মতামত

বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলন বিভেদ বাড়াবে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’-এর আয়োজন করলেন, তা একেক অঞ্চলের কাছে একেক ধরনের বার্তা দিয়েছে। পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাছে একধরনের বার্তা গেছে। এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা (মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা, সংক্ষেপে মেনা) অঞ্চলে তা আরেক ধরনের বার্তা দিয়েছে। মেনার দেশগুলো মনে করছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ইস্যুতে বাইডেন তাঁর প্রতিশ্রুতির বার্তা দিতে চেয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা মনে করছেন এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তাঁদের শাসানি দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

প্রথম প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রিত দেশের তালিকা নিয়ে। অনেকেই ধারণা করছেন, শতাধিক দেশকে বাইডেন প্রশাসন আমন্ত্রণ জানালেও বাকি দেশগুলোকে আমন্ত্রণ না জানানোয় বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা যাবে। জো বাইডেনের এই সম্মেলনকে চীনা কর্মকর্তারা ‘তামাশা’ এবং সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত এটিকে ওয়াশিংটনের ‘শীতল যুদ্ধকালীন মানসিকতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

বাইডেনের সম্মেলনে আমন্ত্রিত এবং আমন্ত্রিত নয় এমন দুটি ভাগ দৃশ্যমান হয়ে গেছে, যা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের বিকাশের পথে বিঘ্ন ঘটাবে। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়ার বক্তব্যে সেটি স্পষ্ট হয়েছে। এ দুই দেশ আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে থেকে বাদ পড়া দেশগুলোকে নিয়ে একধরনের ছায়া জোট গঠনের চেষ্টা করবে। সেই জোটে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দেশগুলোর পাশাপাশি দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোও শামিল হবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, আপনি যদি একটা ‘পার্টি থ্রো’ করেন এবং যাঁদের আপনি দাওয়াত দেননি, তাঁদের প্রত্যেকে যদি সেই পার্টি নিয়ে সমালোচনামুখর থাকে তাহলে বুঝবেন আপনার পার্টিটা ভালো হয়েছে। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুধু ইসরায়েল ও ইরাককে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমন্ত্রিতদের তালিকায় ইসরায়েলের নাম থাকা মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ, বহুদিন ধরে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র ‘মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ’ বলে অভিহিত করে আসছে।

ইরাককে তালিকায় রাখায় অনেকে হোঁচট খেয়েছেন। মরক্কো ও জর্ডানের মতো আরও কয়েকটি দেশকে যদি এই তালিকায় রাখা হতো, তাহলে হয়তো ইরাককে তালিকায় রাখাকে কিছুটা সহজভাবে নেওয়া সম্ভব হতো। ধারণা করি, এই সম্মেলনে আরব দেশগুলোর মধ্য থেকে অন্তত একটি দেশের প্রতীকী উপস্থিতি থাকা দরকার বলে আমেরিকা মনে করেছে এবং সে কারণে ইরাককে বেছে নেওয়া হয়েছে। শীর্ষ সম্মেলনের পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, অতিথিদের তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে ‘গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতার’ বৈচিত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে। ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তুমি গণতান্ত্রিক নও, আমি গণতান্ত্রিক—এমন কোনো স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতিসূচক মনোভাব নিয়ে এই তালিকা করা হয়নি।’

তবে তালিকা যেভাবেই করা হোক, এতে শাসকদের কে গণতন্ত্রপন্থী এবং কে স্বৈরশাসক তা মনে করিয়ে দেওয়ার একটি দ্যোতনা স্পষ্টভাবেই আছে। এতে তাদের মধ্যে দূরত্ব ও বিভেদ সৃষ্টির অভিপ্রায় থাকতে পারে বলে কেউ সন্দেহ করলে তাঁকে দোষী বলা যাবে না। কারণ, আমন্ত্রিতদের তালিকার মধ্যে একটি সাদা-কালো গোছের সরলীকরণের প্রবণতা রয়ে গেছে। এতে সাধারণভাবে মনে হতে পারে আমন্ত্রিত দেশগুলোর মধ্যেই শুধু গণতন্ত্রের চর্চা আছে। বাকি দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। কিন্তু এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে উন্নত গণতন্ত্র হয়তো নেই, কিন্তু সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। এই দেশগুলোকে যখন আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তখন তা সেই দেশগুলোকে গণতন্ত্র ইস্যুতে কিছুটা হলেও হতাশ করবে।

তিউনিসিয়ার কথা বলা যেতে পারে। দেশটিকে আরব বসন্তের ‘পোস্টার চাইল্ড’ বলা হয়ে থাকে। এখান থেকেই গোটা আরব দুনিয়ায় স্বৈরশাসনবিরোধী ও গণতন্ত্রকামী আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। সেখানে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও গণতন্ত্রের বাতাস বইতে শুরু করেছিল। যদিও সেখানকার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ ‘জনমত–সমর্থিত হয়ে’ পার্লামেন্ট স্থগিত করেছেন এবং একটি ‘ব্যতিক্রম রাষ্ট্র’ গঠন করেছেন। কিন্তু আরব দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষে তিউনিসিয়ার ভূমিকা রয়েছে।

বাইডেনের সম্মেলনে আমন্ত্রিত এবং আমন্ত্রিত নয় এমন দুটি ভাগ দৃশ্যমান হয়ে গেছে, যা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের বিকাশের পথে বিঘ্ন ঘটাবে। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়ার বক্তব্যে সেটি স্পষ্ট হয়েছে। এ দুই দেশ আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে থেকে বাদ পড়া দেশগুলোকে নিয়ে একধরনের ছায়া জোট গঠনের চেষ্টা করবে। সেই জোটে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দেশগুলোর পাশাপাশি দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোও শামিল হবে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোতে একসময় পুরোদস্তুর কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম হয়ে বসতে পারে—সেই ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এটিই ভয়ের বিষয়।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ওসামা রমজানি আরব উইকলির প্রধান সম্পাদক