মতামত: মহামারি

বাংলাদেশে করোনা-রাত কেটে যাচ্ছে!

করোনা-অমানিশার অবসান কি হতে যাচ্ছে? ভোরের আলো ফুটে উঠছে? পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে? নাকি এটা ভুল ভোর! সুবহে কাজিব।

প্রথমেই প্রথম আলো থেকে দুটো খবর সরাসরি তুলে দিই।

১. ‘ময়মনসিংহে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের পর এই প্রথমবার সংক্রমণবিহীন একটি দিন পার করেছে ময়মনসিংহবাসী। আজ বুধবার প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে জেলায় নতুন করে একজনও করোনা পজিটিভ শনাক্ত হননি।’ (প্রথম আলো ডটকম, ৬ জানুয়ারি ২০২১।)

২. ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা উৎপাদন করার অনুমোদন পেয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক। গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রধান ডা. আসিফ মাহমুদ প্রথম আলোকে আজ বুধবার এ তথ্য জানান। ডা. আসিফ মাহমুদ জানান, তাঁরা এই টিকার নাম দিয়েছেন ‘বঙ্গভ্যাক্স’। (প্রথম আলো ডটকম, ৬ জানুয়ারি ২০২১)

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করোনা মানচিত্রের দিকে তাকাই। দেখতে পাই, বিশ্বজুড়ে করোনা পজিটিভ মানুষের সংখ্যা কমে আসছে। এখনো অবস্থা ভয়ংকর যুক্তরাষ্ট্রে, ইউরোপেও অবস্থা আশাপ্রদ নয়। কিন্তু তারপরও গ্রাফ নিম্নমুখী। এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়ায়, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় কোভিড–আক্রান্তদের সংখ্যা কমে আসছে। প্রথম আলো লিখেছে, বাংলাদেশে তিন সপ্তাহ ধরে রোগী শনাক্তের হার হাজারের নিচে। ৬ জানুয়ারির খবর, দেশে আগের ২৪ ঘণ্টায় কোভিডে মৃত্যু ১৭। এর আগের দিন ছিল ২০। গতকাল বৃহস্পতিবার অবশ্য মৃত্যু বেড়ে গেছে, আক্রান্তের সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়েছে। আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ৩১ জনের, একই সময় নতুন করে আরও এক হাজার সাতজন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

আমরা যে আশঙ্কা করেছিলাম, শীতে করোনা সংক্রমণ বাড়বে ভয়াবহভাবে, কোভিডে মৃত্যু বেড়ে যাবে ভয়ংকর রকম, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ তা বলছে না। বরং বাংলাদেশের গ্রাফের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

যদিও আমরা কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে পারছি না। বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা এখন কিন্তু জানেন স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল কী। কোন ধাপের পরে কী করতে হয়। ফলে সময় থাকতে হাসপাতালে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন। ভেন্টিলেটর নয়, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলা জীবন রক্ষাকারী উপকরণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ঢাকার বাইরেও অনেক হাসপাতালে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুতরাং মানুষের উচিত সচেতন হওয়া, চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলা এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে রাখা।

আমি ভোর দেখতে পাচ্ছি। আমি আশাবাদী মানুষ। আশার কথা বলা আমি ছাড়ব না। আমি যাঁকে আদর্শ মানি, সেই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, মিথ্যা হলেও আশার কথা লিখবে। কারণ, আশা লাভজনক। আমি বলি, আমি মিথ্যা করে আশার কথা বলছি না। করোনাযুদ্ধে অনেক ক্ষতি সত্ত্বেও বলব, বাংলাদেশ এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে। আর এই বিজয়ের পেছনে আছে সরকারের সাহসী সিদ্ধান্ত। কলকারখানা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খোলা রাখা, কৃষক-শ্রমিক–সাধারণ মানুষের অবদান, প্রবাসী জনশক্তির নিজেকে উজাড় করে দেশের সেবা করে যাওয়া, প্রশাসন-পুলিশ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা-সাংবাদিক-চিকিৎসক—সর্বস্তরের মানুষের কাজকর্ম থেকে নিরত না থাকা।

করোনা আক্রান্তের হার যে কমছে, এর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ কী, বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। করোনা বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁরা বলে থাকেন, যেমন বলেন আমেরিকার ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডা. অ্যান্টনি ফাউসি, করোনা বিষয়ে আসলে আমরা বেশি কিছু জানি না। যে যা বলছেন, সবই অনুমান থেকে। আসল কথা হলো, বলার মতো আমরা কিছুই জানি না। বিশেষজ্ঞরা যেখানে কথা বলতে সাতবার ভাববেন, আমার মতো মূর্খরা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি বলি, আগস্ট মাসে যদি ৪৫ ভাগ ঢাকাবাসী, ৭৫ ভাগ বস্তিবাসীর করোনা সংক্রমণ হয়ে গিয়ে থাকে, জানুয়ারি মাসে তাহলে ৯০ ভাগ ঢাকাবাসী, ১০০ ভাগ বস্তিবাসীর দেহে অ্যান্টিবডি থাকার কথা। কাজেই করোনার সংক্রমণ কমে আসতে বাধ্য। ফেব্রুয়ারি–মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণ ঢাকা শহরে একদমই কমে আসবে। ঢাকার বাইরে বহু জায়গায় করোনা যায়নি, সেখানে সংক্রমণ অব্যাহত থাকবে, যদি টিকা না দেওয়া হয়। কাজেই টিকা লাগবে এবং তা লাগবে অবিলম্বে।

