জনসংস্কৃতি

বজরঙ্গি ভাইজানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

.

গোটা দক্ষিণ এশিয়া এখন বজরঙ্গি ভাইজান-জ্বরে কাঁপছে। এমনকি পাকিস্তানের সিনেমা হলেও নাকি এ ছবি দেখতে ভিড় করছে অসংখ্য মানুষ। আবার একই সময়ে টুইটারে একটি বিশেষ হ্যাশট্যাগ দিয়ে এ ছবির নিন্দাও করছে অনেক পাকিস্তানি। হ্যাশট্যাগটি হলো #BollywoodPoisoningPak, যাকে বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘বলিউড পাকিস্তানকে বিষাক্ত করে ফেলছে!’ পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে নিটোল ভালোবাসার একটা ছবি কীভাবে পাকিস্তানকে বিষাক্ত করে ফেলছে, সে বিষয়ে অবশ্য বিশদ কোনো ব্যাখ্যা ওসব টুইটারে নেই। তবে সমাজের ওপর চলচ্চিত্রের যে বেশ অনেকটা প্রভাব আছে বা থাকতে পারে, এ কথা আজকাল অনেকেই মানেন।
সেটা না হয় মানা গেল, কিন্তু চলচ্চিত্রের ওপর ভর করে সমাজ বিশ্লেষণ করতে যাওয়া কতখানি যুক্তিযুক্ত? চলচ্চিত্র, বিশেষ করে জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্র কি সমাজের দর্পণ? এটা নিয়ে নানা রকম মতামত আছে। সেগুলো আমলে নিলে বলতে হয় যে এসব চলচ্চিত্র সমাজের ঠিক সৎ বা সহি পরিবেশন নয়। তার সঙ্গে নানা রকম রাজনীতি-সংস্কৃতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা-অভিলাষের মিশেল আছে। সেই অর্থে কোনো শিল্পমাধ্যমই সমাজকে সৎ কিংবা সহিভাবে পরিবেশন করতে পারে না। সেটা সম্ভবত শিল্পের কাজও নয়।
কাহিনি যাই-ই হোক, বজরঙ্গি ভাইজান চলচ্চিত্রটিকে আমরা নিশ্চয়ই বর্তমান পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের বাস্তব বিবরণ হিসেবে পাঠ করছি না; বরং একে ভারতের পাকিস্তান তথা প্রতিবেশী রাষ্ট্রবিষয়ক অভিলাষের রূপরেখা হিসেবে পাঠ করা যেতে পারে। এটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অভিলাষ দিয়ে ভারতের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত হবে। ছবিটির জনপ্রিয় হওয়া থেকে এই আভাস পাওয়া যায়।
পাকিস্তানকে ভারত তার রুপালি পর্দায় যেভাবে মোকাবিলা বা প্রদর্শন করে, তাকে মোটামুটিভাবে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। দ্বিতীয় পর্বের কথা আগে বলি। মুখ্যত, বীর-জারা (২০০৪) নামের চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তানের রুপালি পর্দার রাজনীতি দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করে। অবশ্য কোনো কোনো পাকিস্তানি সিনে-সমালোচকের দাবি, বীর-জারা স্রেফ পাকিস্তানি ব্লকবাস্টার সিনেমা তেরে পেয়ার মের (২০০০) অনুকরণ। পাকিস্তানি ছবিটা দেখা হয়নি, তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যা জানা গেল তা হলো বীর-জারার মতো তেরে পেয়ার মে ছবিতেও আন্তসীমান্ত ও আন্তধর্ম প্রেম মুখ্য হয়ে উঠেছে। ভারতের ছবিতে যেখানে ভারতীয় শিখ যুবকের সঙ্গে পাকিস্তানি মুসলিম যুবতীর প্রেমের গল্প বলে, পাকিস্তানি ছবিটা বলে পাকিস্তানি মুসলিম যুবকের সঙ্গে ভারতীয় শিখ যুবতীর প্রেমের কাহিনি। দুটি নমুনা থেকে কোনোরকম সাধারণীকরণ করা হয়তো মুশকিল। কিন্তু এটা অবশ্যই কৌতূহল জাগায় যে এ দুটি আন্তসীমান্ত প্রেমকাহিনিতে হিন্দু-মুসলিম সরাসরি যোগাযোগে যাচ্ছে না, বরং অনেকখানি হিন্দু বাতাবরণে পরিবেশিত শিখ আইডেনটিটি বা আত্মপরিচয় বদলি দায়িত্ব পালন করছে। ভারতের বীর-জারাতে যেমন, পাকিস্তানের তেরে পেয়ার মেতে তেমনই। ফলে এই শিখ অনুপ্রবেশে দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসী হিসেবে আপনার পাঞ্জাবের কথা মনে পড়তে বাধ্য।
প্রথম পর্বে এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধটা আরও সরাসরি ছিল। স্মরণ করতে পারেন কিছু ছবির কথা: গাদ্দার, আউর এক প্রেম কাহানি, মিশন কাশ্মীর, বর্ডার, সরফরাজ ইত্যাদি। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধংদেহী প্রেক্ষাপটে বানানো টান টান জাতীয়তাবাদী উত্তেজনার ছবি। পাকিস্তানের ছবিপাড়ায়ও অনুরূপ নমুনা আছে। এই পর্বের ফিল্মি জাতীয়তাবাদ মোটামুটিভাবে সানি দেওল মার্কা—অপরোক্ষ, পেশিবহুল, সহিংস এবং ‘অপর’কে নির্বিচারে ভিলেনের মতো করেই ভাবে।
বজরঙ্গি ভাইজান-এর ন্যারেটিভ সে তুলনায় অনেক কুশলী। পাকিস্তানি বোবা বালিকা মায়ের সঙ্গে ভারতে ভ্রমণ করতে
এসে ট্রেন থেকে হারিয়ে যায়। আলাভোলা বজরঙ্গি অর্থাৎ হনুমান-পূজারি ভারতীয় হিন্দু যুবক সালমান খান তাকে পায়, কিন্তু বোবা হওয়ার কারণে মেয়েটির হদিস বের করা সম্ভব হয় না। একপর্যায়ে জানা যায়, মেয়েটি পাকিস্তানি। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় পাকিস্তানের দূতাবাস ভিসা দেয় না। ফলে ভারতীয় বজরঙ্গি বিনা ভিসাতেই মেয়েটিকে নিয়ে পাকিস্তানে রওনা দেয়। সেই যাত্রায় তাকে সহায়তা করে এক পাকিস্তানি ফ্রিল্যান্স টিভি সাংবাদিক। শেষমেশ মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়, কিন্তু বজরঙ্গি আটকা পড়ে পাকিস্তান পুলিশের হাতে। শেষে অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে ওই পাকিস্তানি সাংবাদিক বজরঙ্গি ভাইজানের ব্যাপারে পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলে। অবশেষে ছাড়া পেয়ে দেশে ফিরে আসে পাকিস্তানিদের বজরঙ্গি ভাইজান।
পাকিস্তানকে মোকাবিলায় যারা এর আগে বলিউডের সানি দেওলীয় পদ্ধতির গ্রাহক ছিল না, বজরঙ্গি ভাইজান ছবিটি এমন অনেকেরই চাহিদা পূরণ করেছে দেখা গেল। তাদের অভিমত, পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার কোনো বাসনা এই ছবিতে ফুটে ওঠেনি। অর্থাৎ, এই ছবি পাকিস্তানের জাতিগত ভাবমূর্তিতে কোনোরকম চোরাগোপ্তা হামলা করে না। বরং যথাসম্ভব সহমর্মী থাকার চেষ্টা করে। বীর-জারায় যেখানে জারার পাকিস্তানি এক পাণিপ্রার্থীর প্রতিহিংসার কারণে বীরকে প্রায় দুই যুগ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকতে হলো তুলনায় বজরঙ্গি পাকিস্তানে কেবল একটা ইন্টারোগেশন সেল ছাড়া আর তেমন কিছুরই মুখোমুখি হলো না। এবং সেটা অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পরেও! এই পর্বে এসে ভারত পাকিস্তানে তার সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক এজেন্সিগুলোও খতিয়ে দেখেছে। বীর-জারায় আমরা একজন নারী আইনজীবীকে পেয়েছিলাম, যে এই প্রেমিক যুগলের মিলন ঘটিয়েছিল; বজরঙ্গিতে পাই একজন সাংবাদিককে। তারা পাকিস্তানের ভারতীয় বিবেক হিসেবে কাজ করে। ফলে পর্দায় তাদের উপস্থিতি সাংঘাতিক সরব।
সাম্প্রতিক কালে রুপালি পর্দায় পাকিস্তানকে মোকাবিলায় সানি দেওলীয় ড্যাশিং পদ্ধতির এস্তেমাল করতে চাইছে না ভারত। বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। হঠাৎ করে সুপারপাওয়ার ভারত একসময়ের নিউক্লিয়ার পাওয়ার বর্তমানে টালমাটাল পাকিস্তানের এমন আলাভোলা বজরঙ্গি ভাই হতে চায় কেন? এই বিদ্বেষ আর সহিংসতার রাজনীতির কারণে পাকিস্তানের খাল বেয়ে আইএসের কুমির ভারত পর্যন্ত চলে আসতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে? বিশেষ করে ইরাক-সিরিয়া-আফগানবাহিত চরমপন্থার বর্তমান যে অবস্থা, তাকে আমদানি কিংবা মোকাবিলা করতে সম্ভবত কোনো জাতিরাষ্ট্রই চাইবে না। ভারত তো নয়ই।
ফলে এই বজরঙ্গি ভাই-ই বর্তমানের পাকিস্তানকে প্রদেয় ভারতের ঈপ্সিত আত্মপরিচয়। পাকিস্তানকে ভালোবাসে সে, মিথ্যা বলে না, বিপন্নকে ফেলে যেতে পারে না, এমনকি কোনোরকম যুদ্ধে নামারও পাঁয়তারা করে না। ভুলে যান যুদ্ধংদেহী সানি দেওলের কথা, কাশ্মীরে গত এক দশকে ভারতীয় বাহিনীর হাতে নিহত অসংখ্য মানুষের কথা! আত্মপরিচয় জিনিসটা তো পাথরে খোদাই করা কিছু নয় যে নানাভাবে তাকে বানিয়ে তোলা যায়। দেখবেন, আপনার চেতনার রঙেই পান্না সবুজ হয়ে উঠবে! জনসংস্কৃতিতে এমন নমুনা বিস্তর। ভারতের চলচ্চিত্রে এই প্রবণতা তো আরও পুরোনো। স্রেফ জাতিগত অভিলাষের ফিকশনকে ঐতিহাসিক কাঠামোতে পরিবেশন করার কাজ সে আরও আগেই করে এসেছে। ১৯৪২ আ লাভ স্টোরি আর লগন ছবি দুটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের জন্য এটুকু ইশারাই কাফি!
বজরঙ্গি পাকিস্তানের যে মাসুম আত্মাটিকে খোঁজে, তার চেহারা কেমন? অতি সুন্দর সে, প্রায় ব্রাহ্মণদের মতো। কিন্তু বোবা, কথা বলতে পারে না। তার অব্যক্ত মুখে ভাষা ফোটাতে হবে। জীবন দিয়ে হলেও তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতিকে অগ্রাহ্য করতে হবে। আর সেটা সৈনিকের মতো যেমন নয়, চোরের মতোও নয়। সহজ-স্বাভাবিক অবৈধ অনুপ্রবেশ, যার পেছনে একটা শক্তিশালী নৈতিক বিবৃতিও থাকবে। ফলে বজরঙ্গি ভাই ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া পাকিস্তানে গিয়েও নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান থাকে। তদুপরি, পাকিস্তানের ‘নিষ্পাপ’ সত্তাটিকে ‘নিপীড়ক’ সত্তাটির হাত থেকে রক্ষা করার দায়ও ভারতের, তথা বজরঙ্গির। ফলে পাকিস্তান পুলিশের কাছেও এই হারিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি বাচ্চাটিকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিত হওয়ার অবকাশ নেই। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে সাম্প্রতিক কালে একক পরাশক্তি হয়ে যাওয়া ভারতের পক্ষে এর চেয়ে শ্রেয়তর করণীয় আর কী থাকতে পারে?
অন্যদিকে ভাবুন, ক্রমাগত আত্মঘাতী বোমায় ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়ে একদার প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান বলিউডের সানি দেওল–মার্কা কৌশলকে কীভাবে বেকার বানিয়ে দিয়েছে! বর্ডারে আর কাশ্মীরে ভারতের এত বাহাদুরির প্রয়োজনও বুঝি ফুরিয়েছে। দিন বদলেছে অনেক। চাইলে এখন প্রতিবেশীদের সীমানা দিয়ে ঢুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী পলাতকদের ধাওয়া করে ধরে আনা যায়। বজরঙ্গি নিশ্চয়ই ফেলানীর লাশের মতো সীমানার কাঁটাতারে ঝুলে থাকবে না! অপরাপর রাষ্ট্রের জন্য যা অলঙ্ঘ্য কাঁটাতার, ‘ভাইজান’-এর জন্য তাই-ই খুল যা সিমসিম! আঞ্চলিক সন্ত্রাস দমন ও অপরাপর পবিত্র অজুহাতগুলো তো তৈরিই আছে।
বজরঙ্গি ভাইজান পাকিস্তান তথা দক্ষিণ এশিয়াকে ভারতের এই বার্তাটুকুই দেয়। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নিঃশর্ত আন্তরাষ্ট্রিক চলাচল ছাড়া ভারতের পক্ষে এই অঞ্চলে একচ্ছত্র পরাশক্তি হয়ে থাকা মুশকিল। পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগহীন থাকা আরও বিপদের, বরং নানাবিধ অজুহাতে পাকিস্তানকে নজরে রাখা তার জন্য বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার অন্যতম শর্ত। ‘ভালো’ পাকিস্তানকে ‘খারাপ’ পাকিস্তান থেকে বাঁচিয়ে রেখে বাড়ি পৌঁছে দেওয়াও ‘ভাইজান’ হিসেবে তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক নই, জনসংস্কৃতির পাঠক মাত্র। এই লেখা ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ তার জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ দিয়ে সমর্থিত। জনসংস্কৃতি নানা অর্থে জনমানসেরই ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। সেই জায়গা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ‘ভাইজান’ ভারতের ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক কৌশল সম্পর্কে এ রকম একটি আগাম ধারণাই দেয় বলিউড ফিল্ম বজরঙ্গি ভাইজান।
সুমন রহমান: কবি, কথাসাহিত্যিক ও জনসংস্কৃতির বিশ্লেষক। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের গণমাধ্যম অধ্যয়ন ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।