বন্যায় এই মুহূর্তে যা করতে হবে

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার ও পানির সংকট। সেখানে সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পদক্ষেপ নিতে হবে
 প্রথম আলো

গতকাল রাতে অনেক চেষ্টার পর দুয়ারাবাজারের প্রবীণ বন্ধু হারুন শেখের সঙ্গে কথা হয়। তিনি ভালো আছেন। তাঁর পরিবারের সঙ্গে আরও পাঁচ পরিবার বাড়ির ছাদে আছে আজ চার দিন। সেখানেই রান্নাবান্না, শোয়া-বসা আর পানির দিকে তাকিয়ে থাকা। সিলেটের উন্নয়নকর্মী সাইফুল ভাইয়ের মা থাকেন ছাতকের এক নিভৃত গ্রামে। ১৬ জুন বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর সঙ্গে ছেলের কথা হয়, তখন উঠানে পানি। মা–ছেলে কারোরই বিশ্বাস হয়নি ঘরে পানি উঠবে। খাট থেকে নামার উপায় থাকবে না। তিনি জানালেন, ‘ভালো আছি, দোয়া করিয়ো।’ তাঁরা যতই লুকানোর চেষ্টা করুন না কেন, তাঁদের গলায় আগের সেই জোর পেলাম না। আত্মবিশ্বাসের সুতাটায় যেন কোথায় একটা টান পড়েছে। এমন বোকা বানানো বন্যা তাঁরা তাঁদের এই দীর্ঘ জীবনে দেখেননি। বাপ-দাদা-শ্বশুর-শাশুড়ির কাছেও শোনেননি। মুখে তাঁরা যা-ই বলুন, তাঁদের হকচকিত ভাব এখনো কাটেনি। মানুষ আত্মবিশ্বাস হারালে দুর্যোগ মোকাবিলা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাঁরা এখন সেই ক্রান্তি পার করছেন।

আমাদের ত্রাণ ব্যবস্থাপনার কোনো ঝোলায় এই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার বটিকা নেই। কিন্তু এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি দাওয়াই। মানুষকে এই ভ্যাবাচেকা ঘোর থেকে বের করে আনার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে আসন্ন ও চলমান ত্রাণ তৎপরতায় তাদের সম্পৃক্ত করা। পানি আস্তে আস্তে নামতে শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে শুকনো খাবারের চেয়ে রান্না করা খাবার বেশি প্রয়োজন। স্থানীয় মানুষের নেতৃত্বে প্রতি ১০০টি পরিবারের জন্য গ্রাম বা মহল্লাভিত্তিক বিনা মূল্যের খাবার ঘরের ব্যবস্থা করে রান্না করা খাবার সরবরাহ করতে হবে। হারুন শেখ ইতিমধ্যেই তাঁর সীমিত সাধ্যের মধ্যে সেটা শুরু করেছেন। তাঁর বা তাঁদের পাশে দাঁড়ালে তাঁরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন।

ভিড় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

যত পানি কমবে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ত্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে সেখানে। এতে মানুষের ভিড় তত বাড়বে। এদের বেশির ভাগ সাধারণত তত দূরই যাবে যত দূর গেলে সন্ধ্যার আগে ডেরায় ফেরা যায়। ফলে কষ্টে থাকা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য তাদের আবেগের মেঘ কোনো বৃষ্টি নামাতে পারবে না। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এটা একটা ক্রনিক সমস্যা। এরা ছবি তুলবে অসহায় হারুন শেখ আর মরিয়ম বেওয়ার সঙ্গে একটার পর একটা। তাই বলে কি আমরা মানুষের আবেগ আর পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাকে মূল্য দেব না? অবশ্যই সেটা দিতে হবে। ত্রাণের ক্ষেত্রে মূল সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে উপজেলা আর ইউনিয়ন পরিষদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোকে। আমাদের গৃহীত রাষ্ট্রীয় নীতিমালার বিধান সেটাই। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আর পৌরসভার কাউন্সিলররা জানেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কথা, কোথায় মানুষ আটকা আছে, কার কাছে আগে পৌঁছানো উচিত। তাই এই মুহূর্তে তাঁদের সহায়তা ছাড়া ঠিক জায়গায় ঠিক মানুষটির কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। প্রয়োজনে কমিটিগুলো সম্প্রসারণ করার ব্যবস্থা নীতিমালায় আছে। ত্রাণ গ্রহণ ও বণ্টনের কাজে স্থানীয় সব শ্রেণি, পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করলে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

ওপরের কাঠামোতেও পরিবর্তন দরকার

সিলেট ও সুনামগঞ্জ—দুই জেলায় প্রাথমিক আর টেকসই পুনর্বাসন পুনরুদ্ধারের কথা এখন থেকেই ভাবতে হবে। জেলা প্রশাসকের রোজকার দায়িত্বের পাশাপাশি এটা করা খুবই দুরূহ। তাই অতীতের মতো সচিব পদমর্যাদার একজনকে ত্রাণ পুনর্বাসন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া দরকার। তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের জেলা পর্যায়ের প্রয়োজনে তাঁদের ঊর্ধ্বতনদের নিয়ে একটা টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

ত্রাণের ক্ষেত্রে করণীয়–বর্জনীয়

বাজারে একটা কথা চাউর হয়েছে, নৌকার মাঝিরা কেউ নৌকা দিতে চাইছেন না, বেশি ভাড়া চাইছেন। তবে উল্টো খবরও আছে। ত্রাণ তৎপরতার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কেউ যদি নৌকা নিতে চায়, কত দিনের জন্য নিচ্ছে, কী শর্তে নেওয়া হচ্ছে, তা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। জোর করে তথাকথিত রিকুইজিশনের জালে ফেলে নৌকা না নিয়ে একটি চুক্তির মাধ্যমে তা নেওয়া প্রয়োজন। এটি দুর্যোগ প্রস্তুতির একটা অংশ হওয়া উচিত। স্বচ্ছতার সঙ্গে নৌকা নেওয়া ও ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যোগাযোগব্যবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাজারে ত্রাণসামগ্রী মিলছে আরও মিলবে। কাজেই ঢাকা থেকে ত্রাণসামগ্রী না পাঠিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সিলেট বা আশপাশের বাজার থেকে এগুলো ক্রয় করে বিতরণ করা উচিত। এতে স্থানীয় বাজার চাঙা হবে এবং অর্থনীতিতে চঞ্চলতা ফিরে আসবে।

সুনামগঞ্জ শহরের প্রায় সব এলাকা আর সিলেটের অনেক এলাকায় বাড়ির নিচতলা ডুবে গিয়ে পানির ট্যাংক, টিউবওয়েল পানিতে তলিয়ে গেছে। এগুলো অতি দ্রুত পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাছে টিউবওয়েল উঁচু করার বাড়তি পাইপ থাকে, এগুলো বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। হাওর অঞ্চলে এখন আফাল (তীরে আঘাত হানা প্রবল বাতাস) হচ্ছে, হাওরের এই বাতাসের কারণে বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে। আগামী অমাবস্যায় এই বাতাস আরও বাড়বে, তাই এখনই বাড়িঘরগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। এখনো অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি, যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুৎ অবস্থা স্বাভাবিক করার ব্যবস্থা করতে হবে।

ত্রাণ বিতরণ করার সময় শিশু, কিশোর, নারী, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদা উপযোগী খাবার ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণ করতে হবে। ত্রাণ বিতরণ করার প্রতিটি জিনিস আলাদা প্যাকেটে দিতে হবে, যেমন: আলু, চাল যেন এক প্যাকেটে দেওয়া না হয়, এতে আলু পচে গিয়ে চাল নষ্ট হতে পারে। মোমবাতি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বেশির ভাগই মোমবাতি প্যারাফিন (পেট্রোলিয়াম বর্জ্য) থেকে তৈরি করা হয়। এটি পরিবেশ, মানুষ বিশেষ করে শিশুদের জন্য বিপজ্জনক। এর বিকল্প হিসেবে ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট বা কেরোসিনের লণ্ঠন সরবরাহ করা যেতে পারে। পানি বিশুদ্ধ করার বড়ি ব্যবহারে পানিতে একটা কটু গন্ধের সৃষ্টি হয়। শিশুরা এটি পছন্দ করে না। বিকল্প হিসেবে ফিটকিরি ব্যবহার করা যায়। এক কলসি পানিতে (প্রায় ১০ সের) এক চা-চামচ গুঁড়া ফিটকিরি ভালো করে মিশিয়ে ছয় ঘণ্টা পর ওপরের পানি পান ও ব্যবহার করা যাবে।

যত দ্রুত সম্ভব গবাদিপ্রাণীর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এক সুনামগঞ্জেই প্রায় সাত শ খামার রয়েছে। আসন্ন কোরবানির ঈদ ও বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনা করে গবাদিপ্রাণীর খাবারের দাম কমাতে হবে। প্রয়োজনে অন্য এলাকা থেকে গবাদিপ্রাণীর খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এর সঙ্গে খুব দ্রুত গবাদিপ্রাণীর টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে যক্ষ্মারোগী এবং ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগী যাঁদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর ওষুধ নিতে হয়, তাঁদের ওষুধের ব্যবস্থা করা এবং শিশুদের টিকা প্রদানে যাতে কোনো ছেদ না পড়ে, সে বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।

বৃষ্টি ও বন্যায় আটকে পড়া অনেকেই শিশুদের স্বজনদের তত্ত্বাবধানে রেখেছেন। পরিবারে বা পরিবার থেকে দূরে শিশু-কিশোরেরা নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। সেদিকে নজর রাখা জরুরি।

যেখানে সম্ভব স্কুলগুলো খুব দ্রুত পরিষ্কার করে খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল খোলা সম্ভব না হলে যত দ্রুত সম্ভব অস্থায়ী বিদ্যালয় বা শিশুবান্ধব কেন্দ্র বা সিএফএস স্থাপন করতে হবে। এর গঠন ও পরিচালনায় বিদ্যালয়কে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্কুল বন্ধ, দীর্ঘদিন ঘরে পানিবন্দী হয়ে থাকা, খেলাধুলা করতে না পারা ইত্যাদি কারণে তাদের ওপর মানসিক চাপ পড়ে। এ সময়ে শিশুদের মনঃসামাজিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ করতে হবে দ্রুত। শিশুদের জন্য খাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনও বিশেষ জরুরি।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক। nayeem5508@gmail.com