বাংলার হৃদয়মাঠ বিশ্বমানের হোক

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে গেলে ওরা আপনাকে অবশ্যই দেখাতে নিয়ে যাবে ন্যাশনাল মল, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট ও লিংকন মেমোরিয়াল। ওয়াশিংটন মনুমেন্ট একটা টাওয়ার, স্তম্ভ। ৫৫৪ ফুট উঁচু। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্টের নামে। এর স্থাপত্য সহজ, সরল, নিরাভরণ। দেখে মনে হবে, আহামরি এমন কী! কিন্তু গোটা এলাকা তারা রেখেছে কত সুন্দর করে। ন্যাশনাল মল মানে ফাঁকা মাঠ। সবুজ ঘাসে ঢাকা। আর হেঁটে চলার জন্য দীর্ঘ পথ। একটা বড় দীর্ঘ সরোবর আছে, তার এক পাশে ওয়াশিংটনের নামে স্থাপিত উঁচু স্মারকস্তম্ভটি, অন্য পাশে লিংকন মেমোরিয়াল। লিংকন মেমোরিয়াল রোমক স্থাপত্যে বানানো একটা অনতিবিরাট ভবন।

আপনি যদি ওখানে যান, আপনার মন ভরে যাবে। খোলামেলা এত বড় একটা মাঠ। এত বড় একটা সরোবর। সরোবরের পানিতে পড়েছে ওয়াশিংটন মনুমেন্টের ছায়া। এ রকম জলাধার আমরা দেখেছি আমাদের জাতীয় স্মৃতিসোধের সামনে, সংসদ ভবনে, তাজমহলে এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভের পাশে।

আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এই রেসকোর্স ময়দানেই শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু উপাধি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এই রেসকোর্স ময়দানেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় লিখেছেন:
‘এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে-ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তাহলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,
ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?
...
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে, আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর;
না পার্ক না ফুলের বাগান,—এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশে ছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই রেসকোর্স ময়দানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। মাথা নিচু করে কোমরের বেল্ট খুলে ফেলে অস্ত্র মাটিতে বিসর্জন দেয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা স্বদেশে ফিরে এসে এই রেসকোর্স ময়দানেই অশ্রুভেজা চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে, আজ আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।’

নির্মলেন্দু গুণ যথার্থ বলেছেন, এই মাঠ ঢাকার হৃদয়মাঠ। এই মাঠ আমাদের হৃদয়মাঠ। এই মাঠ বাংলাদেশের হৃদয়মাঠ।

এই মাঠে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। সুন্দর হয়েছে। পাশে সরোবর। এই মাঠে আছে শিখা চিরন্তন। এই মাঠে আছে এম্ফিথিয়েটার। এই মাঠে আছে স্মারকপ্রদর্শন স্থাপনা।

নির্মাণ, স্থাপনা, উন্নয়ন—যা হওয়ার হয়েছে। তা নিয়ে কথা বলার জন্য আজকের এই লেখা নয়। এ লেখার জিজ্ঞাসা—এই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রেসকোর্স ময়দান কেন সারাটা বছর এত অযত্নে পড়ে থাকে!

