বর্ষা নিভৃত উপলব্ধির। বাংলার বর্ষা একেবারেই নিজস্ব। এর সঙ্গে আর কোনো দেশের বর্ষার তুলনা হতে পারে কি না, আমার জানা নেই। অনেক দেশে গিয়েছি। সেখানেও মেঘের মাদল বাজে। গুরু গুরু করে মেঘ ডাকে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়। তবু তা যেন শিহরণ তোলে না বাংলা মায়ের মতো।
আমি বৃষ্টিতে সারা দিন ভিজতে পারি। সর্দিজ্বর এলেও আপত্তি নেই। কারণ, আমার সমস্ত অস্তিত্বে আষাঢ়-শ্রাবণ। কুয়ালালামপুরে কিছুদিন ছিলাম। ওখানে রোজ বৃষ্টি হয় বিকেলে অল্প একটু। ওরা বলে ‘পাইনঅ্যাপেল রেইন’। ওই বৃষ্টি না হলে আনারস সুমধুর হবে না। ওদের দেশে সবচেয়ে সুমিষ্ট ফল। এ ছাড়া সবার কাছে আছে সুদৃশ্য ছাতা। রমণীদের মতোই সুন্দর।
আমার কাছে বর্ষা বলতেই বলরামপুর। এমন বৃষ্টি কেউ দেখেনি। একে বলে সাতাও। সাত দিন ধরে বৃষ্টি থামে না। পথঘাট কর্দমাক্ত। তাতে কী? কাদাই সবচেয়ে ভালো লাগে। সারা দিন কাদার মধ্যে। ওটাই আমাদের প্রাণ।
আমরা কাদার দেশের মানুষ। আর আমরা ছোটরা বাড়িঘরে বসে টিনের চালায় বৃষ্টির নানা রকম সুর শুনি ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি মারফতি মুর্শিদি, যে গান মরবে না। জীবনের জন্য সঞ্চয় করে চলেছি আমাদের মননে। আমাদের নানা গানে সেই বৃষ্টির ধ্বনি তরঙ্গ। মাঝেমধ্যে চাল ভাজা আসছে নুন মাখানো, গরম-গরম মুড়ি আর না চাইতেই চা। পুকুরে সারা দিন চোখ হয় লাল জবা ফুলের মতো। মায়ের বকুনি খাই। বলে, দুষ্টু ছেলে, সর্দি হবে।
আমার প্রশ্ন, ব্যাঙের সর্দি হয় না কেন? মা বলেন, ব্যাঙের জন্মই বৃষ্টিতে। বৃষ্টি এলেই আমি দেখতে পাই সমস্ত আকাশ মেঘে মেঘে অন্ধকার। সামনের শ্যামল প্রান্তর কালো মেঘে ধারণ করেছে এক অপরূপ মায়া, যা শুধু আমার চোখেই বাঁধা পড়ে আছে। গায়ে রোমাঞ্চ লাগে।
মেয়ের বাড়ি আমেরিকার বোকা রাটনে মেঘ আসে, বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টিতে সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া যায় না, তাই বাংলার মানুষ সেখানকার আকাশে বর্ষাকে খুঁজে পায় না। হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে আসে আমাদের ছেলেমেয়েরা গ্রামগুলোতে বৃষ্টিতে নাইতে।
আমার যখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না, তখন মনকে কী দিয়ে প্রবোধ দিই। শুনবেন? ওই মেঘের মধ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে দুষ্টু ছেলেটির মতো। কড়াৎ কড়াৎ করে বজ্র নামে, আমি ভয় পাই না, বরং মনে হয় ওরা আমার বন্ধু। যখন শুনি কবির কণ্ঠে ‘কেতকী-কদম যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা’।
যখন গান গাইতে বসি, প্রতিটি গানে ‘বাদরিয়া’ ছুটে আসে। ‘সখী বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া/ নামিল মেঘলা মোর বাদরিয়া/ চল কদম তমাল তলে গাহি কাজরিয়া/ চল লো গৌরী শ্যামলিয়া।’
যখন নজরুল গানটি লেখেন, তখন নিশ্চয় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কারণ, গানটির প্রতিটি সুর ও বাঁধন বর্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং গানটি গাইতে হলে কাজরিয়াকেও সঙ্গে নিতে হয়। আরেকজনকে। তার নাম গৌরী। প্রতিটি গানের সঙ্গে আছে বাংলা মায়ের ওতপ্রোত সংযোগ।
শুধু গাইলেই হবে না। ওই আবহকে সঙ্গে আনতে হবে, তা না হলে ব্যর্থ হবে গানের পসরা। উত্তরীয় যদি পরতেই হয়, নিয়ে এসো মেঘডম্বুর শাড়ি। আর ডেকে আনতে হয় প্রাণপ্রিয় গান ‘কাজল বরণ কেশ কন্যা’কে, যার রূপ যেন পূর্ণ চাঁদের কলি। গাঙে জোয়ার এল, বর্ষা এল পূর্ণ যৌবনে, তাতে কী, তুমি এলে কই? তুমি না এলে বৃথাই এ বরষার গান। তুমি কি জানো ‘আমার চোখের জলে আজ মাঠ করে থইথই’। এমন উপমা আর কেউ দিতে পেরেছে বাংলা সাহিত্যে? না। একমাত্র তুমিই নজরুল।
বর্ষায় কদম। আমার চোখের সামনে ঝরে যায়। আবার সেখানেই নতুন কেশর জন্মায়। অর্থাৎ এই কেশর জন্মায় একই জায়গায় কয়েকবার। আর আমরা গাই: ‘বাদল–দিনের প্রথম কদম ফুল’। বর্ষা চলে যায়, কদমও নেয় বিদায়। সেই সঙ্গে বিরহী মনের কান্নাভরা সংগীত।
আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, যদি বর্ষা না আসত, তাহলে শত কবির হাজার গান সৃষ্টি হতো কি না। আমরা যাঁরা গান গাই, তাঁরা কী নিয়ে বাঁচতাম? ‘এল বরষার সঘন দিবস বনরাজি আজি ব্যাকুল বিবশ, বকুল বীথিকা মুকুল-এ মত্ত কানন-পরে, নব কদম্ব মদির গন্ধে আকুল করে’। এ রকম কবিতা আর লেখা হবে কি? আমি খুঁজে পাইনি।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সংগীত ব্যক্তিত্ব