বলিভিয়ার নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করল মার্কিন সমর্থিত সেনা–গণ অভ্যুত্থান। আজকের দুনিয়ায় সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তেক্ষেপের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। এখন সেনা–গণ অভ্যুত্থান হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা স্বার্থের বাইরে গেলেই অভ্যুত্থানের খড়্গ নেমে আসবে শাসকদের ওপর। সাধারণত সামরিক বাহিনী নিজেই অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করত। অথবা জনসাধারণের গণ–অভ্যুত্থান হতো। এখনকার নয়া কৌশল হচ্ছে গণ-সামরিক অভ্যুত্থান। এ প্রক্রিয়ার শুরুতেই কিছু মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয় দুর্নীতি ও অপশাসনের অভিযোগ এনে। এরপর সামরিক বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে। দূর থেকে পুরো ঘটনাই গণতান্ত্রিক আন্দোলন মনে হলেও এর অন্তরালে থাকে আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক রাজনীতির স্বার্থ। অর্থনৈতিক, ভূরাজনীতি, নিরাপত্তা ও আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থ সেনা–গণ অভ্যুত্থানে অভ্যুত্থানে ক্রিয়াশীল থাকে। সরাসরি সামরিক শাসন কায়েম করা হয় না, আবার সামরিক সামরিক একটা ভাব থাকে। এতে সব কুলই রক্ষা হয়। জিম্বাবুয়ে, সুদানে সম্প্রতি এ ধরনের অভ্যুত্থান দেখেছি।
নতুন ধরনের এই গণ সামরিক অভ্যুত্থানের সর্বশেষ শিকার বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। লাতিন আমেরিকার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট তিনি। সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর চাপের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে বলে মোরালেসের বিরুদ্ধে সপ্তাহ দুয়েক আগে আন্দোলন শুরু হয়। উগ্র ডানপন্থীরা বিভিন্ন স্থানে মোরালেসের সমর্থক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করে। বলিভিয়াজুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। প্রয়োজনে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েও উগ্র ডানপন্থীদের নিরস্ত করতে পারেননি প্রেসিডেন্ট মোরালেস। বলিভিয়ার এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য যতটা না গণতান্ত্রিক শাসন কায়েম করা, না তার চেয়ে বরং চরম ডানপন্থী একজনকে ক্ষমতায় বসানোই উদ্দেশ্য মনে হয়। ইতিমধ্যেই চিলি, কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর ও ব্রাজিলে জাতীয়তাবাদী কট্টরপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছেন। মাঝে দু–একটি দেশ গলার কাঁটার মতো আটকে ছিল। এগুলো যত দ্রুত দূর করা যায় ততই আমেরিকা ও দেশীয় অভিজাতদের মঙ্গল।
বলিভিয়ার নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি অনিয়ম বা দুর্নীতির তথ্য বিশ্ব গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি। কিন্তু মার্কিননিয়ন্ত্রিত সংগঠন অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করলে মোরালেসবিরোধীরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। সন্দেহ করা হচ্ছে আড়াল থেকে এই আন্দোলনের কলকাঠি নেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রেডিও এডুকেশন নেটওয়ার্ক অব বলিভিয়া ১৬টি অডিও টেপ প্রকাশ করেছে। এতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত ভৌগোলিক রাজনীতির কারণে দক্ষিণ আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এর সঙ্গে ইসরায়েলসহ ইউরোপের দেশগুলো তাল মিলিয়েছে।
বলিভিয়ার প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচিত হন মোরালেস। গেল অক্টোবরের ২০ তারিখ মোরালেস চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হন প্রতিদ্বন্দ্বী কার্লোস মেসা ও চি হিউং চুংকে হারিয়ে। বলিভিয়ার ইতিহাসে মোরালেসই প্রথম টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। তবে মোরালেসের টানা ক্ষমতায় থাকাকে তাঁর সমর্থকসহ অনেকেই সহজভাবে নেননি, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট পদে একাধিকবার নির্বাচিত হওয়া বিষয়ক গণভোটে মোরালেস হারার পরও আদালতের সহায়তায় চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। এতে অনেকেই মোরালেসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির কারণে অচিরেই মোরালেস যুক্তরাষ্ট্রের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন।
মোরালেস বিভিন্ন সময় ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে মার্কিন পদক্ষেপ, কিউবার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, মার্কিন সমর্থিত হন্ডুরাসের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। ফকল্যান্ড দ্বীপের ওপর আর্জেন্টিনার মালিকানার বিষয়েও তিনি সোচ্চার ছিলেন। তিনি হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপে যোগ দিয়েছিলেন। এই জোটে যুক্তরাষ্ট্রকে রাখা হয়নি। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক সমন্বয় সাধনের জন্য এ জোটের ওপর মোরালেস গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এডওয়ার্ড স্নোডেনের মুক্তির পক্ষে কথা বলেছেন। বলিভিয়ার খনিজ সম্পদ রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধে সবাইকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আসা বাম ধারার এই রাজনীতিবিদ। তিনি বলিভিয়ায় সাদাদের আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আদিবাসীদের জন্য ভূমি নীতি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
বিভিন্ন সংস্কার নীতি গ্রহণ করে মোরালেস বলিভিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে সমর্থ হন। তাঁর শাসনামলে প্রবৃদ্ধির হার ৪ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ছিল। ২০১৮ সালে ছিল তা ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। দক্ষিণ আমেরিকায় যা সব থেকে বেশি। দেশজ উৎপাদন তিন গুণ বেড়েছিল। বাণিজ্যিক স্বার্থের সঙ্গে তিনি জনপ্রিয় নীতির মিশ্রণ ঘটান। মোরালেসকে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম সফল গণতান্ত্রিক শাসক বলা হয়। সম্পদের পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে বৈষম্য কমিয়ে আনতেও সফল হয়েছিলেন মোরালেস। জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা এতে বৃদ্ধি পায়। দ্রব্যমূল্যও নাগালের মধ্যেই ছিল। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালে ৩৮ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছিল। মোরালেস অর্থনৈতিক সংস্কারে বিশেষ করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করায় সফল হয়েছিলেন। ইভো মোরালেসের এই অর্থনৈতিক নীতিকে ‘ইভোনোমিক্স’ বলা হয়ে থাকে।
ইভোনোমিক্স বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান তিনি। তাঁকে সমাজতান্ত্রিক সরকারের প্রধান বলা যায় না। ইভোনোমিক্স টেকসই কোনো সমাধান দিতে পারেনি। কারণ ইভোনমিক্সের মাধ্যমে মোরালেস নয়া উদারবাদ গ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রের অতিরিক্তি ব্যয়ের কারণে ২০১৮ সালে বাজটে ঘাটতি জিডিপির ৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। দ্রব্যমূল্যের ও উৎপাদন ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারেনি ইভোনমিক্স। অনেক নেতার দুর্নীতি তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের তরুণ সমাজের কাছে তিনি একজন কঠোর শাসক হিসেবে পরিচিত। এভাবে নিজের সাফল্যের শিকার হয়েছেন মোরালেস।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বলিভিয়াতেও নয়া উদারতাবাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে। মোরালেসের সংস্কার কর্মসূচি মানুষের মধ্যে অতিরিক্তি চাহিদা তৈরি করেছিল। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে যায়। এ সুযোগেই মার্কিনঘেঁষা ডানপন্থীদের উত্থান ঘটে। সমাজে বিভাজন আবার মাথা চাড়া দেয়। লাপাজের পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ডানপন্থীরা একটি গ্রাফিতি তৈরি করেছে। সেখানে লেখা আছে আদিবাসীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাও। ডানপন্থীরা আদিবাসীদের সেখানকার স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে তৈরি হওয়া অভিজাত ও মধ্য শ্রেণিরা ঘৃণা করে। ইভো মোরালেস সেই ভূমিপুত্রদেরই সন্তান এবং তিনি জনগণের অধিকাংশের পক্ষ নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের শত্রু হয়েছিলেন। আদিবাসীদের কারণে রাষ্ট্রীয় সুবিধা কমে যাচ্ছে, এমনটাই মনে করে উগ্র ডানপন্থীরা। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখে অনেক সময় ধরা পড়ে না যে রাজনৈতিক ও অর্থনীতির কাঠামোগত ত্রুটি এবং পশ্চিমাদের বাণিজ্যিক অবরোধের কারণেই এমনটা হচ্ছে।
মোরালেস চলে গেলেন। মোরালেসের অনেক সমালোচনাই আছে। কিন্তু সেনা–গণ অভ্যুত্থানে চড়ে যাঁরা ক্ষমতায় আসছেন, তাঁরাও কোনো সমাধান দিতে পারবেন না। কারণ, বলিভিয়া সম্ভবত মার্কিন সমর্থনপুষ্ট উগ্রবর্ণবাদীদের কর্তৃত্বে। দেশটার জনজাতি, পরিবেশ, নারী ও আদিবাসীদের হয়তো এর চড়া মূল্য দিতে হবে।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন