শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি খুব কমে যায়
শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি খুব কমে যায়

বাংলাদেশ–ভারতের অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনে ন্যায্যতা চাই

১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে ছয়টি অভিন্ন অপ্রধান নদীর (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতি, ধরলা ও দুধকুমার) পানিবণ্টন বিষয়ে উভয় নেতাই দ্রুত দর-কষাকষি শেষ করার তাগাদা দেন।

হতাশার বিষয় হচ্ছে, এই যাত্রাতেও ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির মুখে ভেস্তে যাওয়া তিস্তা পানি চুক্তিটি আলোর মুখ দেখছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ২০১৫ সালের বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার জলবণ্টনকে ‘সিনসিয়ার কমিটমেন্ট’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তিটি বাস্তবায়নের মুখ না দেখায় সমালোচকদের অনেকেই সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিযুক্ত করেন। আবার অনেকে মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর দায় চাপিয়ে আসলে নরেন্দ্র মোদি সরকার বাংলাদেশকে ঠকাতে চায়। অন্যদিকে আরেক শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশ সরকারকেই দায়ী করেন ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতির’ অভিযোগ তুলে। সত্য ও বাস্তবতা যা-ই হোক, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে থেকে যাচ্ছে। এর দ্রুত নিষ্পত্তি উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হবে।  

বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী খুব আশাবাদী কথা বলেছেন, ‘আমাদের জলের ভাগাভাগি করতে হবে। আমরা বন্ধু। আমরা প্রতিবেশী।...আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ভাগাভাগি করতে কোনো বাধা দেখছি না। আমি মনে করি, আমরা খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে পারব। মূল বিষয় হলো জলপ্রবাহের তথ্যশালা নিয়ে আসা।’ (ডেইলি স্টার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০)।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলার কল্যাণকে অক্ষুণ্ন রেখে বাংলাদেশকে সাহায্য করা হবে।’ দুটি বক্তব্যের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখা যায়। আসলে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানি নিছক ‘সাহায্যের’ বিষয় নয়।

বরং এটা ভাটির দেশের মানুষের বিশ্বস্বীকৃত আন্তর্জাতিক অধিকার। শুধুই ভাটি অঞ্চলের মানুষের নয়, বরং ‘বেঁচে’ থাকার জন্য নদীর নিজেরও রয়েছে প্রবাহ প্রাপ্তির অধিকার। নদী অববাহিকার উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ, বনাঞ্চল সব টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ন্যূনতম পানি প্রবাহ ধরে রাখা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা (সূত্র, জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭, ধারা ৫, ৭, ১)।

কেননা, প্রাণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিশ্বের সাধারণ সম্পদ, এর সুরক্ষার দায়িত্ব সবার। আজকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় শতভাগ প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে, বালি চুঁইয়ে আসে মাত্র কয়েক কিউসেক পানি। একে আর যা-ই হোক, আধুনিক সভ্যতা বলা চলে না।

ফারাক্কা বাঁধ, গজলডোবার সব গেট একসঙ্গে না খোলার বিষয়টিও সুরাহা হওয়া দরকার। শুষ্ক মৌসুমের পানি বণ্টনই ভাটির দেশের মানুষ ও প্রকৃতির একক চাহিদা নয়। বানে ভাসানোর ক্ষতির অবসানও দরকার।

আধুনিক কারিগরি পদ্ধতি ব্যবহার করে পুরো অববাহিকায় সম্ভাব্য বৃষ্টির আন্তর্দেশীয় পরিমাপ নিয়ে নিয়ে সহনীয় ওয়াটার রিলিজ ও ড্রেজিং পরিকল্পনা করা যায়, সে জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা। হিমালয়ান বেসিনে বর্ষার বিপুল জলরাশি বঙ্গোপসাগরে উন্মুক্ত করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট পরিবেশ ও চাষাবাদবান্ধব মডেল তৈরি করা না গেলে ভাটি অঞ্চলে ধান, সবজিসহ সমুদয় খাদ্য বাজারের অস্থিরতা কখনোই কাটবে না।

