‘বই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে; প্রতীচী থেকে প্রাচীতে; বই এখন ফেরারি; ইউরোপ থেকে লেজ গুটিয়ে বই এখন ঘাড় গোঁজার চেষ্টা করছে ভারতবর্ষে’—পশ্চিমে অনলাইন বই কিংবা শ্রুতিবই প্রকাশের হিড়িক দেখে ফরাসি চিন্তক জাক দেরিদা একবার এই মন্তব্য করেছিলেন। বাংলাদেশে ফি বছর একুশের বইমেলায় গা ঘেঁষে ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বইয়ের স্টল আর উপচে পড়া জনসমাগম দেখলে মনে হয় দেরিদা ঠিকই বলেছেন। কিন্তু মুখোশ চিরে মুখ চেনাটাও জরুরি—জনারণ্যের কতজন বইয়ের ক্রেতা? ভিড় ঠেলা ক্রেতাদের কতজন পাঠক? আর গাদা গাদা পাঠকের কতজন আছেন, যাঁরা বইয়ের বাছবিচার করতে পারেন? ঠাকুর অনুকূল বলেছেন তুষ ফেলে চাল নিতে। কতজন পারি তুষ ঝেড়ে চাল বাছতে? অ-বই থেকে বই খুঁজে বের করতে? মেলার ঘাস যাদের পায়ের ঘষায় সবচেয়ে বেশি উঠে আসে, তারা ওই নতুন প্রজন্মের দলভুক্ত।
ঠিক যে বইমেলায় সবচেয়ে বেশি আসে তরুণেরা, কিন্তু সংশয় আমার এক শ ভাগ, তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকার অর্থে বইয়ের কদর বুঝতে পারে, বইয়ের রসাস্বাদন করে। বইমেলা বছরের পর বছর ধরে ‘প্রকৃত পাঠক’, না একদল ‘হুজুগে পাঠক’ তৈরি করছে, তার হিসাব কষা জরুরি। খেয়ালে আনলে বোঝা যাবে, হুজুগে পাঠক কোনো বাছবিচার করে না, ভিড় দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বই কেনে, বাসায় ফিরে উত্তেজক মলাট ওলটায়, বিছানায় শুয়ে গোগ্রাসে বই গেলে, মচমচ করে পাতা খায়। ভুলে গেলে ভুল হবে যে ভিড় কিন্তু ভিড়ের রুচি তৈরি করে। স্বতন্ত্র রুচি তৈরির সুযোগ সেখানে কোথায়? আবার এটাও তো কোনো সুস্থ লক্ষণ নয় যে বই প্রকাশ নির্ভর হয়ে পড়েছে একান্তই একুশে বইমেলার ওপর। কেননা, আমাদের উচিত কেবল মেলা নয়, সারা বছর ধরেই এমন উদ্যোগ নেওয়া, যাতে নতুন প্রজন্ম বইপাঠে সত্যিকারের যে আনন্দ, সেই স্বাদ নিতে সক্ষম হয়ে ওঠে, যাতে বইয়ের কদরের দুর্বলতা কাটিয়ে মনের বিকাশ ঘটাতে পারে।
রুচি মানেই নির্বাচন। নির্বাচন কেবল পাঠকের বই কেনায় নয়, সবচেয়ে জরুরি বই প্রকাশের নির্বাচন। বাছবিচার এখানে অনপনেয়। নইলে নিম্নমানের বাজারিতে বইমেলা ছেয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। নতুন প্রজন্মের একজন হিসেবে আমার চাওয়া তাই স্পষ্ট—বইমেলা কেবল মুনাফাতাড়নায় যেন পর্যবসিত না হয়। তথাকথিত বিশ্বায়নের দোহাই পেড়ে বই প্রকাশ আর বইমেলা স্রেফ বাজারিপনায় যেন আটকে না যায়। বই পণ্য, মানি; সাবান পণ্য, এ-ও মানি, কিন্তু গোল বাঁধে যদি এ দুয়ের পার্থক্য করতে না পারি। সাবান ক্রেতা কেবল সাবানই কেনে, বইয়ের ক্রেতা বইয়ের সঙ্গে মতাদর্শ, ভাষা আর রুচিও ক্রয় করেন। সনাতনী ভাবনা বদলে দিয়ে নতুন ছাঁচে বই প্রকাশ ও তার বার্তা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায় কিন্তু আমরা তাই এড়াতে পারি না। বইমেলার মাধ্যমে জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিবৃত্তি ও রুচির পরিচয় তুলে ধরার যে সুযোগ ফি বছর আসে, আমাদের উচিত হবে তার যথার্থ ব্যবহার করা।
বইমেলা নতুন প্রজন্মের বইপ্রেমীদের তীর্থক্ষেত্র; এদের অনেকে বছরের বাকি এগারো মাস চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে একুশের এই মেলার জন্য। দেশে-বিদেশে কত মেলা হয়, কিন্তু মন ভরে না। কত পানি কিন্তু চাতকের চাই মেঘের জল, কত মেলা হয়, কিন্তু এদের চাই একুশের বইমেলা।
সাইবেরিয়া থেকে ফি শীতে পরিযায়ী পাখিরা আসে; আমি অনেককে জানি, যারা বার্লিন, সিডনি, নিউইয়র্ক কিংবা বিলেত থেকে ঠিক এই সময়ে পরিযায়ী পাখির মতো বাংলাদেশে ছুটে আসেন কেবল বইমেলার টানে। কী অদ্ভুত সুন্দর এই প্রাণের টান, ভাবলেই কান্না পায়, ভূভাগে আবেগঘন এমন দ্বিতীয় জাতি মেলা ভার। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার-পাউন্ড-ইউরো খরচ করে হাজার মাইল দূর থেকে প্রতিবছর প্রবাসী বাঙালিরা ছুটে আসেন বইমেলার ভিড়ে নিজেকে শামিল করতে, এইপ্রীতিময়আশায় যে তাঁরা যেন এই মিলনমেলা থেকে বাদ না যান।
স্বদেশ থেকে বহু দূরে থাকলেও তিনিও যে এই সংস্কৃতির একজন গর্বিত উত্তরাধিকার, মেলায় এসে এর জানান দিতে চান। এভাবেই বইমেলা দেশি-প্রবাসী লাখো পাঠকের মনোজগতে শুভ অভিঘাতের সৃষ্টি করে চলেছে। তাই মেলায় থাকতে হবে নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পাঠযোগ্য বৈচিত্র্যময় বই। উৎসাহ দিতে হবে নতুন লেখকদের। ভালো পাঠকই আখেরে ভালো লেখক তৈরি করে। বইমেলাকে তাই পাঠকবান্ধব না হয়ে উপায় নেই। বইমেলা কেবল বই কেনার নয়, বই দেখার, বই সুবাস নেওয়ার, বই ছোঁয়ার মেলা। পাঠক যেন নিশ্চিন্তে মেলার পবিত্র আঙিনায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। প্রকাশক যেন পছন্দসই পরিসর পান। সৃজনশীলতা ও মুক্তচিন্তার মেলা যেন সব অর্থেই মুক্ত হয়। সবার মতামত নিয়ে মেলার পরিসরকে আরও সৃষ্টিশীল, আরও আকর্ষণীয় করে নির্মাণের প্রয়াস নিতে হবে। প্রতিবছর মেলার আদল যেন এক রকম না হয়; একঘেয়ে বিন্যাস থেকে বইমেলাকে তাই বেরিয়ে আসতে হবে। অন্দরমহল আর বহিরাঙ্গে প্রতিবছরই নতুনত্ব আর বৈচিত্র্য আনার উদ্যোগ নিতে হবে, নান্দনিক বিবেচনাকে ওপরে ঠাঁই দিতে হবে।
বইমেলাকে ঘিরে বাংলা একাডেমি, বইয়ের প্রকাশক, পাঠক আর লেখক—এই চার অংশের শুভ ও সৃষ্টিশীল সমন্বয় দেখার অপেক্ষায় থাকি আমরা। ভাষা আন্দোলনের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, তার স্বভাবটি যেন মেলার আয়োজন আর বিন্যাসে প্রকাশ পায়—এই আমাদের প্রত্যাশা।
রোবায়েত ফেরদৌস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক
robaet.ferdous@gmail.com