২০১৫ সালে বাংলাদেশ যখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেল, তখন অনেকেরই স্বাধীনতার পর এ দেশে সংস্থাটির প্রথম কর্ণধার জাস্ট ফ্যালান্ডের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ফ্যালান্ড ও সহ-অর্থনীতিবিদ জন রিচার্ড পারকিনসন এ দেশকে ‘উন্নয়নের মূর্তিমান পরীক্ষা’ বলে মত দিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট বইয়ে তাঁরা লিখেছেন,
‘অধিকাংশ শিক্ষিতজনের...প্রত্যাশা থাকে মানুষ ঘটনাবলি ও তার নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু...মানুষ নয়, প্রকৃতিই বাংলাদেশের পরিস্থিতির নিয়ন্তা...।...কোনো সমস্যাই থাকত না যদি বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হতো ও তার জনসংখ্যা কম হতো, যদি তার একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা থাকত এবং যদি তার সামাজিক শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবৃদ্ধি–সহায়ক হতো, কিন্তু তার কিছুই এখানে নেই।’
ফ্যালান্ড-পারকিনসনের বই প্রকাশের ৪০ বছর পর বাংলাদেশ আজ আবার বিশ্বব্যাংকের আয়নায় বিশেষভাবে ধরা পড়েছে। চরম দারিদ্র্য নিরসনে এ দেশের ‘আশ্চর্য’ সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম স্বয়ং হাজির হয়েছেন। জাতিসংঘ–ঘোষিত আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উপলক্ষে গত বছরের ১৭ অক্টোবর ঢাকায় উপস্থিত কিম তাঁর ভাষণে বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীকে দেখিয়েছে কঠিন পরিস্থিতির বিরাট তালিকা থেকেও উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। এ দেশের জনগণ দেখিয়েছে উদ্ভাবন, নিষ্ঠা, লক্ষ্য নির্ধারণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের সমন্বয়ে এমন কিছু করা সম্ভব, যা কল্পনা করাও কঠিন।’
সময়ের ব্যবধানে একই প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধারের বিপরীত বক্তব্যের মূলে আছে বাংলাদেশের দুঃসাহস বুকে বেঁধে পথচলা। একজন যা কল্পনাও করতে পারেননি, অন্যজন তা চাক্ষুষ করেছেন।
২.
ফ্যালান্ড-পারকিনসন যেমনটা বলেছিলেন, জাতীয় উন্নয়নের চেনা পথে হাঁটার জন্য যে ভিত্তি প্রয়োজন, অর্থাৎ বৃহৎ মাত্রার শিল্প, কৃষি, খনিজ সম্পদ, এসবের কিছুই বাংলাদেশের ছিল না। এগিয়ে যাওয়ার জন্য এ দেশকে তাই নিজের পথ কেটে নিতে হয়েছে। সেই পথ হচ্ছে জনগণের সামাজিক উন্নয়নকে নিবিড়ভাবে জড়িত করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। দরিদ্র পরিবারগুলোর ছোট ছোট উদ্যোগে আয় বৃদ্ধি, দরিদ্রতমদের জন্য উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি, নিম্নআয়ের মানুষের ব্যাপক অভিবাসন, মেয়েদের আয়মূলক পেশায় যোগদান, দুর্যোগ মোকাবিলায় সামর্থ্য বৃদ্ধি, প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে গমন, পরিবার পরিকল্পনার সুবিধা পৌঁছানোর ফলে পরিবারের গড় আকার হ্রাস, পোলিও ও গুটিবসন্ত নির্মূল, রাতকানা রোগ প্রতিরোধ, যক্ষ্মা ও ডায়রিয়ার মতো জীবন, শক্তি ও অর্থ ক্ষয়কারী রোগ নিয়ন্ত্রণসহ স্বাস্থ্য খাতের দারুণ কিছু সাফল্য—এসব অর্জন দেশের কোটি কোটি গরিব মানুষের জীবনে সামগ্রিক পরিবর্তন এনেছে। তার সামষ্টিক চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে জাতীয় অগ্রগতির বিবিধ সূচকে এবং আমাদের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি অর্জনে, যার আওতায় ২০১৫ সাল নাগাদ দারিদ্র্যের হার ২৯ শতাংশে নামিয়ে আনার নির্ধারিত লক্ষ্য ২০১২ সালেই পূরণ করেছি আমরা।
দেশের এই অর্জনের পেছনে সাধারণ মানুষের উদ্যোগ ও উদ্ভাবন সবচেয়ে বড় অনুঘটক। তবে তাঁদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়ক পরিবেশটি তৈরিতে সরকারের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিনির্ধারণ এবং বহুবিধ অন্তরায় সত্ত্বেও তার ধারাবাহিক বাস্তবায়ন নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাত তথা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিও এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন উদ্যোগের অবদানও অনেক। বিশেষ করে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস, গরিব মানুষের কাছে মৌলিক সেবাগুলো পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এবং নারীর অগ্রগতিতে এনজিওর অবদান অনস্বীকার্য।
৩.