পুরো এলাকা দেখলেই মনে হবে, এটা অনাথ। অভিভাবকহীন। নোংরা। এখানে–ওখানে পড়ে আছে নির্মাণসামগ্রী। স্তূপীকৃত হয়ে। কাগজের টুকরা, বাদামের খোসা, পলিথিন, ঠোঙা, চিপসের প্যাকেট—এটা যেন একটা উন্মুক্ত আস্তাকুঁড়। এটা দিনের বেলা ভবঘুরেদের আশ্রয়স্থল। রাতের বেলা এটা বিপজ্জনক এলাকা। শুনতে পাই, মাদকসেবীরা ঘোরাফেরা করে। অসামাজিক ও বেআইনি কাজকর্ম চলে। ছিনতাই হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা কেন এত অযত্নে পড়ে থাকবে? আমরা চাই এটা মর্যাদা পাবে বাংলাদেশের হৃদয়মাঠের। বিদেশ থেকে কোনো অতিথি এলে আমরা তাঁকে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাব। ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল মলে যেমন আমাদের ওরা নিয়ে যায়। সবুজ তো সবুজ। সেখানে ঘাস থাকবে, সেই ঘাস থাকবে পরিকল্পিত নকশা অনুযায়ী, তাতে নিয়মিত পানি দেওয়া হবে। একটা কণা ময়লা পড়ে থাকতে পারবে না। পেভমেন্ট তো পেভমেন্ট। একটা কণা ধুলা সেখানে থাকতে পারবে না। প্রতিটি গাছের যত্ন নেওয়া হবে, পরিকল্পনামাফিক নতুন গাছও লাগানো যাবে। অর্থাৎ পুরো ল্যান্ডস্কেপটা একটা সমন্বিত নকশার অধীনে থাকবে। নগর পরিকল্পক, স্থপতি, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, উদ্যানবিদ, প্রকৌশলী, কবি মিলে সেই নকশাটা প্রণয়ন করবেন। সবচেয়ে বড় কথা, এটা সাংবৎসরিক দেখভাল করার জন্য কর্তৃপক্ষ থাকবে, তাদের হাতে পর্যাপ্ত বাজেট থাকবে। এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। মেট্রোরেল স্টেশন থাকবে আশা করি, সেখান থেকে মাঠে ঢোকার ব্যবস্থা থাকবে। রাতের বেলা এটা আলোয় আলোয় ভরে থাকবে। দিনের বেলা এটা হবে সবুজে ছায়ায় এক অপরূপ স্থান। চারদিকে পাহারা থাকবে। সিসি ক্যামেরা থাকবে। পরিষ্কার করার জন্য লোক থাকবে। তাদের দেখার জন্য লোক থাকবে। এর জাদুঘর হবে বিশ্বমানের। সেখানে ভিডিওতে ইতিহাস কথা কইবে। রাতের বেলা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রদর্শনী হবে সপ্তাহে অন্তত এক দিন। বইমেলা এখানে হবে, সেটা কোথায় হবে, সেই নকশাও করা থাকবে। পাকা পেভমেন্ট, ঘাস, গাছ, তরুলতা, সরোবর, মঞ্চ—সবটা মিলিয়েই হবে বইমেলা।

একটা সময় দেশটা গরিব ছিল। আমরা দুবেলা খেতে পারতাম না। এখন তো আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি। টাকাপয়সা খরচ করে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নানা ধরনের স্থাপনা বানিয়ে ফেলেছি। এখন দরকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবেশ, তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, দৈনন্দিন পরিচালনা বিশ্বমানের করা। এই ব্যয় নির্বাহ করার ক্ষমতা আমাদের আছে।

আমরা জানি, স্বাধীনতা চত্বর প্রকল্প থেকে মাঝপথে বেশ কজন বিশিষ্ট নাগরিক পদত্যাগ করেছিলেন। তারপরও ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে বলেছি, স্যার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এত মন খারাপ হয়! আমরা এত নোংরা কেন? এটার জন্য একটা অভিভাবক দিতে বলুন। আমি কবি স্থপতি রবিউল হুসাইনকে বলেছি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কেন এত মন–খারাপ-করা? তিনি দেখিয়ে দিলেন স্থপতি শামসুল ওয়ারেসকে। আমি তাঁকে ধরলাম, স্যার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, লিংকন মেমোরিয়াল, আমেরিকার ন্যাশনাল মলের মতো নির্মল সুন্দর ঝকঝকে, তকতকে সবুজ করার উদ্যোগ নিন। শামসুল ওয়ারেস বললেন, আমাদের দেশে একটা স্থাপনার নির্মাণ পর্যন্ত বাজেট থাকে, এটার দৈনন্দিন তত্ত্বাবধান, সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে কোনো বাজেট থাকে না। এটা একটা সামগ্রিক চিত্র। তার একটা উদাহরণ হলো ধানমন্ডি লেক। অযত্ন, অবহেলায় এটা ময়লার ভাগাড় হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগেও লেকটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারতাম।

আমরা ২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পালন করব। এখনো সময় আছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জন্য একটা কর্তৃপক্ষ করে দিলে এবং বাজেট বরাদ্দ হলে বাংলাদেশের এই হৃদয়মাঠটির ব্যবস্থাপনা বিশ্বমানের করা সম্ভব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার মাস মার্চে আপনার সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের অর্জন স্বাধীনতা। আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আমাদের হৃদয়মাঠ। আমাদের গৌরবের প্রতীক স্থান। প্রতীক হিসেবেই এই মাঠটিকে আমরা বিশ্বমানের করে রাখতে চাই। আশা করি, আপনি এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেবেন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক