বহ্নিশিখা

লিখতে মন চায় না। পাঠকেরা ঘুমাতে গেছেন। আগের মতো ই-মেইলে মতামত দেন না, ফোন করে বলেন না, আপনার লেখাটি আজ আমার দিন বদলে দিয়েছে। এত কাগজ বাংলাদেশে প্রতিদিন বের হচ্ছে যে লেখকের সংখ্যাও সে অনুপাতে অনেক বেড়ে গেছে। যে কাগজে লিখি, সেখানেও ট্রাফিক জ্যাম। আজ যা লিখছি ছাপতে ছাপতে হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের সময় এসে যাবে। তখন লেখাটির আর কী মূল্য?
ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে যাই। ওদের কী শুনতে ভালো লাগবে, তাই আগে মনে মনে চিন্তা করি। ওরা শুনতে চায় এমন কিছু, পড়াশোনার সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই। আমিও ওদের চালটি বুঝতে পেরেছি বলে এমনভাবে পড়ানো শুরু করি যেন গল্প করছি। পরে দেখা গেল ওইটি ছিল আজকের পড়া। নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার কীভাবে দেখা হলো, কবে, কোথায়, তাঁদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল। এগুলো গল্পের মতো করে যখন ছাত্রছাত্রীদের সামনে উন্মোচিত হলো, তখন তারা আরও জানতে চাইল কী হলো এই প্রেমের পরিণতি। তখন নজরুল কী কী লিখেছিলেন? প্রমীলার কী উত্তর ছিল? তাঁর নামটি ‘দুলি’ হলো কেন? কে দিল এ নাম? দুজনে দোলনায় দুলেছিলেন বলে ‘দুলি’। কেমন করে ব্রিটিশরা খবর পেল নজরুলের সেই সব কবিতার, যার ফলে তাঁকে অচিরেই নেওয়া হলো জেলে?
ঘটনাগুলো পড়াশোনার হলে এক রকম আর গল্প হলে আরেক রকম। ওদের বাধ্য করলাম না, কিন্তু বলতে ছাড়লাম না যে নজরুলকে নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখেছি, নাম পুড়িব একাকী। একটি মেয়ে এসে প্রশ্ন করল, উনি কেন বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে গেলেন, আপনার উপন্যাসে এর জবাব দেওয়া হয়নি। আজ এর জবাব চাই। বললাম, এর উত্তর আমার পিতার জানা ছিল। উনি কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন। তাই বলিনি। বইতেও বলিনি। আজও নয়। বুদ্ধিমান পাঠক যাঁরা, অল্পতেই বুঝে নেবেন।
বাড়ি ফিরে মেয়ের কাছে ছাত্রছাত্রীদের গল্প করি। আমার আর নতুন গল্প কী আছে? ওদের ঘিরেই আমার পৃথিবী। ওদের খুশি, ওদের আনন্দ আমার জীবনকে দিয়েছে নতুন মহিমা। ঢাকা থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে নজরুলের যে স্কুলটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেই দরিরামপুরে প্রথম প্রোগ্রাম করেছিলাম বিশ বছর আগে: ‘ভরা নদীর বাঁকে’। যারা গান গেয়েছিল, তারা এখন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। যেমন বেবী নাজনীন, সালমা, শারমিনী আব্বাসী, আবু বকর সিদ্দিকী প্রমুখ। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গেলাম সেখানে দুটি এয়ারকন্ডিশন্ড বাসে করে সারা দিনের জন্য। যে ঘরে নজরুল পড়তেন, সেই ঘরটিতে বসে তারা অনেকক্ষণ নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করল। মনে করার চেষ্টা করল প্রায় বহু বছর আগের নজরুলকে, যার নাম ছিল দুখু মিয়া।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলো ত্রিশালের একটি নতুন রেস্টুরেন্টে, যার রান্না পাঁচতারা হোটেলকে হার মানাবে। ছাত্রছাত্রীরা বলল, এত সুন্দর রান্না কোনো দিন খায়নি তারা। একটি মেয়ের খোঁজ করছিলাম, যে আমার কাছে এসে প্রায়ই বই ধার নিত। ওকে না দেখে আমি কিছুটা বিষণ্ন। কয়েক দিন পর অন্যদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওই দিন তো ওর গায়েহলুদ। আরও বিষণ্ন হলাম। কারণ, ওর গায়েহলুদে সহজেই গাইতে পারতাম: ‘গাও তোল, গাও তোল কন্যা হে, কন্যা পেন্দ বিয়ার শাড়ি, এই শাড়ি পিন্দিয়া যাইবেন তোমার শ্বশুরবাড়ি’।
অথচ জানতেই পারলাম না, আজ ‘বহ্নিশিখা’র গায়েহলুদ। মিষ্টি মেয়েটিকে খবর দিলাম। ও হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা দিতে পারেনি। একই কারণে। বললাম, তোমার জন্য আলাদা পরীক্ষা নিচ্ছি। তুমি অবশ্যই আসবে। পরীক্ষা দিল। অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম। ও সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ‘বহ্নিশিখা’ নামটি কে দিয়েছে? বলল, আমার বাবা, নজরুলকে যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আমার চোখের কোণে পানি।
এমনি অনেক গল্প আছে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে। তাদের কথা কেউ শুনতে চাইবে কি? একজন এসে বলল, আমার মায়ের কাছে আপনার গল্প শুনেছি। ‘ভরা নদীর বাঁকে’ অনুষ্ঠানে আপনি দীর্ঘদিন সংগীতের গল্প শুনিয়েছেন। তাই আমি আপনার ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। আপনি কথা বলতে বলতে গান করেন, গান করতে করতে আবৃত্তি করেন, এমন ক্লাস আমি জীবনে ভাবিনি। বললাম, তুমি গান জানো? বলল, না। কবিতা বলতে পারবে রবীন্দ্রনাথের? দুই লাইন হলেও চলবে। ভেবে পেল না। অবশেষে বলল: ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’। ক্লাসসুদ্ধ সবাই হেসে উঠল।
ওদের বলেছি, নজরুলকে সঙ্গে রাখবে সারা জীবন। আব্বাসউদ্দীনের গান শুনবে। বাড়িতে ছোট্ট লাইব্রেরি করবে, যেখানে বাস করবেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আব্বাসউদ্দীন, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ। ওই ছেলেমেয়েদের মধ্যে কারোরই অভ্যাস ছিল না রোজ সংবাদপত্র পাঠের। ওদের পাঠিয়েছি আইইউবি লাইব্রেরিতে প্রতিদিনের সংবাদপত্র পাঠ করতে। ওখানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পত্রিকাগুলো রাখা হয় শুধু তোমাদের জন্য। তোমরা ভুলে যেয়ো না জিমনেসিয়ামে ও লাইব্রেরিতে যাওয়া তোমাদের প্রতিদিনের
কাজ। ছাত্রদের মনে রাখতে হয় যে এটাই তাদের তপস্যা। আমার ক্লাস দেড় ঘণ্টা, কিন্তু ওরা আমাকে ছুটি দিতে চায় না, আরও শুনতে চায়, আরও শুনতে চায়।
‘বহ্নিশিখা’র কথা বলে শেষ করি। ওর সাদাসিধে কাপড়চোপড়, কপালে নেই সিঁদুরের ছিটেফোঁটা। জিজ্ঞেস করাতে বলল, আমি মুসলমানের মেয়ে। তাই তো। ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’য় নজরুল কোন ঘরের মেয়ে তা বলেননি। তিনি সবাইকে জাগাতে চেয়েছিলেন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net