বাংলা ও বাংলাদেশ

বাংলা তো আমাদেরই

আমাদের অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অনুভূতির পরতে পরতে ‘বাংলা’র উপস্থিতি। বাংলার ইতিহাস হচ্ছে মুখ্যত আমাদেরই ইতিহাস। মোগলদের রাজত্বে ‘সুবেহ বাংলা’ ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলা সুবেহরই (প্রদেশ) নাম। পাঠান সুলতানদের সময়ে এবং এর পূর্বের ইতিহাসেও তাই-ই। বাঙ্গালা বলতে বর্তমান বাংলাদেশকেই মুখ্যত বোঝাত। ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ বলতে আমরা আসলে বাংলাদেশকেই বোঝাই, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপত্য, সংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য সবকিছু তো ইংরেজিতে Bengal ‘বেঙ্গল’ এবং হিন্দি-উর্দুতে ‘বাঙ্গালা’ বলে খ্যাত। সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান একাডেমির নাম তো ‘বাংলা একাডেমি’। শেরেবাংলা বলতেও তো আমাদের অন্যতম জাতীয় নেতা এ কে ফজলুল হককেই বোঝায়।

এখনকি কেউ ঢাকা থেকে কলকাতা বা যশোর থেকে বনগাঁ গেলে বলবে—বাংলায় যাচ্ছি, going to Bengal? আমরাই তো ‘বাংলা’। Bengal History and Culture of Bengal মানে তো আমাদেরই ইতিহাস ও সংস্কৃতি। আবুল খায়েরের প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ তো আমাদেরই শিল্প-সংগীত-সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছে।

আমাদের জাতীয় সংগীতে তো ‘বাংলা’রই উল্লেখ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা তো বাংলার স্বাধীনতা। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এ তো শুধু জাতীয় সংগীতই নয়, আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। এ অবস্থান থেকে তো আমরা কখনো সরে আসতে পারি না। বাংলার অধিবাসী বলেই তো আমরা বাঙালি। আমাদের দেশই তো আবহমানকালের বাংলা।

আমাদের সবকিছুই বিবরণের সময়ে ইংরেজিতে Bengal বা Bengali এবং বাংলা ভাষায় ‘বাংলা’ বলেই অভিহিত হয়। Rivers of Bengal, Bengal Monsoons, Muslins of Bengal, Bengal Sweets, Bengal goats, Products of Bengal, এমনকি Bengal Chutney বলতে তো আমাদের দেশের কথাই বোঝানো হয়। তা থেকে তো পৃথক হওয়া যায় না। বিলেতে বা বিদেশের কোনো কোনো স্থানে দেখেছি আমাদের দেশীয় রেস্তোরাঁগুলোতে ইদানীং Bengal cuisine বা বাংলা খাবার চালু করার প্রচেষ্টা। আমাদের সবকিছু তো ‘বাংলা’ই থাকবে। বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রিক লেনকে কেউ কেউ বলেন লিটল বেঙ্গল। আমাদের রাষ্ট্রভাষায় সেখানে সড়কেরও নাম লেখা।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তিত হয়ে হবে ‘বাংলা’, ইংরেজিতে Bengal, এবং হিন্দিতে বাঙ্গালা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাম পরিবর্তনের কারণগুলো বলতে গিয়ে এটাও বলেছেন, দিল্লিতে সভা-সমিতিতে Bengal-এর আদ্য-অক্ষরের জন্য রাজ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

কারণ যা-ই হোক না কেন, আমরা তো ‘বাংলা, Bengal বা বাঙ্গালা’ ছেড়ে দিতে পারি না। আমার মনে হয়, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের উচিত এবং একান্ত করণীয় হবে ‘বাংলা’, Bengal বা বাঙ্গালা নামগুলোকে সচেতনভাবে আঁকড়ে রাখা। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে। নইলে ধীরে ধীরে দূরত্ব হয়ে যেতে পারে, এই নামগুলো থেকে আমরা কিছুতেই বিচ্যুত হতে পারি না। কেননা, এ আমাদের শুধু ঐতিহ্যই নয়, অস্তিত্বও বটে। বরং আমরা হয়তো ভাবতে পারি, একটা বিস্তৃততর পরিধিতে আমরা পরিব্যাপ্ত হলাম।

ইনাম আহমদ চৌধুরী: আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