গাইবান্ধা মহকুমার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমরা থাকতাম তখন। আমার বয়স ৬-৭ বছর। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা ‘সারেন্ডার’ করেছে। শীতকাল। বিকেল হতে না–হতেই অন্ধকার আর কুয়াশা চরাচর ঢেকে দেয়। আমরা সন্ধ্যার পর রোজ বের হই। তরুণ, যুবক, কিশোর, বালক, আমাদের পাড়ায় যতজন আছে, সবাই। হাতে থাকে টর্চলাইট। আমরা মিছিল করতে করতে আলপথ খালবিল পার হয়ে আরেক পাড়ায় ঢুকি, সেখান থেকেও আরও মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা পুরো গ্রাম চক্কর দিই। আমাদের স্লোগান, জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।
তারপর একদিন, দিনের বেলা, আমার মেজ ভাই হাতে একটা রেডিও নিয়ে জ্যাঠার বড় কাঠের ঘরটা থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে থাকেন, বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিয়েছে। আমরা হইহই করে তাঁকে ঘিরে ধরি, রেডিওর খবর শোনার চেষ্টা করি। সবাই উল্লাস করতে থাকে। সবার চোখে আনন্দাশ্রু।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটায় ৪৮ বছর আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে।
একটু আগে ইউটিউবে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভিডিও দেখছিলাম। লন্ডনে তাঁর বিমান পৌঁছেছিল নির্ধারিত সময়ের আগে। ৮ জানুয়ারি হিথরো বিমানবন্দরে গ্রিনিচ সময় সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে। ভিডিওতে দেখা গেল, তিনি কালো কোট পরা, পাশে ড. কামাল হোসেন। বাঁ পায়ের ওপরে ডান পা তুলে তিনি তাঁর পাইপে অগ্নিসংযোগ করছেন। সেখান থেকে তিনি আসেন লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে। লন্ডন থেকে ফোনে কথা বলেন ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, বেগম মুজিব এবং দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে তিনি ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে দেখা করেন। আর বিরোধী নেতা হ্যারল্ড উইলসন হোটেলে এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করেন।
তাঁকে নিয়ে ব্রিটিশ বিমান প্রথমে দিল্লি আসে। বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রীরা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আর কূটনীতিকেরা উপস্থিত ছিলেন। তোপধ্বনি হয়, তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে দিল্লির প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসমাবেশে যোগ দেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইন্দিরা গান্ধীর হিন্দি বক্তৃতার পর বঙ্গবন্ধু যখন ইংরেজিতে শুধু সম্বোধন করতে শুরু করেছেন, জনতা চিৎকার করে ওঠে ‘জয় বাংলা’। জনতার জয় বাংলা, বাংলা বাংলা চিৎকারে বঙ্গবন্ধু মধুর হেসে একটুখানি থামেন, ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকান। তারপর বাংলায় ভাষণ দেওয়া শুরু করেন। তিনি ভারতের জনসাধারণ এবং ইন্দিরা গান্ধীকে কৃতজ্ঞতা জানান ‘বাংলার দুখী মানুষের’ পক্ষ থেকে।
‘বাংলার দুখী মানুষ’ এই কথাটা তিনি ১৯৭২–এর জানুয়ারিতে বলতে ভোলেননি। চিরটাকাল তাঁর এই ছিল স্বপ্ন, বাংলার দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। চিরটাকাল ছিল তাঁর এক সাধ...বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২, ১টা ৪১ মিনিটে তাঁর বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতীর্ণ হয়। লাখ লাখ মানুষ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে আকাশ–বাতাস মুখর করে তুলেছে। তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ বিমানের সিঁড়িতে উঠে গেট থেকে তাঁকে ফুলের মালা আর চোখের জল দিয়ে স্বাগত জানান। তাজউদ্দীনকে জড়িয়ে ধরে উভয় নেতা কাঁদতে থাকেন।
ওই সময় দেখা যায়, নিচে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান। আর রেসকোর্সে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন ধানমন্ডির একটা বাসায় তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার শুনছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনে এই দুজন মানুষের অবদান খুব বেশি। তাঁর পিতা সব সময় তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন, ছেলে জেলে গেলেও তিনি বড় মুখ করে বলেছেন, আমার ছেলে ন্যায়ের জন্য লড়াই করে জেলে গেছে। আর একজন হলেন, বেগম মুজিব। কূটনৈতিক লেখক কামরুদ্দীন আহমেদের রচনায় পাই, শেখ মুজিব শেখ মুজিব হতে পেরেছেন তাঁর স্ত্রীর জন্য। কোনো দিন কোনো অভিযোগ করেননি, বরং সব সময় সমর্থন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে এবং অনেক সংকটময় মুহূর্তে বেগম মুজিব তাঁকে দিয়েছেন সবচেয়ে সুন্দর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই কবিতাটিতেই সব কথা আসলে বলা আছে, অন্নদাশংকর রায়ের লেখা:
যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
এই কীর্তি হলো, তিনি হাজার বছরের বাঙালিকে প্রথম একটা রাষ্ট্র দিয়েছেন, দিয়েছেন স্বাধীনতা। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কথাটা খুবই প্রণিধানযোগ্য: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনুপস্থিত, যে সময়ে দুই অসম শক্তি এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু এবং শুধু বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন সেই প্রতীক...যার চারদিকে নিঃসহায় এক উদ্দেশ্যের সমর্থকেরা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল।...বঙ্গবন্ধু একাই ছিলেন সেই প্রতীক।
সেই প্রতীক মানুষ হয়ে ওঠাটার পেছনে ছিল অনেক যুগের সংগ্রাম। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেন, তারও আগে থেকে ছিল তাঁর সংগ্রামের সূচনা। স্বাধীনতার পর অন্নদাশংকর রায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশের আইডিয়াটা তাঁর মাথায় আসে সেই ১৯৪৭ থেকেই।
তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন করবেন, সে জন্য কী করা যায়, তার সবগুলো পথই তিনি অন্বেষণ করে গেছেন। প্রচণ্ড দেশপ্রেম, সততা, একাগ্রতা, আত্মত্যাগ, সাহস, মৃত্যুকে ভয় না পাওয়া, পরিশ্রম, লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা এবং লোভের ঊর্ধ্বে উঠতে পারা—এসব গুণ দিয়ে তিনি তাঁর লক্ষ্য অর্জন করেন। দেশ স্বাধীন করতে হলে সংগঠন দরকার হবে, গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট লাগবে, দেশের মানুষকে এক স্বপ্নে বিভোর এবং ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, তা
তিনি জানতেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি বললেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম আমার মৃত্যু আসে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না। এবং যাওয়ার সময় বলে যাব জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’
সেদিনই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন:
‘এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের যুবক যারা আছে তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ তোমাদের মোবারকবাদ জানাই তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।’
বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করে দিয়ে এই দেশকে সর্বক্ষেত্রে বিজয়ী করার অনন্ত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়ে গেছেন। আমরা সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে সামনে আরও বিপুল কর্মযজ্ঞ এবং কর্তব্য রয়েছে। এ দেশের দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। গরিব, দুখী সাধারণ মানুষের ঘরে স্বাধীনতার সুফল নিয়ে যেতে হবে। ‘এই সব বর্ণমালা নিতে হবে ভূমিহীনের ঘরে।’
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমাদের কাছে আমার রক্তঋণ। তোমরা রক্ত দিয়ে আমাকে মুক্ত করে এনেছিলে। সেই রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন।
আর আমাদের রক্তঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। সুন্দর উন্নত অসাম্প্রদায়িক ভেদাভেদহীন বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধুর কাছে আমাদের যে অশোধ্য ঋণ, তা কিছুটা শোধ করার চেষ্টা করে যেতে হবে।
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক