নারী

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চায় নারীরা কি পিছিয়ে?

আজ ‘বিজ্ঞানচর্চায় নারী ও কন্যাশিশুবিষয়ক আন্তর্জাতিক দিবস’। এ দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, নারী ও কন্যাশিশুরা যাতে উদ্ভাবক ও বৈজ্ঞানিক গবেষক হিসেবে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারে, সে জন্য তাদের অনুপ্রেরণা ও সহায়তা জোগাতে হবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর ৫৩ শতাংশ নারী (স্নাতকে ৪৪ ও স্নাতকোত্তরে ৫৫), আর পিএইচডি পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষায় নারী পুরুষের প্রায় সমকক্ষ হয়েছেন। কিন্তু বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। সম্প্রতি নেচার সাময়িকীর এক গবেষণায় দেখা যায়, ৮৩ হাজার গবেষণাপত্রের মাত্র ১৭ শতাংশের প্রধান গবেষক ছিলেন নারীরা। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৭ সালের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী শিক্ষার্থীর হার মাত্র ২০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অন্যান্য প্রকৌশল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এই হার আশাব্যঞ্জক নয়।

এসব তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত ক্ষেত্রের পেশার জনপ্রিয়তা বেশ কম।  

প্রতিবছর ১১ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীদের অবদানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ‘বিজ্ঞানচর্চায় নারী ও কন্যাশিশুবিষয়ক আন্তর্জাতিক দিবস’ পালিত হয়। এ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে অভিভাবক-সন্তান, ছাত্র-শিক্ষক, পরিবার পরিজন, বন্ধুমহল ও নীতি প্রণয়নকারীদের নিয়ে বেশি বেশি মুক্ত আলোচনা করা দরকার। সংলাপেই সচেতনতা বৃদ্ধি হবে এবং বিজ্ঞানচর্চায় নারীর অংশগ্রহণের বাধাগুলো দূর হবে।

আইসিডিডিআরবির কৌশলগত পরিকল্পনার ৬টি লক্ষ্যের একটি হলো কর্মীদের উন্নয়ন ও নারীদের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। এতে বলা হয়েছে, ‘গবেষণায় স্থানীয় দক্ষতা উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আমরা গবেষণা ও অন্যান্য কাজে নিয়োজিত সাধারণ কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করব। কর্মজীবনের মধ্যবর্তী পর্যায়ের কর্মী ও নারী গবেষকদের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।’ আইসিডিডিআরবিতে অনেক নারী গবেষক কর্মরত আছেন, যাঁরা নিজের কাজে ও নতুন নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছেন। এখানে বর্তমানে মোট গবেষকের ৩০ শতাংশ নারী।

আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরী এই উপমহাদেশের প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি ২০১২ সালে ফ্রেঞ্চ একাডেমি অব সায়েন্সেস থেকে ক্রিস্টোফ এবং রডলফ মেরিইয়ু ফাউন্ডেশন পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চায় নারীদের অংশগ্রহণে প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয় শিক্ষার প্রাথমিক ধাপ থেকেই এবং পরের ধাপগুলোতে তা ক্রমশ বাড়ে। বিজ্ঞানচর্চায় অংশগ্রহণকারী নারীদের জীবন ও কাজ সম্পর্কে বাস্তব ধারণার অভাব, কুসংস্কার, স্থায়ী চাকরির অদৃশ্য প্রলোভন ইত্যাদি অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা সহকর্মীদের জন্য মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চার উৎসাহ প্রদানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আশার কথা হলো বাংলাদেশে এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমালা, বাংলাদেশ পারসপেক্টিভ প্ল্যান ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ বিজ্ঞান গবেষণায় নারীদের জন্য নিত্যনতুন সুযোগ তৈরি করে চলেছে। নারীদের এসব সুযোগ কাজে লাগানোতে সচেষ্ট হতে হবে। সমাজ ও পরিবারের উচিত নতুন ও রোমাঞ্চকর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নারীদের উৎসাহিত করা এবং মানসিক শক্তি জোগানো।

আইসিডিডিআরবির সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও তিনটি গ্লোবাল পেটেন্টের অধিকারী ড. রুবহানা রকিব মনে করেন, আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যা ও জনশক্তির একটি বড় অংশই নারী, যাঁরা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। শিক্ষাঙ্গনেও তাঁদের ভূমিকা অনবদ্য। নিঃসন্দেহে তাঁরা বিজ্ঞান ও গবেষণায়ও বিশেষ অবদান রাখার যোগ্য। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আমাদের দেশ পিছিয়ে পড়ছে, নারীদের জোরদার
অংশগ্রহণ ছাড়া আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব। সব ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপ্তি অনেক বিশাল, তা কৃষি খাতে বা জনস্বাস্থ্য খাতে বা কলকারখানায়ই হোক না কেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর প্রয়োজন। একজন কর্মজীবী মা-ই তাঁর কন্যাকে এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জোগাতে পারেন। প্রচলিত ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গির সংশোধনই পারে এ অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে।

আইসিডিডিআরবিতে অসংক্রামক রোগ নিয়ে কর্মরত সহযোগী বিজ্ঞানী ডা. কামরুন নাহার কলি। নবীন এই বিজ্ঞানী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের দক্ষিণ এশিয়া ২০১৭ পুরস্কার অর্জন করেছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগে। তাঁর মতে, গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চায় বৈষম্য শুরু হয় মেডিকেল শিক্ষা জীবনের প্রথম থেকেই। ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের ওপর যতটা জোর দেওয়া হয়, তার সামান্য অংশও দেওয়া হয় না গবেষণা উদ্ভাবনে। গবেষণায় যোগ দেওয়ার পরেও অনেক বাধা থেকে যায়। কাজের বাঁধাধরা সময় না থাকা, গবেষণার জন্য মাঝেমধ্যে অনিরাপদ জায়গায় কাজ করতে যাওয়া, সংসার, সন্তান পালন ইত্যাদি প্রতিকূলতা থাকে। তবে এখন ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ইচ্ছাশক্তি ও একাগ্রতার জোরে বিজ্ঞানচর্চায় সফল হওয়া সম্ভব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, ভবিষ্যতে চাকরির বাজারে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত ক্ষেত্রের চাকরিই অগ্রাধিকার পাবে।

গবেষণার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের সমান অবদান রাখতে সক্ষম; তাঁদের অগ্রগতি সামাজিক–পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি বা কুসংস্কারের কারণে দমিয়ে রাখা উচিত নয়। বিজ্ঞানে আমাদের অনেক নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন এবং সে জন্য আমাদের করণীয়ও অনেক। বাংলাদেশের নারীরা অনেক পরিশ্রমী; বিজ্ঞান গবেষণা ও উদ্ভাবনে অংশগ্রহণ করে তাঁরা দেশের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।

ক্যাথরিন স্পেন্সার আইসিডিডিআরবির কমিউনিকেশনস ও চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক

এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান আইসিডিডিআরবির মিডিয়া ম্যানেজার