বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা এবং একটি সংশ্লিষ্ট কাহিনি

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছিলেন এবিএম মূসা। শোকাবহ এই মাসে পাঠকের জন্য দেওয়া হলো তাঁর একটি বঙ্গবন্ধু-স্মৃতি, বঙ্গবন্ধুর বিচিত্র স্মৃতি নিয়ে লেখা প্রথমা প্রকাশন থেকে বেরোনো তাঁর বই ‘মুজিব ভাই’ থেকে।

একটি জাতি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করল, অথচ সেই যুদ্ধের যিনি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, সুপ্রিম কমান্ডার অব দি আর্মড ফোর্সেস, তিনি অনুপস্থিত। কয়েক হাজার মাইল দূরে থেকে তিনি শুধু অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এমনটি শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটেনি, আরও অনেক দেশের জনগণের পরাধীনতা, ঔপনিবেশিকতা ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি ঘটেছে তাদের মহানায়কের দূরে অবস্থান সত্ত্বেও। লেনিন বসে ছিলেন সুদূর জার্মানিতে, রাশিয়া জার শাসনমুক্ত হলো। নেলসন ম্যান্ডেলা একটি নির্জন দ্বীপে বন্দী, দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতশাসনের অবসান ঘটাল তাঁর অনুসারীরা। জেমো কেনিয়াত্তা দূর থেকে কেনিয়ার ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। নরোদম সিহানুক চীনে বসে পরিচালনা করেছেন কাম্পুচিয়া তথা কম্বোডিয়ায় মার্কিনবিরোধী যুদ্ধ। ইরানের শাহের পতন ঘটিয়েছিলেন খোমেনির অনুসারীরা, যিনি স্বয়ং তখন প্যারিসে বাস করছিলেন। তাঁর ক্যাসেটে বদ্ধ বাণী শুধু ইরানের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি সম্বল করে বাঙালি যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করল। একটি মুজিবের কণ্ঠ লক্ষ মুজিবের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিস্তৃত রণক্ষেত্র আর অবরুদ্ধ বাংলাদেশ জুড়ে।
তবে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। রাশিয়ানরা জানত লেনিন ফিরবেন। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা ম্যান্ডেলার জীবনহানি নিয়ে শঙ্কিত ছিল না। সিহানুক চীনে নিশ্চিত ও আয়েশি জীবন যাপন করছিলেন। প্যারিসে খোমেনি নিরাপদে ছিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব পাকিস্তানি জেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। তাঁর দেশবাসী জানত না তিনি বেঁচে আছেন কি না, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফিরে আসবেন কি না। অন্য যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের ক্ষেত্রে এই অনিশ্চয়তা ছিল না। সুতরাং, তাঁরা ফিরে আসার পর মুক্ত দেশ কীভাবে শাসিত হবে, তা নিয়ে ভাবনা ছিল না। কিন্তু শেখ মুজিব যদি স্বাধীন বাংলায় না ফিরতেন, তাহলে কী হতো দেশটির?
কথাটি দুইভাবে বলা যায়। এক. বঙ্গবন্ধু যদি ফিরে না আসতেন। দুই. বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলে অনেক কিছুই সম্ভব হয়েছে, আবার অনেক ঘটনা ঘটতে পারেনি। প্রথম বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, লিখেছেন এবং বিশ্বাসও করেন যে বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে প্রথমত বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এত তাড়াতাড়ি যেত না। তারা চাইলেও যেতে দেওয়া হতো না। কারও মতে, মুজিববাহিনী আর মুজিবনগর ফেরত প্রবাসী সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করত, দেশে গৃহযুদ্ধ বেধে যেত। কঙ্গো, সোমালিয়া বা আফগানিস্তানের মতো গোষ্ঠীগত না হলেও দলগত সংঘর্ষ লেগে থাকত। সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সামর্থ্য দেশে আসা প্রবাসী সরকারের ছিল না। এমনকি সরকারের মধ্যে ‘অন্তর্দ্বন্দ্ব বিরাজ করছিল’, দেশ শাসনের জন্য প্রয়োজনীয় মনোবল বা প্রভাব প্রতিষ্ঠার ক্ষমতার অভাব ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, বাহাত্তরেই তেমন কিছু ঘটতে পারত। বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে কী যে হতো, তৎকালীন দেশের অবস্থা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের ছাড়া অন্য কাউকে তা বোঝানো যাবে না। সহজ কথায়, বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে অনেক কিছুই হতো, অনেক অঘটন ঘটত, যা রোধ করার ক্ষমতা অন্য কারোর ছিল না। মুজিবনগর সরকারের চারদিকে সুরক্ষা বন্ধন তৈরির জন্য ভারতীয় বাহিনীকে পাহারায় থাকতে হতো। এখন নতুন বাংলাদেশ ইরাক অথবা আফগানিস্তানও হতে পারত। ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেও বিদ্যমান অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত না। হয়তো সেই পরিস্থিতির অজুহাতে তারা থেকেই যেত অথবা তাদের থাকতে বলা হতো। বলা বাহুল্য, এসবই আমার পর্যবেক্ষণ, কোনো নির্দিষ্ট মতামত অথবা পরিস্থিতি-উত্তর গবেষণা নয়।
বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশকারী রাজাকার-আলবদররা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল আত্মগোপন করে, পালিয়ে বেঁচেছিল। এখন বোঝা যাচ্ছে, ঘাপটি মেরে বসেছিল পঁচাত্তরের অঘটনটি ঘটানোর জন্য। অভিজ্ঞ ও ঝানু রাজনীতিবিদ, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু কি তা বুঝতে পেরেছিলেন?
উপরিউক্ত যাবতীয় আলোচনা হচ্ছে একটি মূল বক্তব্যের পটভূমি। এ কথা তাদের অনেকে স্বীকার করে, প্রকাশ্যে না হলেও অন্তত ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তো বটেই। তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই স্বাধীনতাবিরোধীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়েছিল। এটা কি তাঁর রাজনৈতিক কোনো পদক্ষেপ, হৃদয়ের মাহাত্ম্য অথবা বদান্যতা? এ নিয়ে কেউ কেউ এখনো তির্যক মন্তব্য করে, এমনকি তাঁর আগমনে যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা চরম কৃতঘ্নের মতো তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধা দেখায়। বঙ্গবন্ধুর জীবন, কীর্তি, চরিত্রের বিভিন্ন দিক, সবশেষে তাঁর সরকার পরিচালনা ও দেশ শাসন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে, তাঁর চরিত্রহনন ঘটেছে। আবার তাঁকে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে দেবতা বা অতিমানব বানানোর প্রচেষ্টা হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের একটি মহান দিকের ওতপ্রোত সম্পর্ক নিয়ে কেউ আলোচনা করেননি। একজন সফল সংগঠক, একজন শক্তিমান জননেতা, অগণিত মানুষ আবেগ ও ভালোবাসা যাঁকে উজাড় করে দিয়েছে, সেই ব্যক্তিটির চরিত্রের মহান দিকটি নিয়ে আলোচনা হয়নি। অনুজ সাংবাদিক প্রয়াত শফিকুল আজিজ মুকুল দুঃখ করে একবার বলেছিলেন, এত শক্তিশালী আওয়ামী লেখকগোষ্ঠী, এত বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক সাহিত্যিক-সাংবাদিক, কেউ তো তাঁর চরিত্র ও জীবন পুরোপুরি বিশ্লেষণ করে আজও একটি বই, একটি পুস্তিকাও লেখেননি। তাঁর জীবন ঘিরে কত কিংবদন্তি, কত অন্তরঙ্গ কাহিনি রয়েছে, কেউ তা সংগ্রহ করেননি। তিনি নিজেও আত্মজীবনী বা স্মৃতিচারণামূলক কোনো লেখা লিখে যাননি। অবশ্য অতি সম্প্রতি তাঁর একটি অসমাপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে পূর্ণাঙ্গ মুজিবকে পাওয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এমনই একটি অন্তরঙ্গ কাহিনি বর্ণনা করার জন্য ১৯৭২ সালে তাঁর ফিরে আসা না-আসা নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা করলাম, যা হয়তো ভিন্ন কোনো প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু হতে পারত। মুজিব ভাইয়ের চরিত্রের সবচেয়ে মাধুর্যপূর্ণ দিকটি ছিল প্রতিটি পরিচিত মানুষ, যে-ই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছে, তার জন্য ছিল তাঁর আন্তরিক ভালোবাসা। তাঁর বাঙালি চরিত্র এবং দলের কর্মীদের সঙ্গে তাঁর আপন সম্পর্ক ও মধুর আচার-আচরণের সম্পূরক বলা যেতে পারে এই আন্তরিকতার প্রকাশগুলোকে। সেই আন্তরিকতা আর ব্যক্তিগত নিবিড়তার ছোঁয়া পেয়েছিল শত্রু-মিত্র নির্বিচারে সবাই। তবে তাদের মধ্যে সাংবাদিকেরা একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে ছিলেন।
স্নেহভাজন তৎকালীন দিল্লিস্থ বাংলাদেশের সংবাদদাতা আতাউস সামাদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই দিনটিতে লন্ডন থেকে ফেরার উড়োজাহাজে দিল্লি হয়ে ঢাকা এসেছিল। ঢাকায় এসে সামাদ বলেছিল, প্লেনে বসে বঙ্গবন্ধু সবার আগে, এমনকি আপন স্ত্রী-পুত্র-পরিবার, রাজনৈতিক সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনদের নয়, খোঁজ নিয়েছেন তাঁর পরিচিত ও তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠা সাংবাদিকদের। নাম ধরে প্রতিজনের খোঁজ করেছেন। বারবার শুধু জিজ্ঞেস করেছেন, বেঁচে আছেন তাঁদের সবাই? যাঁদের খোঁজ করেছেন, যাঁদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাঁরা যে সবাই পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে তাঁর সঙ্গে সব সময় মৈত্রীসুলভ আচরণ করেছেন, তা তো নয়। তাঁর চরিত্র হনন করেছেন অনেকে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নীতি-আদর্শের সমালোচনার বাইরেও তাঁর সম্পর্কে কখনো কখনো কুৎসাপূর্ণ মন্তব্য বেরিয়ে এসেছে তাঁদের কারও কারও লেখনী তথা টাইপরাইটার থেকে। অতীতের কতিপয় বিদ্বেষী ও কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তিগত ভূমিকার কারণে বাহাত্তরে তাঁদের অবস্থা কী হতে পারে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তা অনুমান করা দুরূহ ছিল না। তাই উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছেন কেমন আছেন তাঁরা। ‘মর্নিং নিউজ’ আর ‘পাসবান’-এর বাঙালি সাংবাদিকেরা? জানতে চেয়েছেন কোথায় ‘মর্নিং নিউজ’-এর এস জি এস বদরুদ্দিন, ‘জং’-এর নাদভি আর ‘পাসবান’-এর দেশনভি।
জানতে চেয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক বৈরীদের ভাগ্য, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাঁদের জন্য। তাঁদের কারও সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শত বৈরিতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত মধুর সম্পর্কের অনেক জানা-অজানা কাহিনি অনেকেরই রয়েছে? শাহ আজিজ পাকিস্তানের দালালির অভিযোগে বঙ্গবন্ধু ফেরার আগেই জেলে গিয়েছেন। গণহত্যার দায়ে ফরিদ আহমদ জনতার রোষের শিকার। দেশে ফেরার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর এই জেলবন্দী পুরোনো বন্ধুর পরিবারকে দেখভাল করেছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে চিরকালের রাজনৈতিক মতদ্বৈধতা ছিল, ব্যক্তিগত বৈরিতা ছিল না, শত্রুতা ছিল না। ১৯৭৩ সালে জেলে তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিত বঙ্গবন্ধু তাঁর শোকার্ত ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। এমনই আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এমনই আরও অনেক কাহিনি জেনেছি, নিজে ঘটতে দেখেছি। অথচ বঙ্গবন্ধু যে এদের নিষ্ঠুর গণহত্যার ভূমিকা মানেননি, তা নয়।
আপাতত রাজনৈতিক মহল ও প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্প্রীতিময় মধুর সম্পর্কের আলোচনা স্থগিত রাখলাম। কারণ, তখনকার বিদ্যমান অবস্থার বিপাকে তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের কিছুই করার ছিল না। ক্ষিপ্ত, প্রতিশোধস্পৃহায় মাতোয়ারা জনতার ক্রোধ ও প্রতিহিংসা গ্রহণে উন্মত্ত শহরে-গ্রামে-গঞ্জে ছড়ানো লক্ষ-কোটি বৃদ্ধা-প্রৌঢ়-যুবক নরনারীকে সামলানো তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ করেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত একটি সংবেদনশীলতার শুধু একটি কাহিনি বলব, যার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ফেরার অথবা ফিরে না আসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
কাহিনির যবনিকার উত্তোলন বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার দুই দিন পর। বঙ্গবন্ধু একদিন পুরোনো গণভবনে আমাকে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, সবাইকে দেখলাম, বদরুদ্দিন ভাই কোথায়?’ বদরুদ্দিন মানে, তৎকালীন পাকিস্তানি মালিকানার ট্রাস্টের পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’-এর সম্পাদক। পত্রিকাটি অহর্নিশ তাঁর কুৎসা গেয়েছে, আগরতলা মামলার সময় তাঁর ফাঁসি দাবি করেছে। এই সেই পত্রিকা, যার অফিস বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় জনগণ পুড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর সম্পর্কে অহর্নিশ বিষোদ্গারকারী সেই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গেও তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কমতি ছিল না। তাঁর নিরাপত্তা বিষয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে বললেন, ‘কোথায় আছেন বদরুদ্দিন ভাই? খুঁজে নিয়ে আয়। ভালো আছেন তো? কোনো অসুবিধায় নেই তো?’
