বাংলাদেশের নিরাশায় ভারতের কী লাভ

গোয়ায় নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক
গোয়ায় নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিমানী হতেই পারেন। কেননা, অভিমান করার সংগত কারণ তাঁর রয়েছে। তবে মান-অভিমান নিয়ে কথা বলার আগে এটুকু বলা যায়, গোয়া সফরের আগে ও পরে এই উপমহাদেশে তাঁর চেয়ে সুখী মানুষ বোধ হয় আর কেউ নেই।
শেখ হাসিনার এই সুখের সঙ্গে আচমকাই যিনি জড়িয়ে গেলেন, গোয়ায় ব্রিকস ও বিমসটেকের আসরে তিনিই সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এশিয়ার আসল ‘বস’ তিনিই। আমি চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কথাই বলছি।
গত ৩০ বছরে সি চিন পিংই প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট, যিনি দ্বিপক্ষীয় সফরে বাংলাদেশে এলেন। এলেন ঠিক সেই সময়ে, যখন ব্রিকস ও বিমসটেকের কর্মকাণ্ডের পরিধি বা আউটরিচ নিয়ে ভারতের কূটনীতিকদের নিশ্বাস ফেলার সময় নেই এবং এই আসরকে ‘পাকিস্তানি সন্ত্রাসকেন্দ্রিক’ করে দুর্বিনীত প্রতিবেশীকে একঘরে করে ফেলতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চেষ্টার কোনো অন্ত রাখছিলেন না। সি চিন পিং বাংলাদেশকে যা দিলেন (২ হাজার কোটি ডলারের ঋণ এবং ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি), তা ভারতের চোখ কপালে তুলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। গোয়ায় এ নিয়ে একটা ঠাট্টাও শুনলাম। বাংলাদেশকে দেওয়া চীনের ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বনাম ভারতের দেওয়া ২০০ কোটি ডলার! ভারতের মোট বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় যেখানে ৩৫ হাজার কোটি ডলার, সেখানে চীনের সঞ্চয়ের ভাঁড়ার এর ১০ গুণেরও বেশি—সাড়ে তিন লাখ কোটি ডলার! সি চিন পিং ঢাকায় গিয়ে এটুকু অন্তত বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের পাশে তাঁরা ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চীনা প্রেসিডেন্টের এই সফর তাই নিতান্তই শ্লাঘার বিষয়।
সি চিন পিং হঠাৎই বাংলাদেশকে এতখানি গুরুত্ব কেন দিচ্ছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রথম কারণ, শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব। দ্বিতীয় কারণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তৃতীয় কারণ, প্রবৃদ্ধির হার ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হওয়া। চতুর্থ কারণ, বাংলাদেশের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ভিত পোক্ত করা, শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে জমানার অবসান ও সিরিসেনা যুগ শুরু হওয়ার পর শ্রীলঙ্কায় যে ভিত চীন হারিয়েছে। পঞ্চম কারণ, চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের উৎসাহ। ষষ্ঠ কারণ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দ্রুত উন্নতি, যা ভারতের প্রতি বাংলাদেশের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়িয়ে তুলছে। সি চিন পিং ঢাকা সফরের মাধ্যমে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে উচ্চতায় ওঠালেন, তা শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যেরও পরিচয়। নিশ্চিতভাবেই এটা তাঁর মুকুটের অন্যতম সেরা ঝলমলে পালক।
ব্রিকস ও বিমসটেকের এই আসর দুটি বহুজাতিক সংগঠনের বহুমুখী বিষয় হলেও ভারত একেবারে শুরু থেকেই এই সম্মেলনকে একচক্ষু হরিণের মতো করে দেখতে চেয়েছে। ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ভারতের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল এই সম্মেলনে পাকিস্তানকে আরও কোণঠাসা করা। সেই প্রচেষ্টা কীভাবে ব্যর্থ হয়েছে এবং চীন ও রাশিয়া কীভাবে প্রকাশ্যে ও প্রচ্ছন্নভাবে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে, এত দিনে তা-ও সবার জানা। রাশিয়ার সঙ্গে যুগ্ম বিবৃতি অথবা গোয়া ঘোষণাপত্রেই রয়েছে সেই প্রমাণ। ভারত চেষ্টা করেও মাসুদ আজহার কিংবা জইশ-ই-মোহাম্মদ অথবা লস্কর-ই-তাইয়্যেবার নাম কিংবা ‘সীমান্তপারের সন্ত্রাস’ বাক্যবন্ধ কোথাও ঢোকাতে পারেনি। অথচ রাশিয়া গোয়া ঘোষণাপত্রে দিব্যি ঢুকিয়ে দিল ‘জাবহাত আল নুসরা’ প্রসঙ্গ, সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে যারা মাটি কামড়ে লড়ছে। সি চিন পিংও আনতে দিলেন না দক্ষিণ চীন সাগরের প্রসঙ্গ। সন্ত্রাসের প্রশ্নে বাংলাদেশ কিন্তু ভারতের সঙ্গ ছাড়েনি। ব্রিকস ও বিমসটেক আউটরিচে দুটি ভাষণে এই দুই সংগঠনের কী কী করণীয়, তার প্রত্যাশা এবং কীভাবে ব্রিকসের মতো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সংগঠন দক্ষিণ এশিয়ার কম উন্নত দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথে সহায়ক হতে পারে, তার একটা স্পষ্ট দিকনির্দেশনা শেখ হাসিনা দিয়েছেন। কিন্তু সম্মেলনের আবহসংগীতে যেহেতু সন্ত্রাসের সুরই ছিল বিরামহীন, হাসিনা তাই তাঁর দুটি ভাষণই শেষ করেছেন সন্ত্রাস–সম্পর্কিত সাবধানবাণীগুলো শুনিয়ে। যদিও কারও নাম তিনি করেননি।
গোয়া ঘোষণাপত্র প্রকাশ ও দুই সংগঠনের সব নেতার ভাষণের পর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। অভিমানের কথা কানাকানি হওয়ার শুরু সেই বৈঠকের পর থেকেই।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটি ছিল শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ভারত সফর। প্রথমটি গত বছর, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী–বিয়োগের পর। এভাবে দুবার আসা-যাওয়া হলেও এখনো তাঁর দ্বিপক্ষীয় ভারত সফর হলো না। মোদির ঢাকা সফরের পর হাসিনাও দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে আসুন, ভারতের দিক থেকে এই চাহিদা রয়েছে। গোয়াতেও দুই নেতার বৈঠকে বিষয়টি ওঠে বলে দুই দেশের কূটনৈতিক মহল সূত্রের খবর। ভারত চাইছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে হাসিনা ভারত সফরে আসুন। হাসিনাও চান ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের সম্মান জানাতে। সফরের এই সম্ভাবনার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেছেন, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে সিদ্ধান্ত কিছু হয়নি।
সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণ একটাই, তিস্তা চুক্তি।
গোয়ায় আসার আগে এক ভারতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেছেন, তিস্তা চুক্তির সঙ্গে তাঁর ভারত সফর শর্তযুক্ত নয়। অর্থাৎ, তিস্তা চুক্তি না হলে তিনি যে ভারতে আসবেন না অথবা তিস্তা চুক্তি হলেই তিনি ভারত সফর করবেন, তেমন কোনো শর্ত রাখা হয়নি। গোয়ায় বাংলাদেশি কূটনীতিকেরাও স্পষ্ট করে সেই কথাই বলেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংগত যে প্রশ্নটা উঠে আসছে, তা ওই তিস্তাকে ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। শর্ত না রাখার কথা বলেও বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের মন্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় প্লেজার ট্রিপে আসবেন না! ভারতকে এত কিছু দেওয়ার পর, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার পর উনি নিশ্চয় খালি হাতে ফেরার জন্য ভারতে আসবেন না। আমাদের কাছে তিস্তা অবশ্যই একটা বড় ইস্যু। এ কারণে তিনি কিছুটা অভিমানী হতেই পারেন।’ ওই কূটনীতিক আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে চুক্তি চূড়ান্ত। যে কারণে চুক্তি সই হয়নি, তা মিটিয়ে চুক্তি রূপায়ণ করার দায়িত্ব ভারতেরই। সেই কাজ এগিয়েছে কি না, আমরা জানি না। তবে আমরা আশাবাদী।’ এই আশাবাদের ভিত্তি কী, সে কথা শহীদুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্রসচিব জবাব দিয়েছিলেন, ‘আশাবাদের কারণ রয়েছে বলেই বলতে পারছি আমরা আশাবাদী।’
বাংলাদেশকে নিরাশায় ডুবিয়ে ভারতের কিন্তু লাভ নেই। পশ্চিম প্রান্তের দুর্বিনীত প্রতিবেশীর তুলনায় পূর্ব প্রান্তের সৌভ্রাতৃত্ব একবুক স্বস্তি। যোগাযোগের যে দরজা ভারতের কাছে বাংলাদেশ খুলে দিয়েছে, সহযোগিতার যে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে পূর্বাঞ্চলে, তা আরও প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তির ভূমিকা অস্বীকার করাটা নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় দেবে। বাংলাদেশের কাছে বিষয়টি রাজনৈতিক দিক থেকে কতখানি স্পর্শকাতর, দিল্লির তা জানা। এ কথাও জানা, এই স্পর্শকাতরতা পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের একটা অংশের ভারতবিরোধিতা যে কর্পূরের মতো উবে যায়নি, জানা আছে তা-ও। এত শত জানা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর দেড় বছর কেটে গেলেও তিস্তা নিয়ে অবস্থানের বিশেষ নড়চড় হয়নি। ভারত সফরে শর্ত না রাখলেও গোয়ায় নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনার সময় এই কারণে শেখ হাসিনার কণ্ঠে কিঞ্চিৎ অভিমান যদি ঝরেও পড়ে, খুব বেশি দোষ কি তাঁকে দেওয়া যাবে?
সি চিন পিং প্রভূত স্বস্তি দিয়েছেন হাসিনাকে। সুখী তিনি নিশ্চিতই। এই সুখ ও স্বস্তি বহুগুণ বেড়ে যাবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁর অভিমান দূর হলে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।