ইউরোপ–আমেরিকায় যাঁরা শত শত মাইল গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরেন, তাঁরা বলেন, অ্যাকসিডেন্ট কিন্তু হয় বাড়ির কাছে এসে। পর্বতারোহীরা ওঠার সময় নয়, সাধারণত বিপদে পড়েন নামার সময়। অর্থাৎ তীরে এসে তরি ডুবে যায়, এই রকম একটা নিয়ম আছে। আমরা করোনাযুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছি, কিন্তু বিজয় এখনো হাতের মুঠোয় আসেনি। এখন যদি আমরা গা ছেড়ে দিই কিংবা ভুল করে বসি, তাহলে জয় হাত ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে।

কতগুলো কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিই।

১. মৃত্যুহার কমানোর সংগ্রাম জোরদার করা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানোলাসহ সব রকম সুবিধা জনগণের আওতাধীন রাখা। আমাদেরও সচেতন থাকতে হবে। ঠিক সময়ে ঠিক হাসপাতালে যেতে হবে। সব সময়ই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

২. স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। নিয়ম মেনে মাস্ক পরা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। ভিড় এড়িয়ে চলা।

৩. করোনাকাল দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থা ভয়াবহ, দুর্নীতি করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়ংকর এবং প্রবল। করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতের ওপরে সার্চলাইট পড়েছে বলে এসব নিয়ে কথা হচ্ছে, অন্যত্র আলো ফেললে একই ভাইরাস ধরা পড়বে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা সর্বাত্মক সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে।

৪. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা আনা এবং টিকা দেওয়া। টিকা নিয়ে যেন কোনো কেলেঙ্কারি না হয়। কেউ যেন নকল টিকা দিয়ে মানুষকে প্রতারিত না করতে পারে। টিকা–বাণিজ্য করে কেউ যেন অন্যায্যভাবে একচেটিয়া মুনাফা করতে না পারে। তদারকি, নজরদারি বজায় রেখে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করে বেসরকারি খাতে টিকা আমদানির পথ খুলে রাখা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। প্রথম দিকে করোনা পরীক্ষা এবং চিকিৎসা শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরে তা বেসরকারি খাতেও খুলে দেওয়া হয়। তাতে প্রথম দিকে রিজেন্টের মতো প্রতারকেরা প্রতারণা করেছে বটে, শেষে তা সুফল দিয়েছে। টিকা আমদানি এবং বাজারজাত করা সরকারি কঠোর নজরদারি এবং মান নিয়ন্ত্রণের মধ্যে বেসরকারি খাতে খুলে দেওয়া সুফল দিতে পারে।

বাংলাদেশের মানুষ আবারও প্রমাণ করেছে, দুর্যোগে–দুর্বিপাকে টিকে থাকার এক অসম্ভব অমিত শক্তি আমাদের আছে। করোনার বিরুদ্ধে আমরা শুধু টিকে থাকছি না, আমরা ভালো করছি। এই একটা ব্যাপারে আমরা বলব, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে নিজেদের শক্তিশালী প্রমাণ করতে পেরেছি। পরমাণুসজ্জিত দেশগুলোকে আমরা বলতেই পারি, কাকে বলে জাতীয় নিরাপত্তা, যদি না বাঁচে তোমাদের দেশের মানুষ?

তবে শুধু বাংলাদেশ একা করোনাযুদ্ধে জয়লাভ করলেই ভালো করবে না। প্রথম বিশ্বকেও করোনা-দুঃস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। টিকার কারণে ফেব্রুয়ারি–মার্চ থেকে সারা পৃথিবীই চনমনে হয়ে উঠবে। এক বছর, দেড় বছরের ক্ষতি সামলে নিতে সারা পৃথিবী কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি পাবে। বাংলাদেশের পালে সেই দখিনা বাতাস এসে লাগবে। তরতরিয়ে এগিয়ে যাব আমরা।

পৃথিবীতে করোনা-উত্তর বসন্তকাল আসছে। বাংলাদেশের গাছে গাছে দুলে উঠবে নতুন সবুজ পাতা, গেয়ে উঠবে দোয়েল, কোকিল, শ্যামা, মৌটুসি। রাত্রি যত গভীর হয়, প্রভাত তত কাছে আসে। আমাদের ভোর আসছে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক