বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দল ফাইনালে গিয়ে বারবার হেরে যায় কেন? দক্ষিণ আফ্রিকার পর বিশ্ব ক্রিকেটে কি নতুন এক চোকারের আবির্ভাব ঘটছে? খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত সামর্থ্যে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপে বাংলাদেশ খুবই ভালো করেছে। সবার হৃদয় জয় করেছে নিপুণতা ও লড়াকু মনোভাব দিয়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বল্প পুঁজি নিয়েই জয়ী হয়েছে। ফাইনালে ভারতের সঙ্গে ২২২ রানের পুঁজিকে রক্ষায় জান লড়িয়ে দিয়েছে। এক কথায়, টুর্নামেন্টজুড়ে অসাধারণ খেলেছে বাংলাদেশ। মাশরাফি বাহিনীকে টুপি খোলা অভিবাদন। কিন্তু কোথায় যেন একটু খামতি থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কি ফাইনালে এসেই বারবার থেমে যাবে? নিদহাস ট্রফির ফাইনালে আমরা একবার আশাহত হয়েছি। এশিয়া কাপেও এর আগে দুবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। বাংলাদেশে দলের সমস্যা কোথায়? চাপের মুখে বারবার ভেঙে পড়ছে কেন? বাংলাদেশ পুরুষ দল চাপের মুখে নিজেদের পারফরমেন্স ধরে রাখতে পারছে না। এ কারণেই হয়তো অসাধারণ উদ্বোধনী জুটির পরও মিডল অর্ডার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে। উদ্বোধনী জুটির ব্যাটিং দেখে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, বাংলাদেশ নিদেনপক্ষে ২৭০ থেকে ২৮০ রানের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে ভারতকে। কিন্তু বারবার তীরে এসে তরি ডুবে যাচ্ছে।
হাত ছোঁয়া দূরত্বে থেকে যাচ্ছে ট্রফি। কারণ হচ্ছে ঘরোয়া ক্রিকেটের নিম্নমান। এর আগেও এক লেখায় বলেছিলাম, বাংলাদেশে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লেশমাত্র নেই। একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন পিকনিক মার্কা ক্রিকেট খেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রবেশ করেন খেলোয়াড়েরা। ‘সেখানে পরিস্থিতি অনুসারে খেলতে পারে না। বর্তমান জাতীয় দলের সিনিয়র চার-পাঁচজন খেলোয়াড়ের ওপর দল নির্ভরশীল। এই সিনিয়র খেলোয়াড়েরা অবসরে চলে গেলে অবস্থা কী দাঁড়াবে? এক তামিম ইকবাল খেলতে না পারায় মনে হচ্ছে, গোটা দলই ভারসাম্য হারিয়েছে। সেখানে নতুন খেলোয়াড় কোথায়? বর্তমানের সিনিয়রদের জায়গা কারা পূরণ করবে? তেমন প্রতিভাবান খেলোয়াড় কি আছে? উত্তর যদি হয় “না”, তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? নতুন খেলোয়াড় তৈরির বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) উদ্যোগ কি ফলপ্রসূ?’
পক্ষান্তরে যদি ভারতের ইনিংসটা বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে ভারতের শেষের দিকের ব্যাটসম্যানরা মাথা খুবই ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। বাংলাদেশের বোলাররা কিন্তু ২২২ রানের পুঁজি নিয়েই ভারতের টুঁটি চেপে ধরেছিলেন। সেখান থেকে ঠান্ডা মাথায় ভারত ম্যাচটাকে বের করে নিয়েছে। ভারত বেশ চাপের মধ্যে থাকার পরও তাদের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কোনো তাড়া লক্ষ করা যায়নি। বিশেষ করে ভুবনেশ্বর কুমার আর রবীন্দ্র জাদেজা পরিস্থিতি অনুসারে খেলেছেন। বাতাসে খুব একটা শট খেলেননি। মুশফিক বা মাহমুদউল্লাহ ইয়াহু টাইপের শট খেলতে গিয়ে যেভাবে আউট হয়েছেন, সেই ধরনের কোনো প্রবণতা তাঁদের মধ্যে দেখাই যায়নি। বরং শেষ ওভারে মাহমুদউল্লাহকে দিয়ে মাশরাফি যে ফাঁদ পেতেছিলেন, সেই ফাঁদে ভারতের শেষ দুই ব্যাটসম্যানও পা দেননি। শেষ ওভারে বড় কোনো শট না খেলে ঠান্ডা মাথায় এক–দুই করে নিয়ে ম্যাচ শেষ করেছেন। মাশরাফি আশা করেছিলেন, মাহমুদউল্লাহর স্পিনের বিপরীতে বড় শট খেলতে গিয়ে মিস টাইমিং করে ক্যাচ তুলে দেবেন ভারতীয়রা। কিন্তু মাশরাফির পরিকল্পনা সফল হয়নি।
ভারতীয় খেলোয়াড়দের এ ধরনের চাপের মুখে খেলার অভ্যাস ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই তৈরি হয়। ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্রিকেট বিশেষ করে রঞ্জি ট্রফি বা দেওধার ট্রফি খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। সেখানে প্রতিটি খেলোয়াড় শতভাগ নিংড়ে দিয়েই তবে জাতীয় দলে সুযোগ পান। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি জাতীয় দল নির্বাচন করে দেন না বা তিনি কোনো দলের সঙ্গে জড়িত, এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না বা পাওয়া গেলেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বাস্তবিক অর্থেই অনেক স্বাধীন ও স্বচ্ছ। সেখানকার দল নির্বাচনের প্রক্রিয়াও অনেক প্রভাবমুক্ত। এরপরও যে ভারতীয় ক্রিকেটে একেবারেই দুর্নীতি হয় না তা নয়। ললিত মোদির ঘটনা তো আমরা জানি। আইপিএল নিয়ে নানা কথা বাতাসে ওড়ে। কিন্তু রঞ্জি ট্রফি, বিজয় হাজারে ট্রফি বা মুশতাক আলী ট্রফির আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ খুব একটা নেই। ভারতের জাতীয় দল নির্বাচনে দিল্লি বা মুম্বাইয়ের একটা প্রভাব থাকে। কিন্তু ওদের আম্পায়ারিং নিরপেক্ষ হয়। এ কারণেই ভারত ক্রিকেটকে একটি নির্দিষ্ট মানে নিয়ে যেতে পেরেছে।
মানদণ্ডের এই বিশাল পার্থক্যের কারণেই ভারত শুক্রবারের ম্যাচটিতে শেষ পর্যন্ত জিতে যায়। জরাজীর্ণ কাঠামোয় খেলে দেশকে যে এই পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছে, তার জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ধন্যবাদ দিতে হবে। বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগগুলোর মান খুব নিচু দরের ও দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রিমিয়ার লিগের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বর্তমান বিসিবি নিজ হাতে হত্যা করেছে বিভিন্ন আইনকানুনের শৃঙ্খলে জড়িয়ে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের এখন আর কোনো আকর্ষণ নেই। খেলা কোথায় হয়, কবে হয়, তার খোঁজখবরও কেউ রাখে বলে মনে হয় না। ৮০ বা ৯০ দশকের আবাহনী-মোহামেডানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজমাখা কোনো ম্যাচের সংবাদ আমাদের কাছে আসে না। ক্লাবের স্বার্থরক্ষার চক্র থেকে বিসিবির বর্তমান কর্তৃপক্ষ যত দিন না বের হবে, তত দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেটও আর ফিরে আসবে না। এসব টুর্নামেন্টে আম্পায়ারদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, খেলোয়াড়দের দল নির্বাচনে স্বাধীনতা না থাকা, কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি প্রিমিয়ার লিগকে এখন জনপ্রিয়তার তলানিতে নিয়ে গিয়েছ।
প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে জঘন্য বিষয় হচ্ছে পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১০ থেকে ১২ জন আম্পায়ারের নামের তালিকা পাওয়া যায়, যাঁরা বিসিবির হর্তাকর্তাদের ক্লাবের খেলা পরিচালনার দায়িত্ব পান নিয়মিতই। গত দুই বছর আগে আবাহনী ও প্রাইম দোলেশ্বরের খেলায় রানআউট নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। প্রাইম দোলেশ্বরের ফরহাদ রেজা আবাহনীর এক খেলোয়াড়কে রানআউট করেছিলেন। পরিষ্কার রানআউট থাকলেও আম্পায়ার আউট দেননি। দোলেশ্বর এর প্রতিবাদে মাঠ থেকে বের হয়ে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে, ওই ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন নাদির শাহ। মাঠ থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকেরা নাদির শাহকে অন্য আম্পায়ার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সরাসরিই বলেছিলেন, চেনেন না। কী বিস্ময়কর! খেলা পরিচালনাকারী এক আম্পায়ার তাঁর সহকর্মীকে চেনেন না! এ–ই যদি হয় ঘরোয়া ক্রিকেটের আম্পায়ারিংয়ের অবস্থা, তবে সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে কেন? প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবার নিরপেক্ষ আম্পায়ারিং এবং নিষ্ঠাবান কর্তৃপক্ষের উপস্থিতি খেলোয়াড়দের মনের জোর যেমন বাড়ায়, তেমনি যোগ্যতা বিকাশে সমান সুযোগের সৃষ্টি হয়। এই মানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরা আন্তর্জাতিক ম্যাচের চাপ কীভাবে সামলাবে? তাঁরা তো চাপের মুখে খেলেই অভ্যস্ত নন।
শুধু উঁচু দরের কোচিং স্টাফ থাকলেই হয় না। সারা দিন প্র্যাকটিস করলেই চলে না। কোচিং স্টাফ ও অনুশীলন থেকে অর্জিত দক্ষতা প্রয়োগের সুযোগ দরকার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেই দক্ষতা প্রয়োগের আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে এর প্রয়োগ করে নিজেদের ঝালাই করে নিতে হয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জমজমাট ঘরোয়া লিগ থাকতে হয়। ভারতীয়রা প্রয়োগের সেই সুযোগ পায় বলেই এখন প্রতিষ্ঠিত বিশ্বশক্তি। অনেকেই বলতে পারেন, ভারতের কথা বলছি কেন? ভারতের ক্রিকেট কাঠামো একটি মডেল হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভারত আমাদের ঘরের কাছে উদাহরণ। এখান থেকেই আমরা শিখতে পারি।
আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে যদি একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ক্রিকেট কাঠামো দাঁড় করানো যায়, তবে অচিরেই বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তিতে পরিণত হবে। মেধার অভাব নেই। অভাবে আছে সেই মেধার সুষ্ঠু ব্যবহারের।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।