সুন্দরবনে, উপকূলে ও স্থলে লোনা পানির আগ্রাসন থামবে না। দেখা যাচ্ছে, বর্ষা মৌসুমে ঢলের পানিতে পাকা ধান ও সবজির একাংশ নষ্ট হয়, আবার পরের ফলন মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে ফলন বিলম্বিত হয়। নদীগর্ভ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীভাঙন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র হয়ে উঠেছে।

ভারতের মনুষ্যবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যজাত দূষণ বহন করে আনার ব্যাপার তো আছেই। অস্বাভাবিক নদীভাঙনে তীরবর্তী উর্বর পলিপতিত জমি কমছে। উদ্ভিদ–বৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, স্বাদুপানির মৎস্য প্রজাতি বিলীন হচ্ছে। এভাবে ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেই বাঁধগুলোর ভাটি অঞ্চলে কৃষি, প্রাণ, প্রকৃতি ও মানুষের জীবন একটা অনন্ত ক্ষতির চক্রে আবর্তিত হচ্ছে। শুধু ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংগৃহীত বন্যার প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির বিবরণে ৫ হাজার ৯৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৬ টাকার হিসাব দেওয়া হয়েছে। (সূত্র: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, আন্তমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থাপিত বন্যা ক্ষয়ক্ষতির চিত্র, ২৫ আগস্ট ২০২০)

শক্তিমান প্রতিবেশীর অসহযোগিতায় আন্তর্জাতিক নদীতে পানি আসবে না, ভেবে বিকল্প কৌশলগত অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নিলে নিশ্চিতভাবেই ভারতের বন্যাজনিত ক্ষতি বাড়বে। ইতিমধ্যে ফারাক্কার কারণে আসামের বন্যাজনিত আর্থিক ক্ষতির চিত্র বেশ নাজুক।

এখন বাংলাদেশ চাইলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নালিশ করতে পারে। কিন্তু তাতে পারস্পরিক সম্মান ও সম্পর্কের উষ্ণতা বজায় থাকবে না। ‘কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’ ফোরামে নালিশ করে বলতে পারে, একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের ফলে ক্রমাগত লবণাক্ততা বেড়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে, স্বাদু পানির মাছের আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে পানি না ছেড়ে হঠাৎ ফারাক্কা, গজলডোবার পানি ছেড়ে দিলে ভাটিতে বন্যা হয়, বনাঞ্চল, বন্য প্রাণীর আবাস, প্রাণ ও পরিবেশের ক্ষতি হয়।

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশন, রামসার কনভেনশন, ইন্টারন্যাশনাল ওয়েট ল্যান্ড কনভেনশনেও নালিশের সুযোগ আছে। বায়োডাইভারসিটি কনভেনশনে বলা সম্ভব যে ভারতের আন্ত নদীসংযোগ ও একতরফা পানি প্রত্যাহারে বাংলাদেশের ওয়াটারকোর্সে প্রাণবৈচিত্র্যের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনভেনশনে গিয়ে প্রমাণসহ দেখানো যায়, বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্ব ঐতিহ্যগুলো হুমকিতে পড়েছে। রামসার কনভেনশনে বাংলাদেশ বলতে পারে, ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জাতিসংঘ পানি প্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭-এর ধারা ৫, ৭,১ ও ৭,২ ধারায় অববাহিকার ওপর নির্ভরশীল দেশ, মানুষ ও প্রকৃতির ক্ষতি না করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে।

কিন্তু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধে তাড়িত হয়ে পানি ভাগাভাগির মীমাংসা নিজেরাই না করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গিয়ে রেষারেষি করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দীর্ঘ তিক্ততা তৈরি করা তো দুই পরস্পর নির্ভরশীল প্রতিবেশীর কাম্য হতে পারে না। বরং তিস্তা চুক্তি, ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি আগামী ২০২৬ সালে নবায়নসহ সব অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ ও পানি নিষ্কাশনে ন্যায্যতাভিত্তিক সুরাহা হোক। জলবণ্টনের পাশাপাশি টেকসই জল নিষ্কাশন, নদীরক্ষা ও নদীদূষণ প্রতিরোধের বন্দোবস্ত হোক।

