এমানুয়েল মাখোঁ আবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হলেন। জনতুষ্টিবাদী কট্টর ডানপন্থী মারি লোঁ পেনের নানা রাজনৈতিক কৌশল শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। মাখোঁ এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। গত রোববার ইউরোপ ও বিশ্বরাজনীতিতে অন্যতম দেশটির নির্বাচন নিয়ে সবার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল। শেষ পর্যন্ত কে বিজয়ী হবেন—মধ্যপন্থী লিবারেল মাখোঁ না কট্টর ডানপন্থী মারি লোঁঁ পেন!
২৪ এপ্রিলের নির্বাচনের আগে ফ্রান্সের নেতৃস্থানীয় পত্রিকাগুলো ফরাসি অতীত রাজনীতির কথা স্মরণ করিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ভোটারদের সতর্ক করে। ফল প্রকাশের আগে লো মঁদে পত্রিকা লিখেছিল, ফ্রান্স একটি বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। চরম ডানপন্থী দলের প্রার্থী মারি লোঁ পেনের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে একটিই উপায় রয়েছে। তা হলো, তাঁর প্রতিপক্ষ এমানুয়েল মাখোঁকে ভোট দেওয়া। ‘লে ফিগারো’ বলেছিল, লোঁ পেনের জয়ের অর্থ হবে, জাতীয় ঐক্যের বিপরীত স্রোতের বিজয়। আর তাঁর বৈদেশিক নীতি ফ্রান্সকে সবার কাছে অবিশ্বস্ত করবে। বামপন্থী দৈনিক ‘লিবারেশন’ লিখেছে, বামপন্থীদের নিজ দলের বাইরে ভোট না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর ভোট না দেওয়ার অর্থ, মারি লোঁ পেনকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করা।
সাবেক ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জঁ মার্ক অয়রাউল্ট, জার্মানির পত্রিকা টাগেস স্পিগেল পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘উগ্র ডানপন্থী প্রার্থী মারি লোঁ পেন ক্ষমতাসীন হলে, প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করবে। সেই সঙ্গে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে টিকে থাকা সর্বজনীন মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে লোঁ পেনের উত্থান ঘটলে, তিনি ফ্রান্সকে সহিংসতার পথে পরিচালিত করবেন।
ভোটের চার দিন আগে এমানুয়েল মাখোঁ ও পেনের মধ্য টেলিভিশন দ্বৈরথে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বিতর্ক জমে ওঠে। বিতর্কের মূল বিষয়গুলো ছিল, পেনের সঙ্গে পুতিনের সান্নিধ্য, ইইউ পার্লামেন্টের বরাদ্দকৃত অর্থ জালিয়াতি, ইইউ নিয়ে অবস্থান ও ইউরোপের ভবিষ্যৎ, ফরাসি সংস্কৃতির খোলসে ইসলাম ও অভিবাসী বিরোধিতা, হিজাব–বিতর্ক, জ্বালানি, জীবনযাত্রার ব্যয়, পেনশন নীতি প্রভৃতি।
এ ছাড়া একটি রাশিয়ান ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মারি লোঁ পেনের দল নির্বাচনী প্রচারের ব্যয় মেটানোর বিষয়টি ফরাসি জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। অবশ্য তিনি বলেছেন, কোনো ফরাসি ব্যাংক তাঁকে ঋণ না দেওয়ায় তাঁর দল রাশিয়ার ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ এবং দুই বছর ধরে করোনা মহামারির ছোবলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়–পরবর্তী ফ্রান্সের এই নির্বাচন ছিল বেশ ঘটনাবহুল।
এমানুয়েল মাখোঁ ও লোঁ পেনের মধ্যে টেলিভিশন দ্বৈরথে মাখোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রসঙ্গ ও মহাদেশীয় ঐক্য আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন। এমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপীয় ঐক্যের প্রশ্নে লোঁ পেনের বিরুদ্ধে ইইউ থেকে ফ্রান্সের বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গোপনে কাজ করার অভিযোগ করেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন, মারি লোঁ পেন ফ্রান্স-জার্মান সম্পর্কের অবসান এবং দ্বিপক্ষীয় অস্ত্র প্রকল্প বাতিল করতে চেষ্টা করছেন। বিতর্কে মারিন লোঁ পেন বিষয়গুলো অস্বীকার করেননি।
