মতামত

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আবেগপ্রবণ করে কৌশিক বসুকে

বাঙালি অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু
ছবি : এএফপি

বাঙালি অর্থনীতিবিদ হিসেবে বহির্বিশ্বে অমর্ত্য সেনের পরেই যাঁর নাম ও খ্যাতি, তিনি কৌশিক বসু। বর্তমানে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এর আগে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যাক—২০১৭-২০ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট, ২০১২-১৬ বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, ২০০৯-১২ পর্যন্ত মনমোহন সিং সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং হার্ভার্ড, এমআইটি, প্রিন্সটন ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন তিনি। অনারারি ডক্টরেট পেয়েছেন লক্ষ্ণৌ ইউনিভার্সিটি, আসাম ইউনিভার্সিটি, ফোর্ডহাম ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (মুম্বাই), বাথ ইউনিভার্সিটি ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাবিলিটিজ অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট। নিউইয়র্ক টাইমস, সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ইন্ডিয়া টুডে ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ নিয়মিত কলাম লিখছেন।

দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের অধীন সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস প্রতিষ্ঠার সময় অধ্যাপক বসুকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে যেতে ও চিঠি লিখতে হয়েছে। সেই স্মৃতিচারণা থেকে কিছু মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। অধিকাংশ সময় তাঁর কোনো চিঠি বা ফোনকলের জবাব মিলত না। বাধ্য হয়ে এক সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহনের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। আমলারা যখন দেখলেন, তিনি খোদ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, তাঁদের আচরণ সম্পূর্ণ পাল্টে গেল এবং তাঁর কাজ উদ্ধার হলো। এরপর যখনই আমলাদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজন পড়ত, অর্থমন্ত্রীর দপ্তরে ওয়েটিং রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে তিনি চলে আসতেন, যাতে আমলারা দেখতে পান, অধ্যাপক বসু অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এবং দেখামাত্রই কাজ হাসিল!

মনমোহন সিং সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদে থাকাকালের স্মৃতিকথা-সংবলিত গ্রন্থ পলিসি মেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি-তে বেশ কিছু মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে। উন্নয়ন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠান এবং সরকার ও আমলাতন্ত্রের ওপর বিস্তর আলোচনা হয় কারণ, এগুলো উন্নয়নের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ভারতের আমলাদের বোঝতে চেয়েছেন গভীরভাবে। আক্ষরিক অর্থে তিনি একদিন গুনে গুনে হিসাব করে দেখেন, একজন আমলা তাঁর ঊর্ধ্বতনকে মিনিটে ১৬ বার ‘স্যার’ বলেন। আমলাদের চেয়ারে পিঠের নিচে একটি করে তোয়ালে রাখা থাকে, যার কারণ তিনি বুঝতে পারেননি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তিন বিভাগের তিন সচিবের জন্য একটি বিশেষ শৌচাগার ছিল, যেখানে কৌশিক বসুরও প্রবেশাধিকার ছিল না।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সানফ্রান্সিসকোয় অনুষ্ঠিত আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন কনফারেন্সে কৌশিক বসুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা আলাপ হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বলছিলেন, ‘তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, আমার বাবা-মা ও আমি নিজে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে ধন্য মনে করি। তার একটি প্রধান কারণ, হয়তো বাংলাদেশ আমার মায়ের দেশ। শরণার্থীদের দিকে তাকালে মনে হতো তাঁরা আমার মামাবাড়ি থেকে এসেছেন।’

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিকস, ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস, ওয়েলফেয়ার ইকোনমিকস, গেম থিওরি ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর পড়ানো ও কাজের জগৎ। প্রচুর আর্টিক্যাল ও বেশ কিছু বই লিখেছেন তিনি এসব বিষয়ে। দুর্নীতি বিষয়েও তাঁর বেশ কিছু গবেষণা আছে। দুর্নীতিরোধে তিনি ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি মজার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, যা ‘বসু প্রপোজাল’ নামে খ্যাত। ঘুষ দেওয়াকে বৈধ করা এবং ধরা পড়লে ঘুষের টাকা ঘুষ গ্রহীতাকে ফিরিয়ে দিতে হবে—এমন বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা। এই নীতির পেছনে যুক্তি হলো, এতে নাগরিকেরা ঘুষের খবর প্রকাশ করার প্রণোদনা পাবেন। ফলে, আমলারা ঘুষ চাইতে নিরুৎসাহিত হবেন।

উন্নয়ন অর্থনীতিতে দুর্নীতি বিষয়ে তথাকথিত ‘স্পিড মানি থিওরি’-এর সারকথা হলো, যখন একটি দেশে, বিশেষ করে সরকারি অফিসে ব্যাপক দুর্নীতি থাকে, কোনো ফাইল টাকা ছাড়া নড়ে না, তখন কিছু ঘুষ দিলে কাজটি তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে, পুরো অর্থনীতিই তার সুফল পাবে ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৬১-৭৯ সময়ে ব্যাপক দুর্নীতি ছিল, ঠিক সেই সময় ব্যাপক প্রবৃদ্ধিও অর্জিত হয়েছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ মুশতাক খান, সাউথ কোরিয়ান পলিসি-এক্সপার্ট, হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট অধ্যাপক জং-সু ইউসহ অনেকেই দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ টেনে ‘স্পিড মানি থিওরি’ যুক্তিযুক্ত মনে করেন।

দুর্নীতি বিষয়ে অধ্যাপক বসুর প্রস্তাবিত নীতিও এই ধারার। তবে এ বিষয়ে আমার অভিমত হলো, ‘স্পিড মানি থিওরি’ বা ‘বসু প্রপোজাল’ সমর্থনযোগ্য একমাত্র যখন রাজনীতিবিদ ও ব্যুরোক্রেসি দুর্নীতি দ্বারা সম্পূর্ণভাবে আক্রান্ত অর্থাৎ এমন নীতি, ওয়েলফেয়ার ইকোনমিকসের ভাষায়, ‘সেকেন্ড বেস্ট ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে গণ্য করতে হবে। কারণ, দুর্নীতির প্রভাব শুধু অর্থনৈতিকই নয়, এর সাংস্কৃতিক প্রভাবও মারাত্মক। দুর্নীতি সমাজে ব্যাপক বৈষম্যও সৃষ্টি করে, যা মানুষকে অসুখী করে।

কৌশিক বসুর জীবন ও কর্ম অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি লিখেছেন, তাঁর বাবা ছিলেন একজন কংগ্রেসের নেতা। এক সময় তিনি কলকাতার মেয়র ছিলেন। তিনি জীবনে প্রথম ভোট দিতে গিয়েছিলেন মা-বাবার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর বাবা যে দলের রাজনীতি করতেন, সেই দলে ভোট না দিয়ে তিনি ভোট দিয়েছিলেন সিপিএমকে। ওই অল্প বয়সেই তিনি বাবার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, বামপন্থা ছাড়া মুক্তি হবে না দেশের শ্রমজীবী মানুষের।

পিএইচডির পর বিশ্বব্যাংকে চাকরির আবেদন করেও তিনি চাকরি পাননি। তিনি এখন বলেন, ‘চাকরি না পাওয়া ছিল আমার জন্য শাপে বর। কারণ, তখন চাকরিতে ঢুকলে আর বড় গবেষক হতে পারতাম না।’ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং তাঁকে যখন সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করার আহ্বান জানান, তিনি প্রথমে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তো দলীয় লাইনে কাজ করতে পারব না। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে যে নীতি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর, শুধু সেই নীতিই আমি প্রস্তাব করব।’ তার প্রস্তাবে মনমোহন সিং রাজি হলেন এবং তিনিও পদ গ্রহণ করলেন।

গুরু অমর্ত্য সেনের মতো কৌশিক বসুও মনে করেন, ভারতের আত্মা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ধারক। রবীন্দ্রনাথ যেমন সর্বংসহা, বহুত্ববাদী ভারতের জয়গান করেন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পাঠান, মুঘল—সবাইকে, সব ধর্মের মানুষকে ভারত সাগরের তীরে এসে দাঁড়াতে আহ্বান জানান, তাঁরাও একই ভাবে একদেশদর্শী বিজেপির বিভাজন ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।

কৌশিক বসু বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রশংসা করার পাশাপাশি মৌলবাদের উত্থান নিয়ে গভীর শঙ্কাও প্রকাশ করেন। শঙ্কা প্রকাশ করেন ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান নিয়েও। ভারতের অতীত ঐতিহ্যের কথা বলাই বাহুল্য। এখানে প্রফেসর বসুর বক্তব্য হলো—অতীতের নস্টালজিক মধুর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন না থেকে মেতে উঠতে হবে বর্তমানের নতুন নতুন উদ্ভাবনের অনুসন্ধিৎসায়। তিনি বিজেপিকে পরামর্শ দেন রামায়ণ, মহাভারত ও বৈদিক যুগের ঐতিহ্যের গর্বে মশগুল না থেকে আধুনিক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে সানফ্রান্সিসকোয় অনুষ্ঠিত আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন কনফারেন্সে কৌশিক বসুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা আলাপ হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বলছিলেন, ‘তোমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, আমার বাবা-মা ও আমি নিজে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে ধন্য মনে করি। তার একটি প্রধান কারণ, হয়তো বাংলাদেশ আমার মায়ের দেশ। শরণার্থীদের দিকে তাকালে মনে হতো তাঁরা আমার মামাবাড়ি থেকে এসেছেন।’

২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের আমন্ত্রণে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন প্রফেসর বসু। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। সেই স্মৃতিচারণা করেছিলেন আমার কাছে। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি আমাকে বলেন, ‘তরুণ, বাংলাদেশের প্রতি আমার একটি অন্য রকম ভালোবাসা আছে কারণ, আমার মামাবাড়ি বাংলাদেশের যশোরে। আমি বাংলাদেশের আরও অনেক উন্নতি দেখতে চাই। তোমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আমি আমার পরামর্শ ও মতামত জানিয়েছি। তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার সব কথা শুনেছেন, আর বলেছেন, তিনি চেষ্টা করবেন ওই সব পরামর্শ বাস্তবায়ন করতে।’

আজ ৯ জানুয়ারি এই বাঙালি অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু কৌশিক বসুর জন্মদিন। আমরা তাঁকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই, দীর্ঘায়ু কামনা করি।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com