বন্যার ব্যাপার-স্যাপার

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

অনেক আগে এক কৌতুক ম্যাগাজিনের পাতায় একটি চটি গল্প পড়েছিলাম: দুজন ভিনদেশি পর্যটক আমেরিকার মায়ামি সৈকতে বসে কথাবার্তা বলছিলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে একজন অপরজনকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আচ্ছা, পর্যটন তো বেশ ব্যয়বহুল, আপনি অত টাকাপয়সা পেলেন কোত্থেকে?’

‘আমি আমার দ্রব্যসামগ্রীর গোডাউনের বিমা করেছিলাম, ওটাতে আগুন লেগে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ায় প্রচুর অর্থ পেলাম।’ দ্বিতীয়জন জবাব দিলেন। পরক্ষণে দ্বিতীয়জন কর্তৃক অনুরূপ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমজন বললেন, ‘আমি আমার শস্যক্ষেত্রের বিমা করেছিলাম, বন্যায় সব শস্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বেশ ভালো পয়সা পেয়েছি।’

এক মিনিট নীরবতা। অতঃপর প্রথমজন দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বলুন তো, আপনি বন্যা লাগালেন কী করে?’ অর্থাৎ তিনি কারচুপির মাধ্যমে গোডাউনে আগুন লাগিয়ে অর্থলাভ করেছেন, তাই তিনি ধরে নিয়েছেন যে অপর ব্যক্তিটিও অবশ্যই অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করে থাকবেন। কিন্তু বন্যা তো ইচ্ছা করে লাগানো যায় না। তবে হ্যাঁ, বন্যাও লাগানো যায় যদি আপনি যথাযথ হিসাব-নিকাশ না করে অপরিকল্পিত বাঁধ, ড্যাম ও ব্যারাজ তৈরি করেন।

 বন্যা ক্ষতিকারক, আবার উপকারীও বটে। উপকারের একটা নমুনা তো প্রারম্ভের গল্প থেকে পাওয়া গেল। অন্যান্য উপকারিতা, যেমন বন্যাবাহিত পলিমাটির ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যা-পরবর্তী সময়ে জমিতে বাম্পার ফলন হয় এবং বন্যা-পরবর্তী ত্রাণ তৎপরতায় সরকারের জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পায়। আর? আর ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে কিছু সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধির আখের গোছানোরও সুযোগ মেলে। সর্বোপরি, বন্যা উঁচু-নিচু সবাইকে লেভেল করে ফেলে।

 এবং দুনিয়ায় যে তিনটি প্রধান নদীর বন্যা সম্পর্কে শোনা যায়, সেগুলো হচ্ছে মিসরের নীল নদ, চীনের হোয়াংহো আর মার্কিন মুলুকের মিসিসিপি নদী। হোয়াংহোকে তো একসময় বলা হতো ‘চীনের দুঃখ’। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেসব দেশের নিজ নিজ সরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে দুঃখের অবসান ঘটিয়ে ফেলেছে। আমরাও খোদা চাহেন তো পারব, যদি আমরা একযোগে ও সর্বান্তঃকরণে চেষ্টা চালিয়ে যাই।

আর হ্যাঁ, বন্যার প্রসঙ্গে সর্বাগ্রেই যে কথাটি মনে আসে তা হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে আদি মানব আদম (আ.)–এর দশম অধস্তন পুরুষ নূহ (আ.)-এর সময়কার মহাপ্লাবন। স্রষ্টার আদেশে নূহ (আ.) পূর্বাহ্ণে অতিকায় বিরাট এক কিস্তি তথা নৌকা তৈরি করে মহাপ্লাবন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসী নর-নারীদের এবং জোড়ায় জোড়ায় সমগ্র পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ নিয়ে নৌকায় চড়ে বসেন এবং সেটা ১৫০ দিন ভাসমান থাকার পর প্লাবন শেষে বর্তমান তুরস্কের সীমান্তে ডাঙায় ঠেকে। নৌকার আরোহী ছাড়া আর সবার, সবকিছুরই সলিলসমাধি হলো। সৃষ্টির নবযাত্রা শুরু হলো।

সে যাকগে। নদী-শিকস্তি আমাদের এই ভূখণ্ডে বন্যা অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ছোটবেলায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পৈতৃক নিবাসে অবস্থানকালে কর্ণগোচর হতো, মুরব্বি শ্রেণির কেউ কেউ বলাবলি করতেন, ‘ধলা পানির বছরে আমার বয়স ছিল দুই কুড়ি পাঁচ।’ বন্যার পানি সাধারণত পরিষ্কারই হয়; কিন্তু সে বছর, অর্থাৎ ১৯২৯ সালের বন্যার পানি ছিল ঘোলা তথা সাদা, আর সাদাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ধলা’। এবং বয়স যে কুড়ির হিসাবে তখন বলা হতো (বোধ করি পাড়াগাঁয়ে এখন অবধি বলা হয়), সেটার সমান্তরাল ঘটনা পরিলক্ষিত হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বিশ্বখ্যাত ‘গ্যাটিসবার্গ ভাষণ’-এও। ভাষণটির শুরুতেই ‘৮৭ বছর আগে’ কথাটা না বলে তিনি বলেছেন, ‘ফোর স্কোর অ্যান্ড সেভেন ইয়ারস অ্যাগো’, অর্থাৎ ‘চার কুড়ি সাত বছর আগে’। হাজার হোক, আমরা সবাই তো বাবা আদম আর বিবি হাওয়ার সন্তান।

তবে বন্যা-সম্পর্কিত কোনো রম্যরচনাই রিডার্স ডাইজেস্ট-এর সেই বিখ্যাত, বহুল কথিত চটি গল্পটির অন্তর্ভুক্তি ছাড়া পূর্ণতা পাবে না:

বন্যার পানি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে। একতলা দালানের বন্যার্ত মালিক দালানের ছাদে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ একটা ডিঙি এসে তাঁকে নৌকায় চড়ার আহ্বান জানাল। তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, ‘বিশ্বস্রষ্টার ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। তিনি স্বয়ং আমাকে রক্ষা করবেন।’ ডিঙি চলে গেল।

এদিকে বন্যার পানি বাড়তেই থাকল। তিনি যখন বুকপানিতে দাঁড়িয়ে, তখন একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আরও কিছু লোককে উদ্ধার করে নিয়ে এসে তাঁর পাশে থেমে একই আহ্বান জানাল। এবারও তিনি একই কথা বলে নৌকাটিকে বিদায় দিলেন।

অতঃপর তিনি যখন আকণ্ঠ পানিতে দাঁড়িয়ে আছেন, তখন একটি ত্রাণ-হেলিকপ্টার উড়ে এসে ওপর থেকে রশি নামিয়ে তাঁকে তা আঁকড়ে ধরতে বলল, যাতে তাঁকে উড়িয়ে শুকনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এবারও তিনি একই কথা বলে সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন। অবশেষে বন্যার পানিতে ডুবে তিনি মারা পড়লেন এবং মৃত্যুর পর স্রষ্টার সামনে উপনীত হয়ে অভিযোগ-অনুযোগ শুরু করে দিলেন।

স্রষ্টা তখন রাগান্বিত হয়ে তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘দেন হু দ্য হেল সেন্ট ইউ দোজ টু বোটস অ্যান্ড দ্য হেলিকপ্টার—তাহলে ওই দু-দুটো নৌকা আর ওই হেলিকপ্টার কে পাঠিয়েছিল, শুনি?’

গল্পটার মোরাল তথা অন্তর্নিহিত অর্থ আশা করছি বিদগ্ধ পাঠককুলকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।

আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