নুসরাতের ‘মুক্তিযুদ্ধ’

বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও

নুসরাত জাহান।
নুসরাত জাহান।

১০ এপ্রিল ২০১৯ নির্যাতিত, আগুনে পোড়া অষ্টাদশী তরুণী নুসরাত জাহান রাফি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শেষনিশ্বাস ফেলার আগ পর্যন্ত প্রতিবাদে সোচ্চার থেকেছেন। এটা তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধ।’ সব নির্যাতিত-ধর্ষিত-অপমানিত-লাঞ্ছিত নারীর নেত্রী হিসেবে সোচ্চার ছিলেন তিনি। তাঁকে লাল সালাম।

খবরটি ১১ এপ্রিল পত্রিকায় দেখার আগে ও পরে মর্মাহত হয়েছিলাম। এরপর থেকেই বিবেকের দংশনে পীড়িত হচ্ছি। ফেনীর সোনাগাজী ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তো আমার ঢাকার বাসস্থান ও চলাচলের স্থান থেকে দূরে না—তাহলে কেন সঙ্গে সঙ্গে তঁার কাছে চলে যাইনি? কেন পত্রিকায় ২৮ মার্চ (২০১৯) অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের খবর পড়েও তেমন বিচলিত হইনি? কেন তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াইনি?

৩ জুলাই তাঁকে নিয়ে লিখছি—ফেনীর কোর্টে উপস্থিত হয়েছি ২৭ জুন। কেন ২৮ মার্চ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত তিন মাস সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদী হইনি? কেন প্রতিবাদী সবাইকে নিয়ে মিছিলের গ্রাম-শহর গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম না? কেন আমরা প্রতিবাদীরা শুধু ব্যানার হাতে প্রেসক্লাব বা রাজপথে কিছুক্ষণের জন্য নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছি?

আমি এই মর্ম পীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ফেনী ও সোনাগাজীতে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে বিবেক জাগ্রত করেছি। আমি যেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ‘সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি’তে এই কাজের জন্য ছুটি চাওয়ার আবেদনপত্রে কর্তৃপক্ষ সাদরে সম্মতি দিয়ে জানাল এই ছুটি হবে ‘On duty’—অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবেই আমি এই কাজটিতে যুক্ত থাকব। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিষয়ক শিক্ষক ও আইনজ্ঞ আফরিন ইসলাম এবং আমি নুসরাতের সাহসিক যুদ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তাঁর অসমাপ্ত ‘মুক্তিযুদ্ধকে’ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করা শুরু করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্রীদের ‘নুসরাত পদক’ প্রদানের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।

প্রায় সব পত্রিকায় নুসরাত হত্যার ঘটনাটি এবং এর পেছনে অথচ অগ্রগণ্য হিসেবে ‘ধর্ষণ’-এর অপরাধটির বিশদ খবর প্রকাশিত হয়েছে। ৭ এপ্রিল থেকে আজ ৩ জুলাই পর্যন্ত (যখন লেখাটি লিখছি) এই বিষয়ক খবরের বিস্তারিত তালিকা সংগ্রহ করেছি প্রথম আলোর লাইব্রেরি বিভাগ থেকে। ‘মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা—ফেনীর সোনাগাজী’(০৭-০৪-১৯) শিরোনাম দিয়ে শুরু এবং ‘অধ্যক্ষের নির্দেশেই এ হত্যা’ (২৮-০৬-১৯) শিরোনামের খবর পর্যন্ত প্রতিটি পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর থেকে আমরা জানতে পারছি নুসরাতের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে।

নুসরাতকে আজ আর নিহত বা নির্যাতিত বললে চলবে না—স্বীকৃতি দিতে হবে তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধ’কে।

কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ১৯৬৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে অনেক ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। কিছু ঘটনা মনে দাগ কেটে আছে। স্মৃতিভান্ডার থেকে কিছু ঘটনা স্মরণ করতে পারছি—১. মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংকারে পাকিস্তান আর্মির দ্বারা নির্যাতিত নারীদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উপেক্ষিত হওয়ার বিষয়টি, ‘বীরাঙ্গনা’ বলে তাঁদের প্রতি নির্যাতনের অপরাধ ঢেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা। ২. ১৯৭৬ সালে রাজশাহীতে নীহারবানু হত্যাকাণ্ড। ৩. ১৯৭৮ সালে সালেহা হত্যাকাণ্ড। ৪. ১৯৮৫ সালে ‘শবমেহের’ হত্যাকাণ্ড (টানবাজারের পতিতা কেন্দ্রে)। ৫. কিশোরী সিকো বর্মণকে ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড (১৯৯০)। ৬. সিলেটের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহানকে ১০১টি পাথর ছুড়ে নির্যাতন করার পর ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি নূরজাহানের আত্মহত্যার ঘটনা। ৭. ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট পুলিশ কর্তৃক দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে হত্যা। ৮. ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর রাউজান থানায় পুলিশি হেফাজতে ধর্ষিত সীমা চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড। ৯. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০ সালে নববর্ষের উৎসবে তরুণী লাঞ্ছনা।

এসব ঘটনার শেষ হচ্ছে না। আইনি পদক্ষেপ ও বিচার-প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হতে হতে ঘটে যাচ্ছে আরও ধর্ষণের অপরাধ।

আজ আমাদের বিবেকের ওপর কশাঘাত পড়ছে। দাবি সোচ্চার করতে হবে, জনগণের আন্দোলন তীব্রতর করতে হবে। কতিপয় দুর্বৃত্ত পুরুষ মেয়েদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ঘরে-বাইরে সর্বত্র। মেয়েদের ওপর পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান চাপিয়ে দিচ্ছে সতর্কতা ও নিষেধাজ্ঞা। সেসব নিষেধাজ্ঞা ভেঙে বেরিয়ে পড়তে হবে কাজে, উৎসবে, অনুষ্ঠানে। মেয়েরা ঘর থেকে বের হবে। সে জন্য নিজেরাই পরিবেশ তৈরি করবে এবং একই সঙ্গে পরিবার-প্রতিষ্ঠানের সকলে, রাষ্ট্র-আইনসমূহ ও প্রতিষ্ঠান পাশে থাকবে। মেয়েদের মুক্ত সাহসের শক্তিই দুর্বৃত্তদের পাশে বৃত্ত তৈরি করে বাধা দেবে। দুর্বৃত্তরা ভয় পাবে—মেয়েরা নয়। হাজার হাজার, লক্ষ-কোটি মেয়ে সাহসী হয়ে পথে নামবে, ভয় পাবে দুর্বৃত্তরা।

নুসরাত হয়ে উঠেছেন সাহসের প্রতীক। একজন নির্যাতিত মেয়ে সাহসী হয়েছেন, মা-বাবা-ভাই সাহস সঞ্চার করেছেন; নিজ থেকে পুলিশের কাছে ডায়েরি করেছেন থানায়—এমন ঘটনা আমাদের দেশে বিরল। নুসরাতের মা, বাবা, ভাই হয়েছেন সহযোগী অনুপ্রেরক। এ রকম প্রতিবাদী সাহসী পরিবার-সমাজ গড়ার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন নুসরাত। বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াচ্ছে, রুখে দাঁড়াবে জনগণ। এই হোক আমাদের শপথ।

ড. মালেকা বেগম লেখক, গবেষক। চেয়ারপারসন, সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা