উন্নয়ন

বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা কী এবং কেন?

অবশেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ মহাপরিকল্পনা’ অনুমোদন করেছে। শত বছরের এ পরিকল্পনা তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ এবং নেদারল্যান্ডসের বিশেষজ্ঞরা। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের বিশ্বাস, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পরিষদ তথা এনইসি কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ায় প্রথমবার পানিসম্পদকেন্দ্রিক এই মহাপরিকল্পনা জাতীয় মহাপরিকল্পনা হিসেবে গৃহীত হবে এবং জাতীয় প্রতিশ্রুতি হিসেবে বাস্তবায়িত হবে।

উৎসাহী পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, এই পরিকল্পনার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের সময় বলা হয়েছিল, খাতভিত্তিক স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনার ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই নতুন প্রয়াস। আমাদের পানি, বন্যা, কৃষি, নিষ্কাশন, জলবায়ু ইত্যাদি নিয়ে ৫০ বছরে প্রায় ৩ হালি লম্বা পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। এসব পরিকল্পনার অধিকাংশই একক খাতভিত্তিক। একক খাতভিত্তিক হওয়ার কারণে এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সময় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা আমলে নেওয়া হয়নি এবং এ কারণে সমন্বয় আশানুরূপ হয়নি।

পরিকল্পিত ১০০ বছরের প্রথম ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০২০-৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয় হবে মোট ৮০টি প্রকল্পে। প্রস্তাবিত ৮০টি প্রকল্পে এই টাকা খরচ করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হবে; অর্থাৎ অধম থেকে মধ্যম আর মধ্যম থেকে উত্তম হওয়ার দৌড়টা জোরদার হবে।

জানা গেছে, পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোকে অভিন্ন গ্রুপ বা হটস্পটে আনা হয়েছে। এভাবে দেশে মোট ৬টি হটস্পট [উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল, নগর অঞ্চল ও ক্রসকাটিং অঞ্চল (শেরপুর, নীলফামারী ও গাজীপুর জেলা)] চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব হটস্পটের পানিসম্পদ, ভূমি, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভূ-প্রতিবেশ, নদীর অভ্যন্তরীণ ব্যবহার, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা, পলি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে পানির চাহিদা নিরূপণ ও সুপেয় পানি সরবরাহে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য ২৩টি প্রকল্প; বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ৯টি প্রকল্প, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য ৬টি প্রকল্প, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য ৮টি প্রকল্প, নদী ও মোহনা অঞ্চলের জন্য ৭টি প্রকল্প, নগর অঞ্চলের ১২টি প্রকল্প আর ক্রসকাটিং অঞ্চলের জন্য ১৫টি প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে।

তহবিলের উৎস কী হবে?

পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছেন, এই তহবিলের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী, পরিবেশ ও জলবায়ু-সম্পর্কিত তহবিল, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বকে (পিপিপি) বিবেচনা করা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, পানিসম্পদ নিয়ে ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনায় নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। এই সমঝোতার আওতায় টেকসই বদ্বীপ ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু অভিযোজনে সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে কারিগরি সহযোগিতা দেবে।

কিন্তু ‘দুইখান কথা’ আছে।

প্রায় ৬০ বছরের পানি ব্যবস্থাপনার সোনালি-রুপালি অভিজ্ঞতায় কী এমন চিড় ধরল যে সবকিছু ঝেড়েঝুড়ে আবার নতুন করে বৈদেশিক জ্ঞান আর তহবিলের ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল আরেক পরিকল্পনা ফাঁদতে হবে? আগের পরিকল্পনাগুলোর মাধ্যমে গড়ে ওঠা অবকাঠামোগুলো রক্ষণাবেক্ষণই যদি এই মহাপরিকল্পনার একটা কাজ হয়, তাহলে এত ঢাকঢোল পেটানোর দরকার কী? পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের ভাষ্য, ‘এর আগে গৃহীত বিভিন্ন খাতভিত্তিক পরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বন্যা মোকাবিলা, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য দেশে অসংখ্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। এ স্থাপনাগুলো কার্যকর রাখা ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ অপরিহার্য ছিল। পরিকল্পনায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ থাকার কারণে প্রয়োজনীয় মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

স্থাপনাগুলোর সর্বোত্তম কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অপরিহার্য মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। এই মহাপরিকল্পনায় এর আগে নির্মিত ও নির্মিতব্য স্থাপনাগুলো সময়ে-সময়ে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এতে নতুন স্থাপনা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের তুলনায় অনেক কম খরচে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মাধ্যমে স্থাপনাগুলো থেকে দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর প্রতিরক্ষা ও সুফল পাওয়া সম্ভব হবে। এক প্রকল্পের টাকায় তৈরি স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের জন্য আরেক প্রকল্প তৈরি কি জোড়াতালির উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করে না?

মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন আর ঝুঁকি হ্রাসের জন্য যদি কোনো স্থাপনা তৈরি হয়, তবে তা মানুষই রক্ষণাবেক্ষণ করবে নিজেদের স্বার্থে। যেমন করছে ভোলার চরফ্যাশনের বাঁধবাসী। রক্ষণাবেক্ষণে সরকারের এক পয়সা খরচ নেই, বাঁধ দিব্যি টিকে আছে। এটাই উন্নয়ন। বাইরে থেকে কেউ এসে এই বাঁধ বাঁধেনি। স্থানীয় মানুষ, স্থানীয় সরকার, গণসংগঠন আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সম্মিলিত এই সার্থক আর সাশ্রয়ী প্রচেষ্টা আমরা অনুসরণ করি না কেন? বদ্বীপ ব্যবস্থাপনায় বদ্বীপের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা আহরণের আর তাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ শতবর্ষী পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেওয়া দরকার। নদীতীর সংরক্ষণে কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও গাইবান্ধার গ্রামের মানুষের কম খরচের টেকসই ব্যবস্থা কি কোনো বিবেচনার দাবি রাখে না?
মানুষের সম্পৃক্ততা বলতে ২৫ মন্ত্রণালয়ের ২৫ ফোকাল পারসন আর ২৫ জন গবেষক কাম বিজ্ঞানীর ৫ হাজার টাকার হাজিরা নয়। এখন পর্যন্ত কজন মানুষের কাছে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি, যাদের জীবন-জীবিকার পরবর্তী ছবি আঁকবে আমাদের এই পরিকল্পনা?

নেদারল্যান্ডসের বদ্বীপ পরিকল্পনার আলোকে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনাটি প্রণীত হয়েছে। সন্দেহ নেই নেদারল্যান্ডসের জন্য খুবই কার্যকরী এক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আর রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা তাদের আছে। কিন্তু দুই দেশের বাস্তবতাতেও ফারাক অনেক। নদীমাতৃক হলেও নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক জীবনধারা এক নয়। সে দেশের উপকূলে বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ নেই। বিস্তৃত উপকূল অসংখ্য ড্যাম ও ডাইক দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। এই ডাইকগুলো দিয়ে সাগর থেকে ভূমি উদ্ধার করা হয়েছে, যা দেশটির মোট আয়তনের ৩ ভাগের প্রায় ১ ভাগ; অর্থাৎ দেশটির ১-৩ ভাগ সমুদ্র সমতলের নিচে! ডাইকগুলো সমতলে লোনা পানির আগ্রাসন এবং স্থায়ী বন্যা প্রতিবন্ধক। এখানে ধান চাষ একেবারেই হয় না, খাদ্যাভ্যাস স্বল্প পানিনির্ভর কৃষিজাত গম, ভুট্টা, যব, আলু, দুধজাতীয় পণ্য (চিজ অ্যান্ড ব্রেড) ইত্যাদি। দেশটির বিস্তৃত মধ্যাঞ্চল শুধুই গবাদিপশুর সুবিশাল চারণভূমি। পুরো দেশের সমতলই কৃত্রিম খালের জটে এনে স্বল্প পানিনির্ভর কৃষিজাতের চাষ করা হয়। কাজেই সে দেশের ইঞ্জিনিয়ার-বিজ্ঞানীরা যতটা না শেখাবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি শিখবেন।

উজানের দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন আদৌ কতটা সম্ভব, তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। গত বছর (৯ নভেম্বর ২০১৭) ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এবং পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ শীর্ষক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানের সহযোগিতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে সাহস করে বলেই ফেলেন, অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনার পাশাপাশি উজানের দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাঁদের মতে, বদ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উজানের নদীর বিস্তর তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন।

নেদারল্যান্ডসের কারিগরি দলের প্রথম খসড়ায় বদ্বীপ পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যগুলো এভাবে লেখা হয়েছিল: ১. বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; ২. পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা ও পানির পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি করা; ৩. সমন্বিত ও টেকসই নদী ও নদীমোহনা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা; ৪. জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং সেগুলোর যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা; ৫. অন্তঃদেশীয় ও আন্তদেশীয় পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও ন্যায়সংগত সুশাসন গড়ে তোলা এবং ৬. ভূমি ও পানিসম্পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করা। সুশাসনের বিষয় ৫ নম্বরে লেখা হলেও এটিই প্রধান শর্ত। নেদারল্যান্ডসের সফলতার জাদুকাঠি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। বেসরকারি খাতকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশের মাটি বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মতো বিবেকহীন বাতচিতের সুযোগ সেখানে নেই।

গওহার নঈম ওয়ারা, লেখক ও গবেষক