বইয়ের বোঝা কমিয়ে দিন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

প্রতিবছরের মতো নতুন বছরের প্রথম দিনেই সারা দেশে প্রায় ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪টি নতুন বই বিতরণ করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে নতুন বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দিচ্ছে সরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই নতুন বই বিশেষ অবদান রেখেছে, যা বাংলাদেশের সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক ছিল। সামনে বিশ-তিরিশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা। সেখানে কেবল শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনলেই হবে না, বরং তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষা। সেই শিক্ষার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ও কলেবরের সম্পর্ক কী?

আমাদের দেশে পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর হাতে আমরা ধরিয়ে দিই ৬টি বই। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর সেটি হয়ে যায় ১৫টি! মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তার বইয়ের সংখ্যা আড়াই গুণ বেড়ে যায়। শুধু বইয়ের সংখ্যা নয়, বইয়ের কলেবরও বেড়ে যায় অনেকাংশে। বইয়ের সংখ্যা বা কলেবরে খুব একটা ঝামেলা হয়তো হতো না, যদি অনেকগুলো বিষয় তারা খেলতে খেলতে জানত। কিন্তু যেহেতু শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করার মাত্র একটি পন্থাই আমাদের শিক্ষাকর্তারা জানেন, তাই শেষ পর্যন্ত এই বইগুলো হয়ে যাচ্ছে বোঝাবিশেষ।

চারু ও কারুকলা এবং শারীরিক শিক্ষার কথাই ধরা যাক। জাতীয় শিক্ষানীতিতে যেহেতু শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কথা বলা হয়েছে, তাই আলাদা করে এই দুই বিষয়ে দুটি বই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষা মানেই যেহেতু কেবল পঠন উপকরণ, তাই সেগুলোকে ভারাক্রান্ত করা হয়েছে অদ্ভুত সব বিষয়ে। অষ্টম শ্রেণির চারু ও কারুকলা বইয়ে রয়েছে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে চারুশিল্প ও শিল্পী’রা নামে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। নিঃসন্দেহে এটির ঐতিহাসিক উপাদান এবং তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু চারু ও কারুকলা বইয়ে কেন এই অধ্যায় সংযোজন করতে হবে? আর যদি তাই করতে হয় তাহলে কি গণিত বইয়ে ‘স্বাধীনতাসংগ্রামে গণিতবিদদের ভূমিকা’ নিয়ে আলাদা অধ্যায়ের অবতারণা করার প্রয়োজন পড়ে না?

একইভাবে অষ্টম শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা বইয়ে ‘স্কাউটিং, গার্ল গাইডস ও বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি’ সম্পর্কে একটি বিস্তারিত অধ্যায় রয়েছে। আমাদের প্রশ্নকর্তাদের মনমানসিকতা সম্পর্কে যাঁদের ধারণা আছে, তাঁরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন এই অধ্যায়ের শেষে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করতে বাধ্য করা হবে, সেগুলো হচ্ছে প্রাথমিক চিকিৎসার কথা প্রথমে কে বলেছেন? গার্ল গাইডসের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের পার্থক্য কী? ইত্যাদি। একই বইয়ের জীবনের জন্য খেলাধুলা অধ্যায়ে শিক্ষার্থীদের যে কাজ করতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো (পৃ-৪৩) -

কাজ-১: নিজ নিজ বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে লেখো।

কাজ-২: ক্রীড়াঙ্গনের মান উন্নয়নের জন্য কী কী করা যায়, তা পরামর্শ করে লেখো।

বোঝা যাচ্ছে, লেখকেরা শিক্ষার্থীদের যত না খেলতে উৎসাহ দিতে চান, তার চেয়ে বেশি চান খেলা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করাতে, সেটা নিয়ে রচনা লেখাতে! কাজেই আমি অবাক হইনি যখন এ অধ্যায় শেষের প্রশ্নগুলো দেখেছি।

১. প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা একজন শিক্ষার্থীকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে, ব্যাখ্যা করো।

 ২. ভালো হকি খেলোয়াড় হতে হলে স্টপিং ও ড্রিবলিং আয়ত্ত করার বিকল্প নেই—মতামত দাও।

৩. দ্রুতগতির ফুটওয়ার্কই ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় হওয়ার পূর্বশর্ত, ব্যাখ্যা করো। ইত্যাদি।

যাঁরা এই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করেছেন, তাঁদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই জানতে চাই, একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে কেন উল্লিখিত বিষয় মুখস্থ করতে হবে? আর কেনই বা এসব বিষয় জানার জন্য তার একটি আস্ত পাঠ্যপুস্তক থাকবে? শারীরিক শিক্ষা এবং চারু ও কারুকলার কেবল ব্যবহারিক ক্লাসই থাকা দরকার শিশুদের। বই যদি থাকতেই হয়, সেটি থাকবে শিক্ষকের জন্য, যিনি শিক্ষার্থীদের ছবি আঁকতে শেখাবেন কিংবা শিক্ষার্থীদের সাঁতার কাটতে শেখাবেন। আমার আশঙ্কা, এ বইগুলোর পরবর্তী সংস্করণে ‘সাঁতার শেখার ১০টি ইউটিউব চ্যানেলের নাম লেখো’ জাতীয় বিষয়ও হয়তো জুড়ে দেওয়া হবে।

বিশ্বজুড়ে ছেলেমেয়েদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে মুখস্থের তেমন কোনো বালাই নেই। তাদের তৈরি করা হচ্ছে সমস্যা সমাধানে দক্ষ হতে, কথোপকথন আর নেটওয়ার্কিং থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য উপযুক্ত হতে এবং নিজেকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারাতে। সঙ্গে থাকছে আগামী দিনের প্রয়োজনীয় কলাকৌশলগুলো সঠিকভাবে আয়ত্ত করার কৌশল। এস্তোনিয়ার মতো দেশে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে কোডিং শেখাচ্ছে, গণিতের নতুন নতুন বিষয়গুলো যাতে সে আয়ত্ত করতে পারে, সে জন্য তার মৌলিক দক্ষতাগুলোকে শাণিয়ে তুলতে। আর আমরা তাকে ধরিয়ে দিচ্ছি মোটা মোটা বই মুখস্থ করা ছাড়া যা থেকে শিক্ষার্থীদের নেওয়ার কিছু নেই।

নেই বলেই প্রধানমন্ত্রী শিশুদের ওপর বইয়ের চাপ কমিয়ে দিতে বলেছেন। সম্প্রতি এক সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিশুরা অনেক বেশি বই কাঁধে নিয়ে ঘোরে। এতে তাদের কষ্ট হয়। পরীক্ষা নিতে নিতে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে বাচ্চাদের। গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি মিলনায়তনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক সভায় এসব কথা বলেন তিনি। সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। (বাংলা ট্রিবিউন, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)।

তবে এ শুধু প্রধানমন্ত্রীর একার কথা নয়। সারা দেশের অভিভাবকেরাও একই কথা বলেন। বইয়ের ভারে আক্রান্ত শিশু খেলতে চায় না, লিখিত পরীক্ষা নামে এক অত্যাচারের কারণে সে কেবল মুখস্থ করে, মুখস্থ করে, মুখস্থ করে।

নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কাজ চলছে। সে অনুযায়ী আগামী বছর থেকেই নতুন করে সাজানো হচ্ছে আমাদের শিক্ষাক্রম। আশা করি, এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে শিশুদের ঘাড় থেকে বইয়ের বোঝা কমিয়ে দেবেন।

মুনির হাসান: বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক