প্রায় অসাধ্যই সাধন করলেন বঙ্গজ কমিউনিস্টরা। সিপিএমের কট্টর ‘কেরালা লবি’কে হারিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতার অনুমোদন ছিনিয়ে এই প্রথম তাঁরা ‘বেঙ্গল লাইন’কে এক অনাস্বাদিত জয় এনে দিলেন। এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনও অতঃপর পেয়ে গেল অন্য ধরনের গুরুত্ব।
সিপিএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা বেশ কিছুদিন ধরেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে তৃণমূল কংগ্রেসের মোকাবিলা তাঁদের তো নয়ই, কারও একার পক্ষেই করা সম্ভব নয়। তৃণমূল কংগ্রেসের ‘দৌরাত্ম্যে’ রাজ্যে যাদের ‘নাভিশ্বাস’ উঠেছে, তাদের সবার হাত ধরাও সিপিএমের পক্ষে সম্ভব নয়। বেঁচে থাকা ও টিকে থাকার একমাত্র উপায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট। কিন্তু সেখানেও আদর্শ ও নীতিগত নানান বাধা। একই হাল রাজ্য কংগ্রেসেরও। যে সিপিএমের অত্যাচারে তারা একটানা ৩৪ বছর রক্তাক্ত হয়েছে, তাদেরই হাত ধরে কী করে বাঁচার কথা ভাবা যায়? অথচ ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু রাজ্য কংগ্রেসের কাছে সেটাই শেষ পাড়ানির কড়ি। কারণ, রাজ্যের চতুর্থ শক্তি বিজেপি দুই দলের কাছেই অচ্ছুত। অতএব অতীত ভুলে সেই অবলম্বনকেই আঁকড়ে ধরার অমোঘ ও একমাত্র তাগিদ দুই দলের রাজ্য নেতৃত্বকে কাছাকাছি টেনে আনে। বাকি ছিল শুধু শেষ বাধা টপকানো। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির দুই দিনের বৈঠকে বঙ্গজ কমিউনিস্টরা সেই অসাধ্যই সাধন করলেন।
কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি জোটের অনুমোদন না দিলেও কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়ে দিল, পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের স্বার্থে সিপিএম সব ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গেই কথা বলবে, সমঝোতার চেষ্টা করবে। কংগ্রেসকে সিপিএম যে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে মনে করে, সে কথা দলীয় সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর জানিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হননি।
প্রকাশ কারাটের আমলে যা ছিল স্বপ্নাতীত, সীতারাম ইয়েচুরির রাজত্বে তা সম্ভব হলো। প্রকাশের তুলনায় সীতারাম বরাবরই বেশি ‘বাস্তববাদী’। তিনি ‘নীতিবাগীশ ও ঘরকুনো’ নন। রাজনীতির আঙিনায় খোলামেলা মেলামেশায় ক্লান্তিহীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে বঙ্গজ কমিউনিস্টদের ‘যন্ত্রণা’ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তা ছাড়া, কেরালা ও ত্রিপুরার ২২টি লোকসভা আসনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনকে বলি দেওয়ার যুক্তিও তিনি মেনে নিতে পারেননি। নীতির কেন্দ্রীকরণের দরুন পশ্চিমবঙ্গ থেকে দলটাকে মুছে দিতে তাঁর মন সায় দেয়নি। ফলে নীতির বিকেন্দ্রীকরণের দাবি তিনি মেনে নিয়েছেন। মোটামুটি যা আভাস, তাতে এই পথেরই পথিক হতে চলছে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও। অর্থাৎ বিয়ে না করে পশ্চিমবঙ্গে ঘর বাঁধতেই চলেছে কংগ্রেস ও সিপিএম।
প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা প্রায় সমস্বরেই সিপিএমের সঙ্গে জোট করার প্রয়োজনীয়তার কথা রাহুল ও সোনিয়া গান্ধীকে বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস হাইকমান্ড আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চায়নি। না চাওয়ার কারণ সিপিএমের অতীত। ১৯৯৬ সালে এই সিপিএমই জ্যোতি বসুকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। জ্যোতি বসু পরবর্তীকালে নিজেই বলেছিলেন, সেটা ছিল তাঁর দলের পক্ষে এক ‘ঐতিহাসিক ভুল’। প্রকাশ গোঁ ধরায় পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে ২০০৮ সালে ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সিপিএম। এই নীতিপরায়ণতা শেষ পর্যন্ত জোটের পথে অন্তরায় হয় কি না, সেটাই রাহুল-সোনিয়া দেখে নিতে চেয়েছেন। আগ বাড়িয়ে কোনো রায় তাই তাঁরা দিতে চাননি। এখন সিপিএমের সবুজসংকেতের পর কংগ্রেসও কৌশলে জোটের পথ প্রশস্ত করবে বলেই সব মহলের ধারণা। যা করার তা খুল্লামখুল্লা নয়, কৌশলেই করতে হবে। কারণ, কেরালা ও ত্রিপুরার তীব্র আপত্তি। এই সেদিন ত্রিপুরায় অমরাপুরের উপনির্বাচনে কংগ্রেস নেমে গেছে দুই থেকে চার নম্বরে। দুইয়ে উঠে এসেছে বিজেপি ক্ষুব্ধ কংগ্রেসিদের সমর্থনে।
সিপিএম-কংগ্রেসের এই মাখামাখি মমতার কাছে কতখানি চিন্তার? কংগ্রেস-সিপিএম ‘জোট’ কি মমতার পায়ের তলার জমি ঝুরঝুরে করে দিতে পারবে? উত্তরটা আপাতত খুবই সহজ। এই জোট মমতার মসনদ এবার অন্তত টলাতে পারবে না। যদিও তাঁকে কিছুটা চিন্তায় রাখবে।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে যে পরিস্থিতি ছিল, ২০১৬ সালের পরিস্থিতি কিন্তু তেমন নয়। পাঁচ বছর আগে সিপিএমকে হঠাতে রাজ্যে একটা রংধনু জোট তৈরি হয়েছিল। মমতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেই জোটে শামিল হয়েছিল কংগ্রেস, বিক্ষুব্ধ সিপিএম ও অন্য বামপন্থীরা, মাওবাদীসহ অতি বাম শক্তি, বিজেপি, নাগরিক সমাজ ও অরাজনৈতিক সব সংগঠন। লক্ষ্য, সিপিএমের শাসন শেষ করা। পাঁচ বছর পর আজ মমতার জৌলুশ কিছুটা ফিকে হলেও তাঁকে সরাতে সর্বস্তরে সেই অদম্য বাসনার জন্ম কিন্তু হয়নি। এখনো রাজ্যে সাধারণ মানুষের কাছে মমতা জনপ্রিয়। প্রশাসনকে তিনি জেলায় জেলায় নিয়ে গেছেন। জেলার মানুষ অনবরত তাঁকে দেখতে পাচ্ছে। পৌঁছাতে পারছে। বুঝতে পারছে তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গজদন্ত মিনারে বসে রাজ্য শাসন করছেন না। প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি যে নেই, তা নয়। কিন্তু মানুষের হাল এখনো ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি-খাওয়া হয়নি। বরং একটু টাল খেলেও বিশ্বাস এখনো অটল।
তা ছাড়া, সিপিএমের বিরুদ্ধে যে রকম সর্বস্তরে জোট গড়ে উঠেছিল, মমতার বিরুদ্ধে তেমন জোট গড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ বিজেপি। বিজেপির হাত ধরা এখন আর তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষেও সম্ভব নয়। রাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলমান তার কারণ। কাজেই নিছক পাটিগণিতের অঙ্কেও মমতার আসন হারানোর কোনো কারণ এবারের ভোটে অন্তত নেই। তা ছাড়া, রাজ্যে আর কোনো দলেই মমতার মতো একজনও নেতা বা নেত্রী নেই, যাঁকে কেন্দ্র করে একটা বিরোধী জোট গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ কংগ্রেস-সিপিএম হাত ধরাধরি করলেও টেনিসের ভাষায় বলা যায়, এখন পর্যন্ত ‘অ্যাডভান্টেজ মমতা’।
তাহলে কি ধরে নিতে হবে মমতার কপালে চিন্তার কোনো ভাঁজ নেই? কিংবা হারানো সম্ভব নয় জেনেও কেন দুই বিপরীতধর্মী দল পরস্পরের সান্নিধ্য পেতে এতখানি মুখিয়ে?
মমতার চিন্তা বিরোধী ভোটের দুই শিবিরের কাছাকাছি আসা নিয়ে। বামপন্থীদের ভোট নেই নেই করেও এখনো ৩০ শতাংশের বেশি। কংগ্রেসের ১০ শতাংশের কিছু কম। সমর্থন একই থাকলে দুইয়ের প্রাপ্ত ভোট ৪০ শতাংশ ছাড়াবে। আসন প্রাপ্তির নিরিখে তা কতখানি, সে কথা বলা ভোটের হারের নিরিখে সম্ভব নয়। ১৯৮৭ সালে ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েও কংগ্রেস মাত্র ৪২টি আসন পেয়েছিল। এবারেও যখন জোট নিয়ে রাজ্য সরগরম, তখন নেওয়া এক জনমত সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জোট হলে কংগ্রেস-সিপিএমের প্রাপ্ত ভোট হবে ৪৩ শতাংশ, তৃণমূল কংগ্রেসের ৪৪ শতাংশ। কিন্তু মাত্র ১ শতাংশের হেরফেরেও তৃণমূল ১৮২ আসন নিয়ে সরকার গড়বে।
তাহলে কেন এত সান্নিধ্য-প্রত্যাশা? কংগ্রেস-সিপিএম মনে করছে, যৌথভাবে তারা তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ রুখতে পারবে। ক্রমেই এক শক্তিশালী বিকল্প হয়ে উঠবে। তৃণমূলের ‘বীতশ্রদ্ধ’ নেতারা জোটে ভিড়বেন। পুলিশ-প্রশাসনও কিছুটা সংযত হবে।
এখনো সোনিয়া-রাহুল মুখ খোলেননি। খুললেও ‘অ্যাডভান্টেজ’ এখনো মমতারই। তাঁর কপালে তাই দুশ্চিন্তার কোনো গভীর ভাঁজ এখনো পড়েনি।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।