অন্যদিকে মারিন লোঁ পেন ইইউকে এড়িয়ে ফ্রান্সের শক্তি বৃদ্ধির কথা বলেন। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইউরোপের প্রায় সব জায়গায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনবিরোধী মনোভাব তৈরি হলেও পেনের সঙ্গে পুতিনের সখ্য সর্বজনবিদিত। পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে পেন বর্তমানে বেশ সমালোচিত। এমনকি পুতিনবিরোধী রুশ ব্যক্তিত্ব আলেক্সি নাভালনি পুতিনের সঙ্গে পেনের সংযোগের কারণে এমানুয়েল মাখোঁকে নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মারি লোঁ পেন অভিযোগ করেন, এমানুয়েল মাখোঁর সময়ে জীবনযাত্রা ও জ্বালানির ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া পেনশন–সংক্রান্ত ও অভিবাসনবিষয়ক নীতির সমালোচনা করেন। তিনি রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলেন। কারণ, এই নিষেধাজ্ঞা ফরাসিদের ক্ষতি করবে বলে যুক্তি দেখান। অন্যদিকে এমানুয়েল মাখোঁ রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল না থাকার কথা বলেন।
টেলিভিশন বিতর্কের সময় এমানুয়েল মাখোঁ তাঁর প্রতিপক্ষের দাবি করা জনপরিসরে হিজাব নিষিদ্ধের বিষয়টিও প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ফরাসি সংবিধানে এর কোনো ভিত্তি নেই। হিজাবের প্রশ্নটি ধর্মীয় বিষয়। যদি কেউ হিজাব নিষিদ্ধ করতে চায়, তবে ইহুদিদের কিপ্পা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতীক নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্য পৃথক্করণ অর্থ ধর্মের সঙ্গে লড়াই করা নয় বলে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, পেন বলেছিলেন, ফ্রান্স হবে বিশ্বের প্রথম দেশ যারা হিজাব নিষিদ্ধ করার নীতি প্রবর্তন করবে। ফ্রান্সে ধর্মীয় নিরপেক্ষতার কারণে হিজাব পরিধান শুধু স্কুলে এবং জনপ্রশাসনে নিষিদ্ধ রয়েছে।
২০ এপ্রিল এমানুয়েল মাখোঁ ও লোঁ পেনের মধ্য টেলিভিশন বিতর্কের পর স্ট্যাটিসটা নামের একটি জার্মান জরিপ সংস্থা জানিয়েছিল, এমানুয়েল মাখোঁ খুব সামান্য ব্যবধানে পেনকে পরাজিত করবেন। জরিপে এমানুয়েল মাখোঁ ৫৬ শতাংশ ও পেন ৪৪ শতাংশ ভোট পাবেন বলে জানানো হয়েছিল। তবে চূড়ান্ত ভোটে মাখোঁ পেয়েছেন ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ আর পেন পেয়েছেন ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট।
ফ্রান্সে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ফরাসি সংবিধানে ১৯৬২ সাল থেকে দুটি ব্যালটে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়ার বিষয়টি কার্যকর করা হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। এবার মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৮৭ লাখ। আর ভোট দিয়েছেন ৬৩ দশমিক ২৩ শতাংশ ভোটার। এন ম্যারশে বা এগিয়ে যাও দলটির নেতা এমানুয়েল মাখোঁ ২০১৭ সালের মে থেকে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত আছেন। পাঁচ বছর আগেও রান অফ নির্বাচনে অতি ডানপন্থী রাসেম্বলমেন্ট ন্যাশনাল বা সাবেক ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের প্রধান মারি লোঁ পেনকে পরাজিত করেছিলেন এবং সর্বকনিষ্ঠ ফরাসি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net