তবে আজকের ক্রম অগ্রসরমাণ বাংলাদেশে এনজিওর প্রয়োজন আদৌ আছে কি না, কেউ কেউ এ প্রশ্ন তুলছেন। এককথায় এর উত্তরটা হলো, অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কারণ, সমাজের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সমস্যার রূপ ও মাত্রা আজ যখন নিয়ত বদলে যাচ্ছে, তার সমাধানে এসব সংগঠন একইভাবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম। একই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত দেশেও ১৫ লাখের বেশি এনজিও রয়েছে। দেশের আর্থসামাজিক বলয়ে যেসব পরিবর্তন আমরা ক্রমশ দেখতে পাচ্ছি, তার পেছনে দ্রুত নগরায়ণ, যুগোপযোগী মানসম্মত শিক্ষার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন, তরুণদের কর্মসংস্থান, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, জীবনযাপনে ব্যাপক পরিবর্তন ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তার প্রভাব অন্যতম মূল কারণ। আগামী বছরগুলোতে এসবের প্রভাব আরও প্রকট হবে। নতুন সমস্যার নতুন সমাধান উদ্ভাবনে এনজিওগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে তাদের উদ্ভাবন নিয়ে।
তবে এনজিওর ক্ষেত্রে অর্থায়ন একটি বড় অন্তরায়। এসব সংস্থার কার্যক্রমের বড় অংশ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় পরিচালিত হয়। অবশ্য দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ সরকার নিজস্ব কর্মসূচিতে ব্যয় করে। দাতা সাহায্যের চিত্রটি ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে। কেননা, বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের মুখে দাতাগোষ্ঠী ক্রমশ আরও বিপন্ন দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছে। নিজস্ব সম্পদ ব্যয় করে সর্বোচ্চ ফলাফল আনতে সরকারকে তাই অনেক বেশি মনোযোগী হতে হবে। অন্যদিকে এ পরিস্থিতিতে এনজিওর জন্য অর্থায়ন হতে পারে দুভাবে—সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ অথবা সরকারের অর্থায়ন।
সত্যিকারের ভালো পণ্য উৎপাদন বা সেবা গড়ে তুলতে পারলে সামাজিক কল্যাণে তা যে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সক্ষম, ব্র্যাকের সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগগুলো তার প্রমাণ। সংস্থাটির প্রধান সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ আড়ংয়ের মাধ্যমে ৬৫ হাজার কারুশিল্পী যেমন জীবিকা নির্বাহ করছেন, এর লাভের একটি বড় অংশ ব্যয় করা হচ্ছে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, শিক্ষাসেবাসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে।
এ ধরনের ব্যবসায় উদ্যোগের ক্ষেত্রে মৌলিক যে ধারণাটি কাজ করে তা হচ্ছে, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল অংশটির কাছে মানসম্মত পণ্য ও সেবা বিক্রি করা থেকে প্রাপ্ত আয় সামাজিক উন্নয়নকাজে ব্যয় করা। বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভর অনেক এনজিওকে অর্থনৈতিক স্থিতির জন্য এ ধরনের সামাজিক ব্যবসার কথা ভাবতে হবে। অন্যদিকে সরকার-গৃহীত বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এনজিওগুলোর সম্পৃক্তি বাড়াতে হবে।
৪.
আগামী ১৫ বছরে সরকারের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা; যার ফলে ২০৩০-৩১ অর্থবছর নাগাদ মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৪ হাজার ১৩৬ মার্কিন ডলারের বেশি। এই উন্নয়ন যাতে সবার কাছে পৌঁছায়, সে জন্য এমডিজি-পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বা এসডিজির লক্ষ্যগুলো ধরে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার, যার প্রতিফলন আমরা চলতি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যে দেখতে পাই।
তবে ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক সহায়তা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি, উদ্ভাবনী মডেলের অভাবসহ বিবিধ অন্তরায়ের মুখে এই লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় ভূমিকা হবে নীতিনির্ধারক ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাকারীর, যা সরকারি-বেসরকারি সব খাতের জন্য কাজের অনুকূল পরিসর সৃষ্টি করবে।
আগামীর লক্ষ্য এগিয়ে নিতে এনজিওর মতো সামাজিক সংগঠনগুলোকে কাজে লাগানো একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হওয়া প্রয়োজন। গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সফল মডেল উদ্ভাবন করেছে তারা।
এ দেশে ছোট-বড় অনেক সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সাথি হয়েছে এনজিও। তৃণমূল পর্যায়ে খাওয়ার স্যালাইন বানানোর পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে ১৯৮০-এর দশকে সরকার, আইসিডিডিআরবি এবং ব্র্যাকের যৌথ উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে সফল এক দৃষ্টান্ত। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ২৩টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাস্তবায়ন করছে। শুধু স্বাস্থ্য নয়, অন্যান্য খাতেও এমন সফল দৃষ্টান্ত আছে।
তবে এ পর্যন্ত দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তায় পরিচালিত প্রকল্পগুলোতেই কেবল সরকার-এনজিও সহযোগের দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে। এখন অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে পরিচালিত কর্মসূচির ক্ষেত্রেও এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে।
মনে রাখতে হবে, সামাজিক সংগঠনগুলো কখনো সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সে প্রশ্ন ওঠার কোনো অবকাশও নেই। সরকার রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ, আর এনজিও আর্থসামাজিক উন্নয়নে কর্মরত একটি খাত মাত্র। তবে সাংগঠনিক সংস্কৃতির কারণেই সামাজিক সংগঠনগুলোর পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব, যা করা সরকারের পক্ষে অনেক সময় কঠিন হয়ে ওঠে। আবার সরকার ব্যাপকভিত্তিক যেমন উদ্যোগ নিতে পারে, অধিকাংশ এনজিওর পক্ষে তেমনটা সম্ভব নয়।
এনজিও বা অন্য যেকোনো ধরনের সামাজিক সংগঠনের গোড়ায় আছে সমষ্টির কল্যাণে কাজের হাজার বছরের পুরোনো মানব ঐতিহ্য। দেশ বা সমাজের বিরাট অগ্রগতিতেও তার প্রয়োজন ফুরায় না। দাতাদের সাহায্য হ্রাসে এনজিওগুলো তহবিলের সমস্যায় পড়লেও আশা করা যায়, অর্থায়নের বিকল্প উৎস তারা উদ্ভাবন করবে। সরকারের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা জরুরি।
আমরা চাই বাংলাদেশের উন্নয়ন যেন সমতাভিত্তিক হয়। সমকালীন বিশ্বে মূলধারার উন্নয়ন প্রক্রিয়ার একটা বড় নেতিবাচক ফলাফল এই যে, এর ফলে সামাজিক বৈষম্য হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে আরও প্রকট হয়েছে। সামনের অভিযাত্রায় এদিকে আমাদের বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য স্থির করেছে বাংলাদেশ, তা অর্জন করতে হলে সব পক্ষকে অতীতের চেয়েও ঘনিষ্ঠভাবে ও একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
আসিফ সালেহ্: ঊর্ধ্বতন পরিচালক, ব্র্যাক।