কূটনীতি

বাংলাদেশের নির্বাচন ও চীন-ভারতের দ্বৈরথ

শেখ হাসিনা, সি চিন পিং, নরেন্দ্র মোদি
শেখ হাসিনা,             সি চিন পিং,        নরেন্দ্র মোদি

সম্প্রতি এক সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্র হয়েছিলেন দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, রাজনীতিক, মন্ত্রী (সদ্য সাবেক ও বর্তমান), সাংসদ, আমলা ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা। এমনকি নির্বাচনের সময় বিএনপির ‘গৃহবন্দী’ প্রার্থীদেরও কেউ কেউ ছিলেন। তাঁদের আলোচনায় অনিবার্যভাবে উঠে আসে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল। এক সাংবাদিক বন্ধু ঠাট্টা করে বললেন, বিজয়ের জন্য আর যঁারাই কৃতিত্ব দাবি করুন না কেন, প্রার্থীদের খুব একটা ভূমিকা ছিল না।

কথায় বলে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আমি তক্কে তক্কে ছিলাম কীভাবে সরকারের ভেতরের খবর বের করা যায়। একজন জ্যেষ্ঠ বাংলাদেশি কূটনীতিককে জিজ্ঞেস করলাম, নির্বাচনে যে অবিশ্বাস্য ফল হলো, কীভাবে তা সামাল দেবেন, বিদেশিদের বিশ্বাস করাবেন? তিনি বললেন, আমাদের সামাল দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এ রকম একটা কিছু হবে তা বিদেশিরা আগেই জানতেন। অন্তত তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে তা-ই মনে হয়েছে।

কীভাবে আন্দাজ করলেন? জবাবে ওই কূটনীতিক জানান, দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীন উভয়ই চেয়েছিল বাংলাদেশের ক্ষমতার স্থিতিশীলতা থাকুক। এ ব্যাপারে ভারতের তৎপরতা অনেক বেশি আলোচনায় এলেও চীনের আগ্রহও কম ছিল না।

এই কূটনীতিক মনে করেন, চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্যের বিষয়ে সরকারের কারও কারও মধ্যে দোদুল্যমানতা থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন সুদৃঢ় অবস্থানে। তিনি একই সঙ্গে দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমান নৈকট্য না হলেও একপক্ষের বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য অন্য পক্ষের বন্ধুত্ব হারাতে চাননি। তাঁর কথায় মনে পড়ল, দুই বছর আগে বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কিনলে দিল্লির দরবারে বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু ঢাকা সেই প্রতিক্রিয়াকে তেমন আমলে নেয়নি। পরে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা চুক্তির প্রস্তাব দিলেও বাংলাদেশে সমঝোতা স্মারক সইয়ের মধ্যে তা সীমিত রাখে।

তাঁর কাছে জানতে চাই, ভারত যে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় রাখতে আগ্রহী, সে কথা সবার জানা। কিন্তু চীনের বাড়তি উৎসাহের কারণ কী? তিনি বললেন, তাদের ভয় ছিল বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল হলে তাদের অর্থায়নে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ বা বাধাগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে প্রথম যে বিদেশি কূটনীতিক গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান, তিনি ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝু। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতের অভিনন্দনের পর ওরাও আর দেরি করতে চায়নি। ক্রিস্টালের নৌকা ও অভিনন্দনবার্তা আগেই তৈরি ছিল। রাষ্ট্রদূত পৌঁছে দিয়েছেন মাত্র।

উল্লেখ্য, সোমবার সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়ায় টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। এরপর ভুটান, নেপাল, রাশিয়া, জাপান, সৌদি আরব ও ইরানের পক্ষ থেকেও অভিনন্দনবার্তা আসতে থাকে।

চীন ও ভারতের ত্বরিত অভিনন্দনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও পিছিয়ে থাকেনি। দুই দেশই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যদিও তাদের বিবৃতিতে নির্বাচন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের কথাও আছে। সাধারণত নতুন সরকার গঠিত হলেই বন্ধুদেশগুলো শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে থাকে। কিন্তু এবার অভিনন্দনের বার্তা আসতে থাকে নির্বাচনের পরদিনই। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য অন্তত ছয় মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের নীতি নিয়েছিল।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর এই অতি-উৎসাহের পেছনে তাদের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ আছে এ কথা ঠিক; একই সঙ্গে আঞ্চলিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়—জানান যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ূন কবীর। চীন ও ভারত সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে, অতীতে তা দেখা যায়নি। বছরখানেক আগে অস্ট্রেলিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইস্ট এশিয়া ফোরাম’ প্রকাশিত নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘চায়না অ্যান্ড ইন্ডিয়াস জিওপলিটিক্যাল টাগ অব ওয়ার ফর বাংলাদেশ’। অর্থাৎ বাংলাদেশ নিয়ে চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ। আর নিউইয়র্কভিত্তিক ওয়ার্ল্ড পলিসি রিভিউ–এ উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের গবেষক মাইকেল কুগেলম্যান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশকে নিয়ে চীন ও ভারতের এ রকম প্রতিযোগিতার কোনো প্রয়োজনই নেই।’

তাঁর কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল এক ভারতীয় বাঙালি সাংবাদিকের কথায়। নির্বাচন উপলক্ষে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে ঘরোয়া আলোচনায় তিনি বলেছেন, ভারত মুখে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথা বললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে বেশি আগ্রহী। অন্যদিকে বাংলাদেশ চায় দুটো উদ্যোগই একসঙ্গে চলুক। বাংলাদেশের নীতি সঠিক বলে মনে করেন এই ভারতীয় সাংবাদিক।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে চীন ও ভারত উভয়ই সহায়তা করছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর আগে ভারত তিন কিস্তিতে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রতিকূলে যে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি আছে, সেটি দূর করতে দিল্লি বা বেইজিং কেউ কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি।

গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে চলেছে। দুই দেশের নেতৃত্বের দাবি, বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর। যদিও তিস্তার পানিবণ্টনসহ বেশ কিছু বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিএনপি আমলে (২০০১-০৬) বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এলেও নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতৃত্ব দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের নানামুখী চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেটি যে সফল হয়নি, তা দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎকারেই স্পষ্ট (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাধায় বিএনপি ভারতের আস্থা লাভে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বিএনপির নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে এখনো আইএসআইয়ের যোগাযোগ আছে। অন্যদিকে বিএনপির সহজাত সুহৃদ বলে পরিচিত চীনের সঙ্গেও দলটির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক জানিয়েছেন, তারা সম্ভবত এখনো তারেক রহমানের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত নয়।

এসব কারণেই ভারত ও চীন নির্বাচনের পর বিজয়ী পক্ষকে অভিনন্দন জানানোর প্রতিযোগিতায় নামে। অন্যদিকে পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপিসহ সব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসাকে শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখছে। তারা নির্বাচনে সহিংসতা ও অনিয়মে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার কথা বলেনি।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতর্ক আছে এবং সেই বিতর্ক আরও বহুদিন চলবে। এটি দেশের ভেতরে সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হলেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বস্তিকর অবস্থানে আছে বলে কূটনৈতিক মহলের ধারণা। সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমিরের মতে, শেখ হাসিনার সরকার গত ১০ বছরে প্রভাবশালী ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সফল সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে ক্ষমতার স্থিতিশীলতা দেখতে চেয়েছে।  

তবে এসব ইতিবাচক ঘটনার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। নির্বাচনের পর জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি জেনেভায় বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর শারীরিক হামলা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, হয়রানি, গুম এবং ফৌজদারি মামলার ঘটনায় তাঁরা উদ্বিগ্ন। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নির্বাচনের অনিয়মগুলো নিরপেক্ষ কমিটি দ্বারা তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিদেশি গণমাধ্যমেও দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রশংসা করলেও তারা মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে যে বাংলাদেশে বিরোধীদের কণ্ঠ ক্রমাগত রুদ্ধ হতে থাকলে মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটতে পারে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com