মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রার্থী হওয়াটাই বড় নির্দয়তা নয়। যেটা চিন্তার বিষয়, সেটা হলো তিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন একটি বর্ণবাদী ক্ষমতার কাঠামোকে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরাজমান। যদিও অনেক সময় ধরে এটা খণ্ডিত অবস্থায় থেকেছে। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ণবাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে আমেরিকার। এর ভবিষ্যৎ আছে জেনেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ধারাটিকে প্রলম্বিত করার জন্য আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছেন।
ট্রাম্প উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রাধান্য দিয়ে এক যুক্তরাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে পারেন, যদি তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হতে পারেন। অবশ্য সেটা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বে তাঁর এই শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্রীতদাসপ্রথা এতটাই গভীরভাবে শিকড় গেড়েছিল যে মার্কিন সমাজে যার অবসান ঘটাতে তাকে একটা রক্তস্নাত গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
রিচার্ড রথস্টেইল তাঁর বিখ্যাত কালার অব লাভ বইয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন, কী করে ফেডারেল সরকার, অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় সরকারগুলো শ্বেতাঙ্গ সহিংসতার বাতাবরণে দেশজুড়ে আফ্রো-আমেরিকান ‘ঘেটো’র সৃষ্টি করেছিল, তাদের সুরক্ষা দিয়েছিল। আবার তারা শ্বেতাঙ্গ শহরগুলোতে বর্ণভিত্তিক বিভাজনের বিস্তার ঘটিয়েছিল। তারা বিপুলসংখ্যক বর্ণবাদী আইন তৈরি করেছিল, যা গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ দিকে ফেডারেল কোর্ট ও কংগ্রেস ধীরে ধীরে নির্মূল করেছিল। কিন্তু তারপরও পুলিশি বর্বরতা ও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী কিছু ধারা চলছে। আসন্ন নির্বাচনেও অশ্বেতাঙ্গদের অবদমিত রাখার প্রয়াস লক্ষণীয়। গোটা দেশে কৃষাঙ্গরা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার এবং আমেরিকার বিচ্ছিন্ন আবাসিক এলাকাগুলোর প্রায় সবটাই শ্বেতাঙ্গ–অধ্যুষিত রয়ে গেছে।
১৯৫০ ও ১৯৬০–এর দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট বা নাগরিক স্বাধীনতার আন্দোলন গভীর ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ছাপ ফেলে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীলদের মধ্যে ওই পরিবর্তনের কারণে কৃষাঙ্গবিরোধী প্রচণ্ড রাজনৈতিক বৈরিতা তৈরি করেছিল। শ্রমিকশ্রেণি ও শ্বেতাঙ্গ ধর্মপ্রচারক, যারা দীর্ঘদিন ধরে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের ‘নিউ ডিল কোয়ালিশনের’ অংশে পরিণত হয়েছিল, তারা ওই পরিবর্তনের পরে রিপাবলিকান দলে ভিড়ে গেল। অঙ্গীকার করল, বিভাজন না করার যেকোনো চেষ্টা তারা প্রতিহত করবে। সামাজিক রক্ষণশীলেরা যে নীতিই প্রণয়ন করবে, তার প্রতি তারা সমর্থন ব্যক্ত করবে। আমেরিকার সমাজে একে বলা হয় ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় কৌশল’। এ কৌশলের কারণেই রিচার্ড নিক্সন ১৯৬৮ সালে এবং ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রিগ্যান হোয়াইট হাউসে পা রেখেছিলেন। একই ধারাবাহিকতায় কিছু শ্বেতাঙ্গ, ধর্মপ্রচারক গোষ্ঠীর সহায়তায় যথাক্রমে নির্বাচিত হতে দেখা গেছে সিনিয়র বুশ, জুনিয়র বুশ ও ট্রাম্পকে।
আজকের তরুণ মার্কিন প্রজন্মের বর্ণগত বৈচিত্র্যের প্রতি রয়েছে বিশেষ ঝোঁক। তারা বৈচিত্র্যের সমর্থক। নিজেদের তারা বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাবতেই বেশি পছন্দ করে। তার কারণ, তারা অনেক উন্নত, শিক্ষিত। কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে তারা বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র থেকে আসা ছেলেমেয়ের সঙ্গে সহশিক্ষা পেয়েছে। আর সেটাই তাদের বৃহত্তর বর্ণগত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছে।
ট্রাম্পের পরাজয় যেহেতু অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তাই ট্রাম তার বাগাড়ম্বর তীব্র থেকে তীব্র করে চলেছেন। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ট্রাম্পের এখন দরকার কৃত্রিমভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি ভোট গণনার অনুষ্ঠান। তিনি এখানে বিশৃঙ্খলা দেখতে চাইছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে তাঁর সবচেয়ে হৃদয়চাঞ্চল্যকারী সাম্প্রতিক মন্তব্য হচ্ছে, ‘যদি নির্বাচনে হেরে যাই, সে ক্ষেত্রে আমাকে হয়তো দেশ ত্যাগ করতে হবে।’
আসলেই এ সম্ভাবনা বেশি। কারণ, তাঁর আর্থিক কেলেঙ্কারি, জীবনভর ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার মতো বিষয়ে আইন ও বিচার তাঁকে ধাওয়া করবে।
যদি কোনো কারণে ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন, তাহলে একটি প্রকাশ্য বর্ণবাদী যুক্তরাষ্ট্র সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠবে। অভ্যন্তরীণভাবে ইতিমধ্যে বেপরোয়া হয়ে থাকা শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থীরা দেশজুড়ে প্রকাশ্যে সহিংসতা শুরু করে দিতে পারে। আর বৈশ্বিক মঞ্চে চীনের সঙ্গে একটি ঠান্ডা যুদ্ধে যেতে ট্রাম্পের নির্বাচন সমর্থকদের বাসনা আছে। চীনবিরোধী বর্ণবাদ ও ঐতিহাসিক অজ্ঞতার কারণে এখন তাদের মধ্যে একটা ‘জেনোফোবিয়া’ কাজ করছে।
সবকিছু মিলিয়ে যে অর্থটা দাঁড়ায়, তা হলো সামনের সপ্তাহগুলোতে একটা বিপন্ন ও বিবর্ণ চিত্র প্রতীয়মান হয়, ট্রাম্প বিদায় না নেওয়া পর্যন্ত বিশ্ব নিরাপদ হবে না।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাক্স: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নবিষয়ক অধ্যাপক