ব্রিটিশ গায়ক ক্যাট স্টেভেন্স (পরবর্তী সময়ে ইউসুফ ইসলাম) জন্মেছিলেন লন্ডন শহরে ১৯৪৮ সালে। তাঁর বেড়ে ওঠার সময় তিনি দেখলেন, বেপরোয়া নগরায়ণের বিস্তরণে শহরের সবুজ ঢেকে যাচ্ছে কংক্রিটের আবরণে, সুউচ্চ দালান দখল করে নিচ্ছে আকাশ। প্রতিবাদে তিনি গাইলেন:
‘আকাশ চিরে দালান উঠছে,
বাতাসকে সরিয়ে ইমারত।
সবুজ ঘাসকে সরিয়ে রাস্তা গড়েছ
কংক্রিটে ঢেকেছ খেলার মাঠ।
জানি, বহু পথ পেরিয়ে তোমরা নগর গড়েছ
বলতে পারো, ছেলেমেয়েরা খেলবে কোথায়?’
আমাদের দেশের নগরগুলোতে গণপরিসরে উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের ধরন খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে নগরের প্রায় সব পরিসরেই ক্ষমতাবান, সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তির অভিপ্রায় প্রাধান্য পেয়েছে। এখানকার রাস্তাঘাট, পরিবহনব্যবস্থা কিংবা সর্বজনীন স্থানগুলো সক্ষম শক্তিশালী পুরুষের জন্য তৈরি হয়েছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য উপযোগী শহর তৈরি হয়নি। এখানে মালিকানাবিহীন যৌথ পরিসর ব্যবহারের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দর্শন ক্রমে সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে আমাদের নগরজীবন কখনো আরামদায়ক হয়ে গড়ে ওঠেনি।
তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা পেয়েছে। জায়গাটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। কিন্তু এই সূত্রে গণপরিসরের দাবি নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, প্রতিটা মানুষের জন্য শহরে কমপক্ষে ৯ বর্গমিটার করে সবুজ খোলা পরিসর থাকা প্রয়োজন। এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। বিভিন্ন দেশের অবস্থা বিচারে সেটা কমবেশি হতে পারে। গণপরিসর নিয়ে সরব আমাদের এক বন্ধু মারুফ বলে, ঢাকা শহরে জনপ্রতি উন্মুক্ত স্থান ০ দশমিক ১১ বর্গমিটার, যা একটি চেয়ারের সমপরিমাণ জায়গা, তা-ও আবার সঠিকভাবে বণ্টন হয়নি। দখল বা ভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অনেকগুলো। কখনো ক্লাব দখল করে রাখে, কখনোবা চলমান প্রকল্পের নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়। উত্তরা, গুলশান, বনানীর মতো পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায়ও পার্কের জায়গা প্লটে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কোনো কোনো খেলার মাঠ ও পার্ক সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। অথচ খেলার মাঠ, পার্ক হলো একটি গণতান্ত্রিক পরিসর। গণপরিসর মানেই হলো সবার প্রবেশ ও ব্যবহারের অধিকার আছে এমন একটি স্থান, যা বাণিজ্যিকভাবে লাভের উদ্দেশ্যে তৈরি নয়।
নগর-পরিকল্পনার ভাষায় আমরা বলি, একজন পরিণত বয়সের মানুষ ১৫ মিনিট হাঁটা দূরত্বে যেন একটি খেলার মাঠ অথবা পার্কের মতো একটি গণপরিসর পেয়ে যায়। ব্যবহারকারীদের বয়স ও ব্যবহারের প্রকৃতিভেদে সেই পরিসর ছোট-বড় নানা আকারের হতে পারে। আবার পাড়া-মহল্লাগুলোতে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ৬ থেকে ৭ মিনিট হাঁটার মধ্যে একটা খেলার জায়গা পেয়ে যায়। এর জন্য অনেক বড় জায়গা প্রয়োজন হয় না। এটাকে প্লেয়িং লট বলে। শুধু বিঘাখানেক জায়গা হলে মহল্লায় ছোটদের একটা খেলার জায়গা হয়ে যায়। এবার যদি কমিউনিটি স্পেস বা নেবারহুড মাঠের কথা বলি, তবে এর জন্য একটু বড় অর্থাৎ ৫ থেকে ১০ একর জায়গার দরকার হবে। প্রতিটি পাড়া বা মহল্লার মধ্যে প্লেইং লট, মিনি পার্ক, নেবারহুড পার্ক ইত্যাদি বিভিন্ন আকারের গণপরিসর থাকা দরকার। মেট্রোপলিটন পর্যায়ে পার্ক তৈরিতে আরও অনেক বড় জায়গার দরকার হয়। যেমন আমাদের রমনা পার্ক। আগের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য তিনটি খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
নগরের প্রায় সব পরিসরেই ক্ষমতাবান, সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তির অভিপ্রায় প্রাধান্য পেয়েছে। এখানকার রাস্তাঘাট, পরিবহনব্যবস্থা কিংবা সর্বজনীন স্থানগুলো সক্ষম শক্তিশালী পুরুষের জন্য তৈরি হয়েছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য উপযোগী শহর তৈরি হয়নি। এখানে মালিকানাবিহীন যৌথ পরিসর ব্যবহারের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দর্শন ক্রমে সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে আমাদের নগরজীবন কখনো আরামদায়ক হয়ে গড়ে ওঠেনি।
একটি উন্মুক্ত স্থান, পার্ক কিংবা মাঠ নগরজীবনে ভীষণভাবে প্রয়োজন। শিশুদের খেলা বাদেও তাদের সামাজিকীকরণ ও মনের বিকাশে এটা খুবই জরুরি। একটা মাঠ শুধু শিশুদের খেলাধুলার জায়গা নয়, এখানে এলাকার বড়রা সকাল-বিকেল হাঁটাহাঁটির সুযোগ পান। কোথাও কোথাও ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক নগর-পরিকল্পনায় অগ্নিকাণ্ড অথবা ভূমিকম্পের মতো যেকোনো দুর্যোগে এ ধরনের গণপরিসরকে ইমার্জেন্সি রেসপন্সে ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে।
জনস্বাস্থ্য, সামাজিকতা, পরিবেশ, অর্থনীতি বিবেচনায় গণপরিসর ও উন্মুক্ত স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্মুক্ত স্থানের অভাবে নগরবাসী হাঁটাহাঁটির সুযোগ পায় না। ব্যায়ামের অভাবে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার ও মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। একাকিত্বের কারণে মানসিক টানাপোড়েন ও অপরাধপ্রবণতাও বাড়ছে।
পৃথিবীর উন্নত বিশ্বের অনেক বড় শহরে পার্ক ও ওপেন স্পেস অথরিটি নামে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। আমাদের দেশে স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯-এ সিটি করপোরেশনকে উদ্যান, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে সব ভূমিই ব্যক্তিমালিকানায়। উপযুক্ত সময়ে উদ্যোগ না নিলে এ ধরনের গণপরিসর সৃষ্টি করা যাবে না। কারণ, নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে ভূমির দাম বেড়ে যায়। তখন এটা কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠের প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে এখনো যথাযথ উদ্যোগ নিলে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর যদি মেয়াদকালে তাঁর ওয়ার্ডে একটা করে পার্ক বা খেলার মাঠ তৈরি করতে পারেন, তবে ঢাকা শহরে প্রতি পাঁচ বছরে নতুন করে ১২৯টি নতুন গণপরিসর সৃষ্টি করা যেতে পারে। আমার মনে হয়, খুব দ্রুতই এ ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে জায়গা কিনে হলেও তৈরি করাতে হবে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে আমরা অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা তৈরি করি, কিন্তু নতুন গণপরিসর তৈরিতে কেন অর্থের বরাদ্দ থাকবে না? মানবিক শহর গড়ে তুলতে মানসম্পন্ন সুন্দর গণপরিসরের বিকল্প নেই।
আমরা সারাক্ষণ বলছি উন্মুক্ত স্থান নেই, গণপরিসর নেই। সে জায়গাটায় একটা বিরাট পরিবর্তন হতে পারে, যদি আমরা নদীগুলোর পাড় ধরে সবুজ বেষ্টনী দিতে পারি এবং সংরক্ষণ করে গণপরিসর সৃষ্টি করতে পারি। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা—এ চার নদীর একটা পাশের পরিধি প্রায় ৫০ কিলোমিটারের মতো। তাহলে দুই পাশ মিলে হয় ১০০ কিলোমিটার। আমরা তো এখন ব্লু নেটওয়ার্ক, গ্রিন নেটওয়ার্কের কথা বলি; এই নদীর ধারগুলো বাঁধাই করে যদি সেখানে সবুজ বেষ্টনী বা সবুজ পরিসর তৈরি করা যায়, তাহলে টানা ৫০ কিলোমিটার নতুন সবুজ নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে।
শুধু নদী কেন, অসংখ্য খাল আছে। আমার গবেষণায় দেখেছি, এ শহরে প্রায় ৫২টি খাল আছে। এ খালগুলোকে যদি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা যায়, তাহলেও গণপরিসর সৃষ্টি করা যাবে। ঢাকাতে অনেক লেক আছে। যেমন হাতিরঝিল তৈরি করা হলো। ঢাকা শহরের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের মধ্যে এ রকম আরও পাঁচটি জলাধারের প্রস্তাব দেওয়া আছে, যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ একর জমি বরাদ্দ করা আছে। এ জলাধারগুলোকে এখনই অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ করা গেলে হাতিরঝিলের মতো আরও পাঁচটি জলাধার পাওয়া যাবে। ফলে গণপরিসর বাড়বে, জলাধার সংরক্ষণ হবে এবং প্রতিবছর বর্ষাকালে আমরা যে জলাবদ্ধতা সমস্যার সম্মুখীন হই, তা থেকে একটি স্থায়ী পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, নগর বসতিতে প্লটের পর প্লট শুধু দালান নয়, দরকার হয় খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, প্রকৃতি, জলাভূমির মতো গুরুত্বপূর্ণ গণপরিসরের ভারসাম্যপূর্ণ ভূমি ব্যবহার। এখানে নাগরিকদের পরিষেবা ও জননিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত অবকাঠামোরও প্রয়োজন। পরিকল্পনা উন্নয়ন মানুষের জন্য। মানুষের চাহিদাকে কেন্দ্রে রেখে গণতান্ত্রিক সামাজিক পরিসর প্রতিষ্ঠিত হোক। প্রবাসে থাকা এক বন্ধুকে বলেছিলাম, কবে ফিরবি? উত্তরে সে লিখেছিল:
‘দেখলে মনে হয়, আমার শহর আর আমার নেই।
এই শহরে প্রান্তর কই? নির্জনতা কই?
শরবন কই? নদীর ঘাট কই?
পাখির স্বগতোক্তি কই?
শুধুই কি ফোনালাপ, ফেসবুক আর মেসেঞ্জার?
প্রেম, অভিমান, খুনসুটি কি শুধু বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালে বাঁধা?
প্রেমহীন এই শহর দিয়ে আমি কী করব?’
●আকতার মাহমুদ অধ্যাপক, আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়