বঙ্গবন্ধুর আদেশে বদরুদ্দিনকে খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম, লালমাটিয়ার একটি বাড়িতে আত্মগোপন করে আছেন তিনি। বহু কোশেশ করে দেখা করলাম। বললাম, ‘মুজিব ভাই আপনাকে খুঁজছেন। চলুন আমার সঙ্গে।’ বদরুদ্দিন ভাইয়ের চোখমুখ যেন ঝলসে উঠল, ‘ক্যায়া, শেখ সাব মুঝে বোলায়া, আই ক্যান গো টু হিম, সি হিম?’ নিয়ে এলাম তাঁকে গণভবনে, যেন দুই বৈরী নয়, যেন দুই বন্ধুর মিলন দেখলাম। বুকে জড়িয়ে ধরলেন, পাশে বসালেন। নেতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? আপনি কী করতে চান? কাঁহা যাতে চাহেঁ? কোনো বিপদে নেই তো?’ আবেগময় প্রশ্নগুলো শুনে বদরুদ্দিন আধো কান্না আধো খুশি মেশানো কণ্ঠে বললেন, ‘পাকিস্তানে যেতে চাই, মে আই লিভ ফর করাচি?’ বঙ্গবন্ধু একান্ত সচিব রফিকউল্লাহকে ডাকলেন, ‘বদরুদ্দিন ভাই যা চান, তা-ই করে দাও।’ উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ভারতের সঙ্গেও নৌ-স্থল-বিমান যোগাযোগ নেই। কিছু অবাঙালি গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত ও কাঠমান্ডু হয়ে তারপর পাকিস্তানে যাচ্ছেন।
তার পরের কাহিনি সংক্ষিপ্তভাবে বলা যাক। বদরুদ্দিন ভাইয়ের আরেকটি প্রার্থনা, আসাদ অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটি বিক্রি করবেন, সেই টাকাও তিনি সঙ্গে নিয়ে যাবেন। বাহাত্তরে সেই সময়ে একজন বিহারির এহেন একটি আবদার কেউ কল্পনাও করতে পারত না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন, তথাস্তু, তা-ই হবে।
আবার আমার কাঁধে চাপালেন এই অসম্ভব কাজটি সমাধান করার দায়িত্ব। বিহারিদের পরিত্যক্ত বাড়ি বিক্রি করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিশেষ অনুমতি দিলেন একটি আউট অব দ্য ওয়ে, বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগের নির্দেশ দিয়ে। ক্রেতা ঠিক হলো আতাউদ্দিন খান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরশাদের সামরিক শাসনামলে আতা খান বাড়িটি ক্রয়ে দুর্নীতি করেছেন বলে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সামরিক আদালত থেকে তাঁকে খালাসের জন্য সাক্ষী-সাবুদ জোগাড়ে আমাকে একই ধরনের ভূমিকা নিতে হয়েছিল। যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত সব ব্যবস্থা হলো। বঙ্গবন্ধুর সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরীর সহায়তায় সচিব আতা সাহেব বাড়ি কিনে যে টাকা দিয়েছিলেন, তা বিদেশি মুদ্রায় রূপান্তরিত করে বাইরে নেওয়ার অনুমতি দিয়ে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর (বর্তমানে প্রয়াত) হামিদুল্লাহ সাহেবকে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর বদরুদ্দিন স্বচ্ছন্দে নেপাল হয়ে পাকিস্তানে চলে গেলেন। জনাব বদরুদ্দিনের মতো আরও অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বদান্যতা, মহত্ত্বের বিশাল হৃদয়ের ছোঁয়া পেয়েছিলেন। এমনই অনেক কাহিনি রয়েছে। ছোট-বড়-মাঝারি সেসব কাহিনির জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলেই। বদরুদ্দিনের এটি নিছক কাহিনি নয়, একটি সিংহ-হৃদয়ের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের ছবিমাত্র। তখনকার পরিস্থিতিতে বিচিত্র ও ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা বটে। কারণ, বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার কয়েক দিন আগেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঢাকা স্টেডিয়ামে বদরুদ্দিনদের, পাকিস্তানপন্থীদের ভাগ্যে কী ঘটতে পারে, তা দেখিয়েছিলেন একজনকে প্রকাশ্যে খতম করে। দেশের তৎকালীন সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরাট ক্যানভাসে নয়, অনেকের মনের গহিন থেকে এসব কাহিনি লুপ্ত হয়ে গেছে।
পঁচাত্তরের অনেক বছর পর লাহোরে বদরুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আল্লাহর শোকর, শেখ সাহেব ফিরে এসেছিলেন। তাই তো বেঁচে আছি। এখনো বহাল তবিয়তে আছি।’ তারপরই মাথা থাবড়াতে থাকলেন, ‘ইয়ে ফেরেশতা কো তোমলোক খুন কিয়া?’