাছাই করতে না পারা, ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত জটিলতা, নিয়োগকৃত ফার্মের আর্থিক সক্ষমতার অভাবসহ বিভিন্ন বিষয় জড়িত।
আবার একটি অদৃশ্য দুষ্টচক্র তো সর্বত্র বিরাজমান, যেখানে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, হিসাব সংরক্ষণ অফিস, অডিট অফিসসহ সমাজের নানা স্তরের মধ্যস্বত্বভোগীরা জড়িত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দুষ্টচক্রই নির্ধারণ করে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কন্ট্রাক্ট দিতে হবে এবং কোন মূল্যে দিতে হবে। তাই যে খরচ করা হয়, সেটাও গুণগত মানের হয় না। আর এ ক্ষেত্রে দ্রব্য বা ইকুইপমেন্ট বুঝিয়ে না দিয়ে নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। এ কারণে সৎ ব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালকেরা প্রাপ্ত বরাদ্দ ব্যবহারে ভয় পান।
স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা অনেক বেশি এবং তা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপ্ত হওয়ায় এই দুষ্টচক্র অনেক বেশি বিস্তৃত। আগে স্থানীয়ভাবে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী কেনার কিছু দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনের দপ্তরের ওপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে সেই দায়িত্ব ও বরাদ্দ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স পর্যন্ত চলে গেছে। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বর্তমান গভর্ন্যান্স কাঠামোয় বিষয়টি হিতে বিপরীত হয়েছে। কেনাকাটার টাকার ভাগ পাওয়ার জন্য এখন ৪৯৫টি উপজেলায় ৪৯৫টি দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সারা বছর এই দুষ্টচক্রের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। অন্যদিকে, এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানির পুরোপুরি সক্ষমতা না থাকায় তারাও চাহিদাকৃত ওষুধ সময়মতো সরবরাহ করতে পারে না। ফলে পরিচালন খাতের এ অর্থও ঠিকমতো খরচ করা যায় না।
এখন বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটা গুণগতভাবে খরচ না করতে পারলে বাজেট বৃদ্ধির সুযোগও নেই, যৌক্তিকতাও নেই। এর জন্য প্রথমেই দরকার কেন্দ্রীয়ভাবে একটি শক্তিশালী প্রকিউরমেন্ট দপ্তর গঠন করা। সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপোর কাঠামোগত পরিবর্তনের মাধ্যমেও তা করা যায়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তা-ই বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, এটির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলমান। দ্বিতীয়ত, প্রকিউরমেন্ট-সংক্রান্ত এবং অপারেশনালে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচের সব অনুমোদনের দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করা। তৃতীয়ত, এসেনসিয়াল ড্রাগ কোম্পানির সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে গতি আনয়নসহ স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে মেডিকেল ক্যাডারে হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা একান্ত প্রয়োজন। এ ধারায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ক্যারিয়ারের শুরু থেকে স্বাস্থ্য খাতের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রকিউরমেন্ট, টেন্ডারিং প্রক্রিয়াসহ নানা বিষয়ে দক্ষ করে তোলা, যেন তাঁরা স্বাস্থ্য খাতকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। তা ছাড়া করোনার শিক্ষা কাজে লাগিয়ে দেশের পুরো স্বাস্থ্যসেবাকে জনমুখী করার জন্য প্রতিকারমূলক সেবা উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিরোধ এবং পেশাদার সেবা জোরদারকরণে প্রয়োজনীয় লাইন আইটেম সংযোজন করা।
● ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়