অনেকেই বলছেন, এক দশক থেকে প্রতিশ্রুত তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় হতাশ হয়ে বাংলাদেশ তিস্তা নদী সুরক্ষা, জলাধার তৈরি, অবকাঠামো উন্নয়নের চমকপ্রদ এক বিকল্প কৌশলে এগোচ্ছে (তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট)। শক্তিমান প্রতিবেশীর অসহযোগিতায় আন্তর্জাতিক নদীতে পানি আসবে না, ভেবে বিকল্প কৌশলগত অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নিলে নিশ্চিতভাবেই ভারতের বন্যাজনিত ক্ষতি বাড়বে। ইতিমধ্যে ফারাক্কার কারণে আসামের বন্যাজনিত আর্থিক ক্ষতির চিত্র বেশ নাজুক।

অন্যদিকে ভারতের পানি প্রত্যাহার আসলে চীনের পানি প্রত্যাহারের কৌশলকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিত্তি দেয় (যেমন ইয়ারলুং জাংবো নদীতে চীনের বৃহৎ বাঁধ তৈরি)। বরং ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ন্যায্যতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁকে নৈতিক ভিত্তি দেবে। যে কাজ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে করছে, সেই একই কাজ চীন ভারতের সঙ্গে করার উদ্যোগ নিচ্ছে।

তাই তিস্তাকে হত্যা করার কূটনৈতিক বিজয় উদযাপন নয়, কৌশলের বিপরীতে পাল্টা কৌশল নয়, বরং এমন সৎ বন্দোবস্ত দরকার যেখানে উভয় দেশ অভিন্ন আন্তর্জাতিক ৫৪টি নদীকে বাঁচিয়ে, ভাটির মানুষের সেচ ও স্বাদুপানির অধিকার রক্ষা করে পানি ভাগাভাগিতে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, রক্ষা পাবে দক্ষিণ এশিয়ার অভিন্ন প্রাণ ও প্রকৃতিও।
এক দশক ধরে যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক হচ্ছে না, এটা ভালো বিষয় নয়। অন্তত জলবায়ু ঝুঁকি বিবেচনায় সম্ভাব্য আবহাওয়া ও জলবায়ু ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনা বেসিনের মোট বৃষ্টিপাতের পরিবর্তিত ধারা বা ট্রেন্ড নির্ণয়, নদীগুলোর পরিবর্তিত জলধারণ ও নিষ্কাশন ক্ষমতা নির্ণয়, দূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নদীগুলোর গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন প্রবাহসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের জন্য হলেও জেআরসির বৈঠকগুলো নিয়মিত করা দরকার।

সর্বশেষ ২০১০ সালের মার্চে দিল্লিতে জেআরসির ৩৭তম বৈঠক হয়েছিল, যেখানে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল দুই দেশ। কিন্তু চুক্তিটি আজও স্বাক্ষরিত হয়নি বলে বাংলাদেশের মানুষের হতাশা আছে। এ অবস্থায় কারিগরি কমিটির সভাসহ জেআরসি বৈঠকের ব্যাপারে ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীর আশাবাদ যাতে সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ হয়, সে লক্ষ্যে উভয় দেশের কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। জলবণ্টন ও জল নিষ্কাশনই শুধু নয়, ভারত ও বাংলাদেশের সামনে রয়েছে আরেকটি অভিন্ন অভীষ্ট ও একাধিক অভিন্ন আন্তর্জাতিক লক্ষ্য। সেটা হচ্ছে ‘সবার জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনে’ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ৬ নম্বর বৈশ্বিক লক্ষ্য। এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে দুই প্রতিবেশী পরস্পর পরস্পরের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হোক। জলবণ্টনের ন্যায্যতা বন্ধুত্বকে সৌন্দর্যময় করুক।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ গ্রন্থের লেখক

faiz.taiyeb@gmail.com