বারো বছরে এক যুগ। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় চার যুগ হতে যাচ্ছে। মহাকালের হিসাবে এটি অতি অল্প সময় হলেও কোনো জাতির জীবনে কম সময় নয়। বাংলার স্বাধীন হোসেন শাহী রাজত্ব এতটা সময়ই ছিল। জাতির ইতিহাসে তা ছিল স্বর্ণকাল। তা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
যাঁরা সরকারে আছেন এবং যাঁরা কখনো সরকারে ছিলেন এখন বিরোধী দল করেন, দেশ নিয়ে তাঁদের নিশ্চয়ই নিজস্ব চিন্তা, পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। দেশের ভালো-মন্দ ব্যাপারে তাঁরাই বোঝেন ভালো। তবে সাধারণ নাগরিকেরা একেবারে কিছুই বোঝেন না, তা নয়। হতে পারে তাঁদের বোঝাবুঝিতে দেশের কিছুই যায়-আসে না। বর্তমান বিশ্বে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, তা তাঁরা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। যাঁরা কম আশাবাদী, তাঁদের কেউ চিন্তিত, কেউ হতাশাগ্রস্ত। যাঁরা আশাবাদী তাঁরা মনে করেন, যত দেরিতেই হোক সুদিন আসবেই। যাঁরা নৈরাশ্যবাদীও নন, আশাবাদীও নন, তাঁরা মনে করেন, যা হওয়ার তা হবেই, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
ব৵ক্তির ক্ষেত্রে যেমন, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। বন্ধুহীন অবস্থায় নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে বাঁচা যায় না। শোনা যায়, বাংলাদেশের পাশে নাকি সবাই। পাশে থাকার কথা বলার চেয়ে দূরে বসে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মৌখিক প্রশংসাতেও স্বার্থসিদ্ধি তো নয়ই, কোনো কাজই হয় না। জন্মভূমি থেকে অত্যাচারিত হয়ে বিতাড়িত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় মানুষদের আশ্রয় দেওয়ায় পৃথিবীর সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। এই প্রশংসাটুকু যদি তারা না করত, তাহলে বরং তাদেরই দীনতার প্রকাশ ঘটত। তাতে বাংলাদেশের কিছু আসত-যেত না। বাংলাদেশ সরকার তার মানবিক দায়িত্ব পালন করছে। তবে সেটা পরিস্থিতির একটা দিক।
অনেক দিন আগেই পৃথিবীর চরিত্র বদলে গেছে। খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সময়ে যেমনটি ছিল, এখন তেমনটি নেই। দুর্ধর্ষ মঙ্গোলীয় শাসক চেঙ্গিস খাঁর সময়ের মতোও নেই। তা যদি থাকত, তাহলে বিশ্বে এখন চার-পাঁচটির বেশি রাষ্ট্র থাকত না। পৃথিবীতে বড়, মাঝারি ও ছোট রাষ্ট্র বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকত না। সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র সব ছোট দেশকে দখল করে নিত। আমেরিকার নাকের ডগায় একটুখানি কিউবার অস্তিত্ব থাকত না, ওটি হতো যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য। তাইওয়ান এখনো টিকে আছে। চীন যেকোনো মুহূর্তে ওটাকে দখলে নিতে পারে তিব্বতের মতো।
‘পাশে থাকা’ কথাটা বাংলাদেশে এখন অতি উচ্চারিত। সত্যিকারের পাশে থাকা বলতে যা বোঝায় তা হলো কিউবার পাশে সোভিয়েত ইউনিয়ন, তাইওয়ানের পাশে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমের সময় শ্রীলঙ্কার সৈন্যরা যখন মালদ্বীপে হামলা চালায়, তখন তার পাশে ছিল প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ভারত। ভারত সৈন্য পাঠিয়ে শ্রীলঙ্কার উচ্চাভিলাষী দস্যুদের খেদিয়ে দেয়। পাশে থাকার কথা বলে শুধু প্রশংসা বা নিন্দায় কাজ হয় না। বিশ্ববিবেক নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের পাশে আছে-বাংলাদেশের পাশেই থাক, পেছনেই থাক বা সামনেই থাক, বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ একা। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান তার নিজের মতো করে একাই সমাধান করতে হবে, সেই সমাধানের পরিণতি যা-ই হোক।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে নিন্দনীয় মানুষ মিয়ানমারের সরকারপ্রধান সু চি। একসময় গণতন্ত্র নিয়ে বড় বড় কথা বলায় পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নানা রকম পদক, পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার সব কটিই যখন কেড়ে নেওয়ার দাবি ওঠে এবং অনেকগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তখন চরম বেইজ্জতিতে পড়েন তিনি। তিনি যেমন বুদ্ধিমান, তার চেয়ে বেশি চতুর। আগেও যেমন গণতন্ত্রের কথা বলে নিজের দেশের ও পৃথিবীর মানুষকে ধোঁকা দিয়েছেন, এবারও তা-ই করলেন। বিভিন্ন দেশের নেতারা যখন অন্য ব্যাপারে সম্মেলন করতে তাঁর দেশে, তখন তিনি অতি ভালো মানুষের মতো বললেন যে তাঁর দেশ থেকে বাংলাদেশে যারা এসেছে, তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তা বলে কিঞ্চিৎ বাহবা পেলেন এবং সেই ফাঁদে সরলমতি বাংলাদেশ শুধু পা নয়, গোটা শরীরই ঢুকিয়ে দিল। স্বাক্ষরিত হলো তথাকথিত চুক্তি বা অ্যারেঞ্জমেন্ট-বন্দোবস্ত। কত দিনের মধ্যে ফিরিয়ে নেবে, সেসব শর্ত কিছুই নেই। দুই মাসে হেঁটে ও নৌকায় এসেছে যে ছয় লাখ, তারা যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই হেঁটে ও নৌকায় মরতে মরতে যাবে না, গাড়িতে যেতে চার সপ্তাহের বেশি লাগার কথা নয়। চুক্তিপত্রে যিনি দস্তখত করে এসেছেন এবং মিয়ানমারকে মোটামুটি এই মুহূর্তে উদ্ধার করে দিয়ে এসেছেন, তিনিও গণমাধ্যমকে বলেছেন, ছোটখাটো খুঁটিনাটি নিয়ে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। অর্থাৎ, যা করার তা করেছি, তোমরা বুঝে নিয়ো।
যে ধরনের অতি অস্পষ্ট চুক্তি হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ ধরে নিতে পারে, ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে মহামতি সু চি তাঁর দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করবেন। প্রথম মাসে বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ১০ জনকে নিলেন। প্রকাণ্ড ছবি ছাপা হলো ইউরোপের পত্রিকায়। দ্বিতীয় মাসে আর ১০ জন। এভাবে নিলে রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরতে রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তবে বাংলাদেশ সরকারের দূরদর্শিতার অভাব আছে-এ কথা তার ঘোর শত্রুও বলতে পারবে না। ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে হাসিখুশি পরিবেশে সমঝোতার কাগজে দস্তখত করা হয়েছে। দস্তখতের পরেই কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছেন শেষ পর্যন্ত কী হবে। তাই রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দও করেছেন। এর পরপরই ঘোষিত হয়েছে রোহিঙ্গাদের ছয় মাসের মধ্যে নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে ‘পুনর্বাসিত’ করা হবে। কালবিলম্ব না করে ভাসানচরে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরুও হয়েছে। এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর মিয়ানমারের জেনারেলরা বগল বাজানো শুরু করেছেন তাতে লেশমাত্র সন্দেহ নেই। হয়তো শিগগিরই ভাসানচরের নাম হবে ‘রোহিঙ্গানগর’। সেই নামকরণ অনুষ্ঠানেও নেতারা গিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার বন্ধুত্বের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস বর্ণনা করবেন।
যা ঘটছে, তাতে জনগণের বলার কিছু নেই; করার কিছু তো নেই-ই। আমরা আমাদের নদীশিকস্তি মানুষ, ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষের থাকার ব্যবস্থা করতে পারি না; লাখ লাখ মানুষ পথেঘাটে, রেললাইন ও রেলস্টেশনের ধারে, গাছের নিচে বা খোলা আকাশের নিচে দিন কাটায়, তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারি না, সেখানে ভিনদেশিদের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করছি। পাহাড় কেটে তাদের থাকার ব্যবস্থা করছি, বনভূমির গাছ কেটে তাদের জন্য ঘর বানাচ্ছি। তারা মোগল আমলের মতো মৌরুসি পাট্টা পেয়ে যাবে। বংশানুক্রমে বসবাস করবে ‘রোহিঙ্গানগরে’। সেই অঞ্চলে তৈরি হবে নতুন বসতির সঙ্গে এক নতুন সংস্কৃতি। সেখানে গড়ে উঠবে মাদক ব্যবসা, নারী পাচার, চোরাচালান, উগ্র মৌলবাদী রাজনৈতিক তৎপরতা।
সমস্যা তো রোহিঙ্গারা নয়, সমস্যা মিয়ানমার। রোহিঙ্গারা উপলক্ষ মাত্র। মিয়ানমারের সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে যে কাগজে সই করা হয়েছে, তার পেছনে বন্ধুদেশ চীনের আশীর্বাদ রয়েছে। চীনের মন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে যাওয়ার পরই ওই কাগজে স্বাক্ষরিত হয়। রোহিঙ্গা সমস্যার দ্বিপক্ষীয় সমাধানের তত্ত্বটি চীনের। ব্যাপারটি যদি দ্বিপক্ষীয়ই হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অনন্তকাল ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেবে না। মিয়ানমারে চাল আছে প্রচুর। তাদের থেকে আমরা সপরিবার সফরে গিয়ে চাল কিনে এনেছি। কই, মিয়ানমারের নোবেল বিজয়ী শান্তিবাদিনী তো এক ছটাক চালও তাদের দেশের দুর্গতদের জন্য পাঠাননি!
উদ্বাস্তু শিবিরে থাকার কী যন্ত্রণা, তা ফিলিস্তিনের মানুষ ভোগ করছে পৌনে এক শতাব্দী যাবৎ। সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা ভোগ করেছে ও করছে। সর্বশেষ উদাহরণ আমাদের ছিটমহলবাসী। যেদিন ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি হলো, সেদিন আমাদের মিডিয়া ও মানুষ যে আনন্দ-উল্লাস করেছিল আতশবাজি পুড়িয়ে, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা নেই বললেই চলে। তখন আমি লিখেছিলাম, আনন্দটা একটু মাত্রার বাইরে হয়ে গেল। কেউ কেউ তাতে আমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের আজ অনুরোধ করতে চাই, তাঁরা গিয়ে দেখে আসুন ভারতের অস্থায়ী শিবিরে বাস করা ৯৭৯ জন ছিটমহলবাসীর অবস্থা। ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের কথা ছিল, তার থেকে কিছু টাকা ভারত সরকার বরাদ্দ করেছে, কিন্তু ছিটমহলবাসীর মানবেতর জীবনের অবসান হয়নি। একই অবস্থা পাকিস্তানি নাগরিক উর্দুভাষী মানুষের, যারা আজও বাংলাদেশে রয়ে গেছে। পাকিস্তান তার নাগরিকদের নিয়ে যায়নি। রেশননির্ভর শিবিরবাসী জীবন কোনো জীবন নয়।
ওআইসিতে একসময় বাংলাদেশের অবস্থান বেশ শক্ত ছিল। মুসলিম বিশ্বের যেকোনো সমস্যায় বাংলাদেশের মতামতের ও ভূমিকার মূল্য ছিল। আমরা তা খুইয়েছি। জোটনিরপেক্ষ গোষ্ঠী বা ন্যামের বাংলাদেশ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ওই সংস্থাই এখন নিবীর্য। আঞ্চলিক পর্যায়ে সার্ক ছিল। সার্কের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা একই ব্যক্তি হলেও সংস্থাটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ভারতের প্রাধান্য থাকবে বলে প্রথম থেকেই সার্কের ব্যাপারে পাকিস্তানের আগ্রহ ছিল কম। তারপরও আশির দশকে এটি আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিবেশীদের নিয়ে একটি আঞ্চলিক জোট হিসেবে সার্ক একটি ভূমিকা রাখছিল। পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে গিয়ে সেই সংস্থাকে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা অকার্যকর করার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাতে বাংলাদেশ যে কিছুমাত্র লাভবান হয়েছে, তা বলা যাবে না।
রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে, সে কথা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেশগুলো জোরালোভাবেই বলছে। মার্কিন সিনেট ও সরকার বলেছে, ওই সমস্যা সৃষ্টি করেছে তারা, তার সমাধানও তাদেরই হাতে। তাদের নাগরিককে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা মিয়ানমারের আড়াই গুণ। তারা শক্তিশালী আর বাংলাদেশ দুর্বল-এ কথা ভাবতেই দেশবাসীর অন্তরে চরম কষ্ট হয়। জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি না থাকলেই দেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রে নানা ব্যাপারে মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের বিকল্প নেই। একাত্তরের ডিসেম্বরে খুব কম কয়েকটি দেশই শুধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সেদিন জাতীয় ঐক্যের কারণে বিশ্বে বাংলাদেশের যে অবস্থান ছিল, আজ তা আছে কি না, তা দেশবাসীর প্রশ্ন। সরকার ছাড়া সেই প্রশ্নের জবাব আর কেউ দিতে পারবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।