আমরা এখন ‘ইনস্ট্যান্ট’ বা ‘তাৎক্ষণিকতার’ যুগে আছি। ফেসবুক, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের ডিজিটাল বাংলাদেশে জীবন যেন এখন ইনস্ট্যান্ট বা তাৎক্ষণিক। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বা কোথাও বেড়াতে গেলে ফেসবুকে দিচ্ছি ইনস্ট্যান্ট চেক ইন, প্রিয়জনের সঙ্গে ফেসবুকে দিচ্ছি ইনস্ট্যান্ট সেলফি, কোনো কৌতূহলোদ্দীপক জিনিস দেখলে হচ্ছি ফেসবুক লাইভ। টেক্সট মেসেজ, হোয়াটসআপ আর ভাইবারের ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকা মুখ থুবড়ে পড়া এই শহরে ভার্চ্যুয়াল জীবনের মায়াটানে আমাদের জীবন যেন এখন ধোঁয়া ওঠা এক কাপ ইনস্ট্যান্ট কফির মতো। এই ইনস্ট্যান্টের টানে মানসিকভাবে আমরা হয়ে পড়ছি কেমন অসহিষ্ণু। সবকিছু যেন ইনস্ট্যান্ট—তাৎক্ষণিক চাই। ধৈর্যের বড় অভাব। এই ইনস্ট্যান্ট মানসিকতার প্রভাব পড়ছে আমাদের সামাজিক জীবনের সর্বস্তরে। শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে এই ইনস্ট্যান্ট যুগের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত খাত।
এ কথা সবারই জানা যে দেশের প্রশাসন বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ নিয়ে নানা রকম তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা ও আলোচনা চলছে। কেউ কেউ মনে করছেন, শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগেই এ সমস্যার সমাধান হবে। অন্যদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন যে পদত্যাগেই সমাধান নিহিত নয়। কেউ কেউ শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশ্নপত্র-পদ্ধতি ঢেলে সাজানোর পক্ষে। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের অস্বাভাবিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে নানাভাবে চেষ্টা করে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না প্রশ্নপত্র ফাঁস। জাতি হিসেবে আমরা সবাই সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানে ব্যস্ত।
কিন্তু এই সার্বিক আলোচনায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যে ডিজিটাল যুগে আমাদের উদীয়মান নয়া ‘ইনস্ট্যান্ট’ জনসংস্কৃতির একটি দিক ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। আমার মতে, যেকোনো সমস্যার সমাধানে আমাদের প্রথমে সমস্যার নানা দিক সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা দরকার। কারণ, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটায় যেমন অপরাধের দিক আছে, তেমনি একশ্রেণির জনগোষ্ঠীর কাছে আছে এর সামাজিক চাহিদার দিকটি। এই সামাজিক চাহিদার জোগান ও সরবরাহে জড়িত আছে একশ্রেণির কোমলমতি শিক্ষার্থী, একশ্রেণির অভিভাবক, একশ্রেণির শিক্ষকসহ একশ্রেণির লোকজন, যাদের কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই ধরনের লোকজন প্রশ্নপত্র ফাঁসকে মোটেও অপরাধ হিসেবে দেখছেন বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, মিডিয়া ও সরকারিভাবে নানা রকম সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর পরেও বন্ধ হচ্ছে না এই ধরনের গর্হিত কাজ। খবরে দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় এবং যেখানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়া একশ্রেণির তরুণ-তরুণী নির্লিপ্তভাবে অংশ নিচ্ছেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন স্তরে।
এই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, আসলে কি হচ্ছে একশ্রেণির মানুষের মনে, যারা যেকোনো মূল্যে অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষায় ভালো করতে চাইছে। এই উত্তর খোঁজার আগে ভেবে নেওয়া দরকার, পরীক্ষার উদেশ্য কী? পরীক্ষা মানেই হচ্ছে মানুষের মেধার একটা র্যাঙ্কিং করা ও রেগুলেট করা, যাতে কিছু মানুষকে সামাজিকভাবে তাদের মেধার বদৌলতে জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া যায়। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ডোসাইল বডি’ বা ‘বাধ্য মানবদেহ’-তে বিশদভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ, মিলিটারি ও কারাগারে কীভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানবদেহকে রেগুলেট করা হয়, তা লিখেছেন। আসলে এটা অস্বীকার করার জো নেই যে যদিও পরীক্ষা হচ্ছে মানুষের মেধার র্যাঙ্কিং করা, এর একটা অর্থনৈতিক দিক আছে। সেদিক অত্যন্ত সরলভাবে চিন্তা করলে অনেকটা এ রকম—শরীর ও মন নিয়েই তৈরি হয় মানুষ। পরীক্ষা হচ্ছে মেধার বা মানসিক ক্যাপাসিটির র্যাঙ্কিং, কিন্তু একই সঙ্গে একটা মানুষ যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় ভালো চাকরি নিয়ে, তখন তাঁদের পাশবিক শরীর আরামে থাকবে। ভালো বাড়ি, ভালো গাড়ি, ভালো চাকরির সঙ্গে ভালো খাওয়া, ভালোভাবে নিজেদের শরীরকে আরাম-আয়েশের মধ্যে রাখার ব্যাপারটা আছে এবং এটা অনস্বীকার্য। আর যেহেতু বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তির জোগান বেশি এবং সরকারি ও বেসরকারি নানা রকম চাকরিতে কোটাসহ নানা রকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এখনো বিরাজমান, এটা ক্রমেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো অনৈতিক ও অপরাধমূলক কার্যক্রমকে সমস্যা মনে করছে না একশ্রেণির মানুষ। তাদের ব্যবহারে মনে হচ্ছে, ‘সুযোগ যেখানে কম, বৈষম্য যেখানে বিদ্যমান, যেকোনো মূল্যে ইনস্ট্যান্ট সাফল্য অর্জনে সমস্যা নেই’। মোটের ওপর অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে মানুষ। যেকোনো মূল্যে ইনস্ট্যান্ট সফলতা পাওয়ার এই সামাজিক মনোবাঞ্ছা মানুষের অসহিষ্ণুতারই প্রতিফলন, যেখানে নৈতিকতার স্থান অতি সামান্যই।
এই ধরনের অসহিষ্ণু সামাজিক সংস্কৃতির পেছনে সমাজের বিভিন্ন রকম কাঠামোগত পরিবর্তনকেও আমলে আনা উচিত। এর মধ্যে দ্রুত ডিজিটালাইজেশন একটি দিক। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই যে সরকারের সুচিন্তিত ডিজিটালাইজেশন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলছে। অনেক রকমভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা এনে দিয়েছে এ দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ। প্রতিটি জিনিসের যেমন ভালো ও খারাপ দিক আছে, তেমনি ডিজিটাল যুগের খারাপ দিকের একটি হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। বিটিআরসির তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে বাংলাদেশে ইন্টারনেট এর গ্রাহক ৮০ মিলিয়ন বা ৮ কোটি মানুষ। প্রায় ১৪ কোটি মানুষ মোবাইল ফোনের গ্রাহক, যার মধ্যে ৭ কোটির বেশি (৭২.৩ মিলিয়ন) মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আরেক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ফেসবুক ব্যবহারে বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্থানে আছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসে ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ও ফেসবুককে মাধ্যম করার ব্যাপারটি এখন সবারই জানা।
আসলে ইন্টারনেট, ফেসবুক ও মোবাইল ফোনের এই ডিজিটাল যুগে সামাজিক অসহিষ্ণুতার এই জনসংস্কৃতি চলছে বিশ্বজুড়েই। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চের ‘ইন্টারনেট ও আমেরিকান লাইফ’ নামক এক সমীক্ষায় সম্প্রতি উঠে এসেছে যে ৩৫ বছর ও তার নিচের বয়সী মানুষেরা এই হাইপার কানেক্টেড যুগে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। তারা সবকিছু ‘এখুনি চায়’, যেমন আমাদের একশ্রেণির মানুষ ‘সাফল্য’ এখুনি চায় যেকোনো মূল্যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে হলেও। কারণ, হাইস্পিড ইন্টারনেট সবকিছু দ্রুত করে দিয়েছে, মানুষ ইনস্ট্যান্ট বা এখুনি সবকিছু চায় এতে করে আমাদের ধৈর্য কমে উঠছে, কমে উঠছে অধ্যবসায় ও কষ্টের মাহাত্ম্য। যেকোনো মূল্যে এই ইনস্ট্যান্ট সফলতা চাওয়াকে ঠেকাতে জনসংস্কৃতির এই ইনস্ট্যান্ট দিকটি আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোঝা দরকার ও আমলে আনা দরকার।
ড. মোবাশ্বার হাসান: গবেষক ও শিক্ষক।